মৃত মানুষের সংখ্যা কি জীবিতদের চেয়ে বেশি? by শেখ আবদুল হাকিম

শেখ আবদুল হাকিম একজন রহস্য সাহিত্যিক। সর্বভুক পাঠক। তাঁর বিচিত্র পাঠ-অভিজ্ঞতার আলোকে এই কৌতূহলোদ্দীপক রচনা প্রায়ই বলা হয় পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত মানুষ মারা গেছে, আজ তার চেয়ে বেশি মানুষ জীবিত আছে। এই ‘বাস্তবতা’ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত গ্রহের জনসংখ্যা নতুন মাত্রা পাওয়ার পর।


অর্থাৎ জনসংখ্যা খুব দ্রুত হারে বাড়ছে, এই ভয়কে আরও উসকে দেওয়া হচ্ছে।
এ কথা সত্যি আমরা যদি অতীতের ঝাপসা গহ্বর হাতড়াই, দুনিয়ার জনসংখ্যা এখনকার তুলনায় খুবই কম ছিল এবং যুক্তি দিয়ে হজম করানো সম্ভব, মৃতদের চেয়ে বর্তমানে জীবিতরাই সংখ্যায় বেশি।
এখন ৭০০ কোটি মানুষ বেঁচে আছে, জাতিসংঘের দেওয়া এই হিসাব প্রায় সব জনসংখ্যাতত্ত্ববিদই [ডেমোগ্রাফার] যুক্তিগ্রাহ্য বলে মেনে নিয়েছেন। সমস্যা হলো, এর আগে সব মিলিয়ে কত মানুষ বেঁচে ছিল সেটা আপনি হিসাব করবেন কীভাবে? শুরুই বা করবেন কোত্থেকে?
ওয়াশিংটনের দ্য পপুলেশন রেফারেন্স ব্যুরো নামে একটা গ্রুপ এই কাজটা করতে চাইছে। তাদের একজন, ওয়েন্ডি বল্ডউইন জানিয়েছেন, শুরুর সময় ধরতে হবে হোমো সেপিয়ানরা যখন পৃথিবীর বুকে হাঁটা ধরল, প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে। এতে
শুরুর বিন্দুটা না-হয় পাওয়া যাচ্ছে, আরও পাওয়া যাবে সর্বশেষ সংখ্যাও, কিন্তু সমস্যা তৈরি করছে ওই দুটোর মাঝখানের সময়টা। ‘কারণ ওই সময়ের ৯৯ শতাংশেরই কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই,’ বলছেন তিনি।
এর মানে হলো, অভিজ্ঞতার সাহায্যে [এডুকেটেড গেজ] বিশেষজ্ঞদের একটা অনুমানে পৌঁছাতে হবে।
বিংশ শতাব্দীতে মানুষের জন্মহার প্রতিবছর প্রতি ১০০০ জনে ৪০টি থেকে কমে ১৯৯৫ সালে তা স্রেফ ৩১-এ নেমে আসে, এখন সেটা মাত্র ২৩।
কিন্তু অনেক আগে প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে প্রতিবছর প্রতি ১০০০ জনে ৮০টি করে পুনরুৎপাদন হার দরকার ছিল, কারণ মানুষ তখন বেশি দিন বাঁচত না বলে যারা জন্ম নিত তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই সন্তান উৎপাদনের বয়সে পৌঁছাতে পারত।
উইন্ডি বলছেন, ‘আজ লোকজন ৭৫-৮০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবে বলে আশা করে, কিন্তু মানুষের ইতিহাসে এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।
‘মধ্যযুগের হিসাব পেতে গিয়ে আমরা দেখেছি, ওই সময় গড় আয়ু আশা করা হতো ১০-১২ বছর, যার অর্থ অনেক মানুষ তার শৈশবই পার হতে পারত না।
‘জন্মহার যদি খুব বেশি হতো, তাহলেও তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেরা সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকত না।’
অন্য ভাষায়, একেবারে আদিম যুগের মানুষ বছরে কতসংখ্যায় জন্ম নিত, কত দিন বেঁচে থাকত, কতসংখ্যায় মারা যেত, এর হিসাব করতে গিয়ে ভুল করা খুব সহজ। আজকের মান অনুসারে প্রতি ১০০০ জন মানুষে ৮০টি জন্ম খুব বেশি মনে হতে পারে—কিন্তু বাস্তবে এটা একটা রক্ষণশীল হিসাব, ইঙ্গিত দেয়, ‘জনসংখ্যা বাড়তির হার খুবই মন্থর, আজ আমরা যে গতি দেখছি তার চেয়ে অনেক শ্লথ।’
আদিযুগের জন্য এই অভিজ্ঞতালব্ধ অনুমানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে অনেক বেশি নিখুঁত আধুনিক যুগের তথ্য-উপাত্ত।
উইন্ডি বলছেন, ‘একবার যখন লেখালেখির চর্চা আরম্ভ হলো, যখন লোক এবং সম্পদ গণনা শুরু হলো, দেশে দেশে যখন কর আদায়ের সূচনা ঘটল, লিখিত রেকর্ড রাখার মানও অনেক বেড়ে গেল।’
১৮০০ সাল, কিংবা আরও কিছু আগে থেকে, তথ্য-উপাত্তের মান বেশ ভালো হতে শুরু করে। ‘এটা বলা যুক্তিসংগত হবে যে [ওই সময়ে] দুনিয়ার বুকে ১০০ কোটি মানুষ বেঁচে ছিল।’
তাঁর ব্যাখ্যা: এই লিখিত রেকর্ডের মানে হলো পৃথিবীতে সর্বমোট কত মানুষ জন্মেছে তার চূড়ান্ত সংখ্যা সম্পর্কে আপনি আত্মবিশ্বাসী।
তাঁর দৃষ্টিতে, জনসংখ্যা বাড়ার বেশির ভাগ ঘটনা আধুনিক যুগে এসে ঘটেছে, যখন রেকর্ড রাখা হতো। কাজেই আদিযুগের হিসাবে যদি সামান্য ত্রুটি থেকেও থাকে, সেটা ‘যারা বেঁচে ছিল’ আর ‘যারা বেঁচে আছে’ এই দুই দলের সার্বিক অনুপাতে বড় ধরনের কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করবে না।
তাহলে সংখ্যাটা কী? বর্তমানে আমরা ৭০০ কোটি মানুষ বেঁচে আছি। আর পপুলেশন রেফারেন্স ব্যুরোর হিসাবে ইতিমধ্যে ১০ হাজার ৭৬০ কোটি মানুষ মারা গেছে।
দেখা যাচ্ছে, মরা মানুষের চেয়ে জীবিত মানুষের সংখ্যা বেশি, এই ধারণার কাছাকাছিও পৌঁছানো যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিটি জীবিত মানুষের পেছনে ১৫ জন মরা মানুষ রয়েছে। ৭০০ কোটি মরা মানুষকে আমরা সেই সুদূর অতীতে ছাড়িয়ে এসেছি— খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০০ এবং খ্রিষ্টাব্দ ১-এর মাঝখানে কোথাও।
এই পর্যায়ে কল্পকাহিনির ভক্তরা আর্থার সি ক্লার্কের ক্লাসিক ২০০১: আ স্পেস অডিসি বইটির খোঁজ করতে পারেন। ওই বইতে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন: ‘এই মুহূর্তে যত মানুষ বেঁচে আছে তাদের মাথাপিছু ৩০টা করে ভূত আছে, কারণ এই অনুপাতেই জীবিতদের ছাড়িয়ে গেছে মৃত ব্যক্তিরা।’
দুটো হিসাব না মিললেও, মিসেস উইনি বলছেন, ক্লার্কের এই হিসাবে ভুল নেই।
‘তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ১৯৬৮ সালে। ওই সময় পৃথিবীর বুকে সম্ভবত সাড়ে ৩০০ কোটি মানুষ বেঁচেবর্তে ছিল, কাজেই আপনি যদি আমাদের পদ্ধতি ধরে হিসাব করেন, প্রতি জীবিত মানুষের পেছনে ২৯ জন মরা মানুষ পাবেন।’
কিন্তু আমরা কি কখনো এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাব, যখন মরা মানুষের চেয়ে জীবিতদের সংখ্যা বেশি হবে? তার জন্য দরকার খুবই উঁচু জন্মহার। উইন্ডি বলছেন, ‘পৃথিবীর ধারণক্ষমতা ১০-১৫ হাজার কোটি, এটা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? আমি পারি না।’

No comments

Powered by Blogger.