কালের পুরাণ-শেখ মুজিব পাঠ এখনো কেন জরুরি by সোহরাব হাসান
দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জীবদ্দশায় তো বটেই, মৃত্যুর পরও তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে আমাদের রাজনীতি। এক পক্ষ তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, আরেক পক্ষ যুক্তিহীন বিরোধিতা করে আসছে। সম্ভবত কোনো পক্ষই তাঁর রাজনীতির অভিজ্ঞান ও সাধনার নিতল মর্ম উপলব্ধি করতে পারেনি।
এখানেই হয়তো শেখ মুজিব অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম এবং বিশিষ্ট। বাংলায় তাঁর চেয়ে প্রাজ্ঞ, বিদ্যাবুদ্ধিতে অগ্রসর অনেক নেতা জন্মেছেন; কিন্তু শেখ মুজিবের মতো কেউ বাঙালির আবেগ, স্পর্ধা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারেননি। সমসাময়িক রাজনীতিকেরা যেখানে বারবার নীতি পরিবর্তন করেছেন, তাত্ত্বিক বিতর্কে দলকে বিখণ্ডিত করেছেন, সে সময়ে শেখ মুজিব জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্যজ্ঞান করে বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন, পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামকে করে তুলেছেন অনিবার্য। কেউ কেউ তাঁকে স্বাধীনতার অনুপস্থিত নেতা বলে সমালোচনা করেন। কিন্তু তাঁরা একবারও ভেবে দেখেন না, একাত্তরের পঁচিশে মার্চের আগেই শেখ মুজিব বাংলাদেশের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর অসহযোগও মহাত্মা গান্ধী বা মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো নিছক প্রতিবাদ-আন্দোলন ছিল না; ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো এবং শাসনের বিরুদ্ধে একটি সফল ও বিকল্প শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই তিনি স্বাধীনতার নেতা।
এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে স্বাধীনতার নেতা হিসেবে শেখ মুজিব বাঙালি জাতিকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারেননি। এর কারণ কি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, না বাঙালির চিরন্তন বিভেদকামী স্বভাব—সে বিচার ইতিহাস করবে। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত জটিল। তাঁর অনুসারীদের একাংশ দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। এখন যাঁরা আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তি হিসেবে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, মহাজোট সরকারের শরিক হওয়াকে দেশপ্রেমিক দায়িত্ব মনে করছেন, তাঁদের অনেকেই ১৯৭৩-৭৪ সালে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাকে ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধা করেননি। আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধিতার নামে সদ্য স্বাধীন দেশে তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার পুনরাবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন। আরেক শ্রেণীর বিপ্লববিলাসী শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কেবল সশস্ত্র লড়াই করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেই লড়াই কামিয়াব করতে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরহাতে ধরনাও দিয়েছে। (দ্রষ্টব্য: জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে কমরেড আবদুল হকের লেখা চিঠি)।
এরই পাশাপাশি শাসক আওয়ামী লীগের ভেতরেও গড়ে ওঠে একদল ফ্রাংকেনস্টাইন। তারা দেশের চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থই বড় করে দেখেছিল। লিপ্ত হয়েছিল উপদলীয় কোন্দলে। সেই অস্থির ও অরাজক পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি চক্রের সহায়তায় রাষ্ট্রপালিত ডাকাতেরা রাতের অন্ধকারে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে। শিক্ষাবিদ লেখক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, ‘তারা ষড়যন্ত্র করেছিল—বীভৎস হত্যার ষড়যন্ত্র, অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র। সে ষড়যন্ত্রে দেশি-বিদেশি অনেক কর্তা হয়তো ছিলেন, কিন্তু দেশের মানুষ তার অংশ ছিল না। শেখ মুজিবকে এবং সেই সঙ্গে নারী-শিশুনির্বিশেষে তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করে এরা শুধু বাংলাদেশের স্থপতিরূপে তাঁর ভূমিকাকে অস্বীকার করেনি, বাংলাদেশের আদর্শকেও অস্বীকার করেছিল।’ (স্মৃতিতে আগস্ট, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮)
২.
১৫ আগস্টের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে? অবশ্যই নয়। ঘাতকেরাও জানত, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এ কারণেই মৃত্যুর পরও তারা সংঘবদ্ধ হয়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ও অপপ্রচার চালিয়েছে। একসময় রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র দূরে থাক, বেসরকারি গণমাধ্যমেও তাঁর নাম উচ্চারণ করা হতো না। সেই নিষেধাজ্ঞার দেয়াল পেরিয়ে শেখ মুজিব আজ বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা ও মনন, আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। সেদিন যাঁরা তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরাই ইতিহাসের পাতায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় যদি আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে সবচেয়ে বড় বিয়োগান্তক ঘটনা হিসেবে স্বীকার করতে হবে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কেবল শেখ মুজিবের দেহকেই বুলেটবিদ্ধ করা হয়নি, আঘাত করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর। জাতীয়তাবাদকে বিকৃত করা হয়েছিল। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। বাকি থাকে গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রের গায়ে পরিয়ে দেওয়া হলো ১৫ বছর মেয়াদি সামরিক পোশাক। তার পরও কত সরকার গেল, কত সরকার এল, গণতন্ত্রের ভিত শক্ত হলো না।
আজ অনুকূল পরিবেশে অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, তাঁকে ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে অভিহিত করছেন; কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সেই প্রতিকূল সময়ে কতজন তাঁর কাজের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন? কতজনই বা অনুধাবন করেছেন তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী অভিঘাত? অধুনা শেখ মুজিবের জন্য বছরব্যাপী বন্দনা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সুবিধাবাদী চরিত্রের দিকটি প্রকট করে তোলে। যখন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজন ছিল, তখন অধিকাংশ লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক নীরব ছিলেন।
৩.
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনাটি আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি এবং অর্থনীতিতে কী অভিঘাত সৃষ্টি করেছে? ৩৫ বছর পর এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমরা বলছি, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির কথা। তার প্রকৃতি, তার গঠন, তার চরিত্র ও ধরনের কথা। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি—এ ব্যাপারে কারও মনে সংশয় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? সেটি গণতান্ত্রিক হতে পারে, গণতান্ত্রিক না-ও হতে পারে, কিন্তু সেটি স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র; যে রাষ্ট্রটি কারও তাঁবেদার হবে না, বশংবদ হবে না, কাউকে পরোয়া করে চলবে না। জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিব নিজের এবং তাঁর দেশের স্বাধীন সত্তাকে বিসর্জন দেননি বলেই কি তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, পরবর্তী সামরিক ও বেসামরিক কোনো শাসকই সেই স্পর্ধা ধারণ করতে পারেননি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী এক অস্থির অনিশ্চিত সময়ে শেখ মুজিবের জন্য দেশ পরিচালনা মোটেই সহজ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা নানা উপদলে বিভক্ত, কেউ কারও কথা শুনতে চায়নি। অর্থনীতি বিধ্বস্ত, রাজনীতি দিক্ভ্রান্ত, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশ প্রচণ্ড বৈরিতার মুখোমুখি। ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও বিরোধিতা করেছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরের আগে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায় করা যায়নি। সেই প্রবল বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে দেশের স্বাধীন সত্তা টিকিয়ে রাখার যে দুরূহ ও দুঃসাধ্য কাজটি তিনি করেছিলেন, অন্য কোনো নেতার পক্ষে সম্ভব ছিল না সন্দেহ। মওদুদ আহমদ শেখ মুজিবের শাসনকাল গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, ‘কারাবন্দী অবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে নিহত হলে শেখ মুজিব বাঙালি জনমানসে অমর হয়ে থাকতেন এবং বাঙালি হূদয়ে তাঁর মূর্তি থেকে যেত অবিনশ্বর। তিনি বিবেচিত হতেন ইতিহাসের মহোত্তম শহীদ হিসেবে। তবে সে ক্ষেত্রে বোধ হয় বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আরও সকরুণ হতো। হয়তো বাংলাদেশে অনেকগুলো সরকার একসঙ্গে বিরাজ করত, ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সরকারের ঘন ঘন পরিবর্তন হতো।...কিন্তু মুজিবের প্রত্যাবর্তন এবং তাঁর পরবর্তী ভূমিকা সম্ভাব্য এই ধ্বংসের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে।’ (শেখ মুজিবের শাসনকাল, মওদুদ আহমদ, ইউপিএল ১৯৮৩)
সেই বিচারে মুজিব কেবল স্বাধীনতার সিপাহসালার নন, রক্ষকও।
৪.
স্বাধীনতার পর আমাদের যে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে আকাশসমান স্বপ্ন ছিল। তারা সবকিছু দ্রুত পেতে চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, রাতারাতি মানুষের সব দুঃখকষ্ট ঘুচে যাবে, ন্যায় সাম্য ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, ২৪ বছরের ধর্মীয় বিভেদ নয় মাসের সংগ্রামে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারা প্রত্যাশা করেছিল, শেখ মুজিব সব সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু তিনি একজন মানুষ, একজন রাজনীতিক; তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল, দুর্বলতা ছিল। বিশেষ করে যে দলের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই দল ও তার অনুসারীরা যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য নিয়ে অন্তর কলহে লিপ্ত ছিল। শেখ মুজিব তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণিত করতে পারলেও ন্যায় ও ত্যাগের মহিমায় উদ্বেলিত করতে পারেননি। তাঁর দলের একটি বড় অংশ আদর্শচ্যুত হয়েছে, নীতিভ্রষ্ট হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী কাজ করেছে। তাঁদের কেউ কেউ মুজিব হত্যার সুবিধাভোগী দুই সামরিক শাসকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন; তাঁদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন।
১৫ আগস্ট-পূর্ববর্তী রাজনীতি ছিল দেশকে প্রগতির পথে, গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ার; তখন যাঁরা বিরোধী দলে ছিলেন, তাঁদের আক্ষেপ ছিল মুজিব কেন খাঁটি সমাজতান্ত্রিক হলেন না? কেন বুর্জোয়াদের সঙ্গে আপস করছেন? পঁচাত্তরের আগের রাজনীতি যতই ভ্রান্ত এবং অপরিণামদর্শী হোক, সুবিধাবাদিতা ততটা শিকড় গাড়তে পারেনি। অর্থমূল্যে রাজনীতি কেনাবেচা কিংবা দলবদল, দল ভাঙন বা গঠনের মহড়া চলেনি। রাজনীতি ক্রমশ ডানে ঝুঁকতে ঝুঁকতে এখন আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগবিরোধীদের আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বর্তমানে রাজনীতিতে যে নীতি ও আদর্শের মহামারি, রুচিহীনতা ও গালাগালের প্রতিযোগিতা চলছে—সেটিও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের অভিঘাত। আগের রাজনীতিকদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, মত ও পথের পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পরকে সম্মান করতেন, চরম শত্রুকেও বিপদে-আপদে সাহায্য করতেন। দিনে বিরোধী দল এবং রাতে সরকারি দলের ভূমিকা তখনকার রাজনীতিতে ছিল না। পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকেরা আরেকটি কাজ সুচারুভাবে করেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন; তাদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছেন। শেখ মুজিব তাদের ক্ষমা করে যদি ভুল করে থাকেন, জিয়া-এরশাদ রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করে অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন।
পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির সবচেয়ে ভয়ংকর যে অভিঘাত, সেটি হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর অরাজনৈতিক কর্তৃত্ব। সেই কর্তৃত্ব কখনো এসেছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে, নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের কথায়ই আস্থা রাখছেন, বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করছেন। জনগণ ও জনমত দুটোই উপেক্ষিত থাকছে। আমাদের রাজনীতিকেরাও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং থাকার জন্য দেশি-বিদেশি শক্তির কাছে ধরনা দিচ্ছেন। অতএব, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাইরের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ ১৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনীতির আরেক অভিঘাত হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। কেউ নিজেকে ভারতপন্থী, কেউ আমেরিকাপন্থী, কেউ সৌদি বা পাকিস্তানপন্থী প্রমাণের চেষ্টায় রত।
শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাঁর সহযাত্রীরা কেউ উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে আসেননি। উত্তরাধিকারের রাজনীতিও পঁচাত্তর-পরবর্তী বৈশিষ্ট্য। যখন নীতি-আদর্শের ঘাটতি দেখা গেল, যখন নেতাদের মধ্যে কোন্দল চরমে পৌঁছাল, তখনই রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের পুনরাবির্ভাব ঘটল। সেটি কেবল আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে নয়, ছোট দলগুলো সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে।
পঁচাত্তরের আগের ও পরের রাজনীতির মধ্যে আরেকটি বড় পার্থক্য হলো, এখন ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা এ-দলে ও-দলে ভাগ হয়ে আছেন। অর্থ কেবল দলকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্রের নীতিকেও।
পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ওপর কেউ ছিল না। ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিতেন। এখন সিদ্ধান্ত আসে অজ্ঞাত স্থান থেকে, রাজনীতিকেরা অনেক কিছুই জানেন না, কী হচ্ছে। এসব কারণে এখনো শেখ মুজিব পাঠ জরুরি বলে মনে করি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে স্বাধীনতার নেতা হিসেবে শেখ মুজিব বাঙালি জাতিকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারেননি। এর কারণ কি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, না বাঙালির চিরন্তন বিভেদকামী স্বভাব—সে বিচার ইতিহাস করবে। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত জটিল। তাঁর অনুসারীদের একাংশ দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। এখন যাঁরা আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তি হিসেবে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, মহাজোট সরকারের শরিক হওয়াকে দেশপ্রেমিক দায়িত্ব মনে করছেন, তাঁদের অনেকেই ১৯৭৩-৭৪ সালে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাকে ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধা করেননি। আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধিতার নামে সদ্য স্বাধীন দেশে তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার পুনরাবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন। আরেক শ্রেণীর বিপ্লববিলাসী শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কেবল সশস্ত্র লড়াই করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেই লড়াই কামিয়াব করতে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরহাতে ধরনাও দিয়েছে। (দ্রষ্টব্য: জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে কমরেড আবদুল হকের লেখা চিঠি)।
এরই পাশাপাশি শাসক আওয়ামী লীগের ভেতরেও গড়ে ওঠে একদল ফ্রাংকেনস্টাইন। তারা দেশের চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থই বড় করে দেখেছিল। লিপ্ত হয়েছিল উপদলীয় কোন্দলে। সেই অস্থির ও অরাজক পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি চক্রের সহায়তায় রাষ্ট্রপালিত ডাকাতেরা রাতের অন্ধকারে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে। শিক্ষাবিদ লেখক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, ‘তারা ষড়যন্ত্র করেছিল—বীভৎস হত্যার ষড়যন্ত্র, অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র। সে ষড়যন্ত্রে দেশি-বিদেশি অনেক কর্তা হয়তো ছিলেন, কিন্তু দেশের মানুষ তার অংশ ছিল না। শেখ মুজিবকে এবং সেই সঙ্গে নারী-শিশুনির্বিশেষে তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করে এরা শুধু বাংলাদেশের স্থপতিরূপে তাঁর ভূমিকাকে অস্বীকার করেনি, বাংলাদেশের আদর্শকেও অস্বীকার করেছিল।’ (স্মৃতিতে আগস্ট, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮)
২.
১৫ আগস্টের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে? অবশ্যই নয়। ঘাতকেরাও জানত, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এ কারণেই মৃত্যুর পরও তারা সংঘবদ্ধ হয়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ও অপপ্রচার চালিয়েছে। একসময় রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র দূরে থাক, বেসরকারি গণমাধ্যমেও তাঁর নাম উচ্চারণ করা হতো না। সেই নিষেধাজ্ঞার দেয়াল পেরিয়ে শেখ মুজিব আজ বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা ও মনন, আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। সেদিন যাঁরা তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরাই ইতিহাসের পাতায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় যদি আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে সবচেয়ে বড় বিয়োগান্তক ঘটনা হিসেবে স্বীকার করতে হবে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কেবল শেখ মুজিবের দেহকেই বুলেটবিদ্ধ করা হয়নি, আঘাত করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর। জাতীয়তাবাদকে বিকৃত করা হয়েছিল। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। বাকি থাকে গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রের গায়ে পরিয়ে দেওয়া হলো ১৫ বছর মেয়াদি সামরিক পোশাক। তার পরও কত সরকার গেল, কত সরকার এল, গণতন্ত্রের ভিত শক্ত হলো না।
আজ অনুকূল পরিবেশে অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, তাঁকে ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে অভিহিত করছেন; কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সেই প্রতিকূল সময়ে কতজন তাঁর কাজের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন? কতজনই বা অনুধাবন করেছেন তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী অভিঘাত? অধুনা শেখ মুজিবের জন্য বছরব্যাপী বন্দনা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সুবিধাবাদী চরিত্রের দিকটি প্রকট করে তোলে। যখন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজন ছিল, তখন অধিকাংশ লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক নীরব ছিলেন।
৩.
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনাটি আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি এবং অর্থনীতিতে কী অভিঘাত সৃষ্টি করেছে? ৩৫ বছর পর এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমরা বলছি, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির কথা। তার প্রকৃতি, তার গঠন, তার চরিত্র ও ধরনের কথা। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি—এ ব্যাপারে কারও মনে সংশয় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? সেটি গণতান্ত্রিক হতে পারে, গণতান্ত্রিক না-ও হতে পারে, কিন্তু সেটি স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র; যে রাষ্ট্রটি কারও তাঁবেদার হবে না, বশংবদ হবে না, কাউকে পরোয়া করে চলবে না। জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিব নিজের এবং তাঁর দেশের স্বাধীন সত্তাকে বিসর্জন দেননি বলেই কি তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, পরবর্তী সামরিক ও বেসামরিক কোনো শাসকই সেই স্পর্ধা ধারণ করতে পারেননি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী এক অস্থির অনিশ্চিত সময়ে শেখ মুজিবের জন্য দেশ পরিচালনা মোটেই সহজ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা নানা উপদলে বিভক্ত, কেউ কারও কথা শুনতে চায়নি। অর্থনীতি বিধ্বস্ত, রাজনীতি দিক্ভ্রান্ত, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশ প্রচণ্ড বৈরিতার মুখোমুখি। ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও বিরোধিতা করেছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরের আগে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায় করা যায়নি। সেই প্রবল বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে দেশের স্বাধীন সত্তা টিকিয়ে রাখার যে দুরূহ ও দুঃসাধ্য কাজটি তিনি করেছিলেন, অন্য কোনো নেতার পক্ষে সম্ভব ছিল না সন্দেহ। মওদুদ আহমদ শেখ মুজিবের শাসনকাল গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, ‘কারাবন্দী অবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে নিহত হলে শেখ মুজিব বাঙালি জনমানসে অমর হয়ে থাকতেন এবং বাঙালি হূদয়ে তাঁর মূর্তি থেকে যেত অবিনশ্বর। তিনি বিবেচিত হতেন ইতিহাসের মহোত্তম শহীদ হিসেবে। তবে সে ক্ষেত্রে বোধ হয় বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আরও সকরুণ হতো। হয়তো বাংলাদেশে অনেকগুলো সরকার একসঙ্গে বিরাজ করত, ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সরকারের ঘন ঘন পরিবর্তন হতো।...কিন্তু মুজিবের প্রত্যাবর্তন এবং তাঁর পরবর্তী ভূমিকা সম্ভাব্য এই ধ্বংসের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে।’ (শেখ মুজিবের শাসনকাল, মওদুদ আহমদ, ইউপিএল ১৯৮৩)
সেই বিচারে মুজিব কেবল স্বাধীনতার সিপাহসালার নন, রক্ষকও।
৪.
স্বাধীনতার পর আমাদের যে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে আকাশসমান স্বপ্ন ছিল। তারা সবকিছু দ্রুত পেতে চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, রাতারাতি মানুষের সব দুঃখকষ্ট ঘুচে যাবে, ন্যায় সাম্য ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, ২৪ বছরের ধর্মীয় বিভেদ নয় মাসের সংগ্রামে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারা প্রত্যাশা করেছিল, শেখ মুজিব সব সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু তিনি একজন মানুষ, একজন রাজনীতিক; তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল, দুর্বলতা ছিল। বিশেষ করে যে দলের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই দল ও তার অনুসারীরা যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য নিয়ে অন্তর কলহে লিপ্ত ছিল। শেখ মুজিব তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণিত করতে পারলেও ন্যায় ও ত্যাগের মহিমায় উদ্বেলিত করতে পারেননি। তাঁর দলের একটি বড় অংশ আদর্শচ্যুত হয়েছে, নীতিভ্রষ্ট হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী কাজ করেছে। তাঁদের কেউ কেউ মুজিব হত্যার সুবিধাভোগী দুই সামরিক শাসকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন; তাঁদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন।
১৫ আগস্ট-পূর্ববর্তী রাজনীতি ছিল দেশকে প্রগতির পথে, গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ার; তখন যাঁরা বিরোধী দলে ছিলেন, তাঁদের আক্ষেপ ছিল মুজিব কেন খাঁটি সমাজতান্ত্রিক হলেন না? কেন বুর্জোয়াদের সঙ্গে আপস করছেন? পঁচাত্তরের আগের রাজনীতি যতই ভ্রান্ত এবং অপরিণামদর্শী হোক, সুবিধাবাদিতা ততটা শিকড় গাড়তে পারেনি। অর্থমূল্যে রাজনীতি কেনাবেচা কিংবা দলবদল, দল ভাঙন বা গঠনের মহড়া চলেনি। রাজনীতি ক্রমশ ডানে ঝুঁকতে ঝুঁকতে এখন আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগবিরোধীদের আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বর্তমানে রাজনীতিতে যে নীতি ও আদর্শের মহামারি, রুচিহীনতা ও গালাগালের প্রতিযোগিতা চলছে—সেটিও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের অভিঘাত। আগের রাজনীতিকদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, মত ও পথের পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পরকে সম্মান করতেন, চরম শত্রুকেও বিপদে-আপদে সাহায্য করতেন। দিনে বিরোধী দল এবং রাতে সরকারি দলের ভূমিকা তখনকার রাজনীতিতে ছিল না। পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকেরা আরেকটি কাজ সুচারুভাবে করেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন; তাদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছেন। শেখ মুজিব তাদের ক্ষমা করে যদি ভুল করে থাকেন, জিয়া-এরশাদ রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করে অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন।
পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির সবচেয়ে ভয়ংকর যে অভিঘাত, সেটি হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর অরাজনৈতিক কর্তৃত্ব। সেই কর্তৃত্ব কখনো এসেছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে, নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের কথায়ই আস্থা রাখছেন, বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করছেন। জনগণ ও জনমত দুটোই উপেক্ষিত থাকছে। আমাদের রাজনীতিকেরাও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং থাকার জন্য দেশি-বিদেশি শক্তির কাছে ধরনা দিচ্ছেন। অতএব, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাইরের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ ১৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনীতির আরেক অভিঘাত হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। কেউ নিজেকে ভারতপন্থী, কেউ আমেরিকাপন্থী, কেউ সৌদি বা পাকিস্তানপন্থী প্রমাণের চেষ্টায় রত।
শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাঁর সহযাত্রীরা কেউ উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে আসেননি। উত্তরাধিকারের রাজনীতিও পঁচাত্তর-পরবর্তী বৈশিষ্ট্য। যখন নীতি-আদর্শের ঘাটতি দেখা গেল, যখন নেতাদের মধ্যে কোন্দল চরমে পৌঁছাল, তখনই রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের পুনরাবির্ভাব ঘটল। সেটি কেবল আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে নয়, ছোট দলগুলো সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে।
পঁচাত্তরের আগের ও পরের রাজনীতির মধ্যে আরেকটি বড় পার্থক্য হলো, এখন ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা এ-দলে ও-দলে ভাগ হয়ে আছেন। অর্থ কেবল দলকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্রের নীতিকেও।
পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ওপর কেউ ছিল না। ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিতেন। এখন সিদ্ধান্ত আসে অজ্ঞাত স্থান থেকে, রাজনীতিকেরা অনেক কিছুই জানেন না, কী হচ্ছে। এসব কারণে এখনো শেখ মুজিব পাঠ জরুরি বলে মনে করি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments