গদ্যকার্টুন-মৃত্যু আমাকে নেবে, পার্লামেন্ট আমাকে নেবে না by আনিসুল হক
এই গল্পটা আগেও শুনিয়েছি, আবারও শোনাচ্ছি। আমাদের বাসায় একটা টিয়া পাখি ছিল। সে কথা বলতে পারত। বাড়িতে কেউ এলেই সে বলত, ‘মেহমান এসেছে, বসতে দাও।’ আমরা টিয়া পাখিটাকে খুব আদর করতাম। স্কুল থেকে এসে প্রথম কাজই ছিল টিয়া পাখিটার কাছে যাওয়া। তাকে লাল রঙের মরিচ খেতে দেওয়া।
সে বলত, ‘ধন্যবাদ। আরও দাও।’
একদিন রাতের বেলা। গ্রিল ভেঙে একটা চোর ঢুকে পড়ল আমাদের বাসায়। আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু টিয়া পাখিটা জেগে গিয়েছিল। সে বলল, ‘মেহমান এসেছে, বসতে দাও।’
আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে চোর। আমরা চোরটাকে জড়িয়ে ধরলাম। চি ৎ কার-চেঁচামেচিতে দারোয়ানেরা ছুটে এল। চোরটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। থানায় ফোন করে পুলিশ ডাকা হলো। পুলিশ এসে চোরটাকে ধরে নিয়ে গেল।
ছয় মাস পরে চোরটা ছাড়া পেল জেলখানা থেকে।
একদিন দুপুরবেলা। আমরা কেউ বাসায় ছিলাম না। চোরটা আমাদের বাসায় এসে ঢুকল বাড়ির পেছন দিয়ে, গ্রিল কেটে। টিয়া পাখিটাকে বের করল খাঁচা থেকে। সে পাখিটাকে পায়ে চেপে ধরে তার মাথাটা ঠেসে ধরল শানের মেঝেতে। একটা পাথরের ইয়া বড় টুকরা নিয়ে ঘা মারল পাখিটার মাথায়। পাখিটার মাথা গেল থেঁতলে। মগজ ছিটকে বেরিয়ে দেয়ালে গেঁথে রইল। চোরটা চলে গেল গ্রিলভাঙা পথ দিয়ে। আমরা ফিরে এসে দেখি, পাখিটা মরে পড়ে আছে। দেয়ালের গায়ে পাখিটার মগজ। থেঁতলানো মাথার পাশে রক্ত। আমরা কাঁদতে লাগলাম।
তাকে আমরা কবর দিয়েছি আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে। আমি রোজ ফুল দিয়ে আসি ওই পাখিটার কবরে।
কাল ঘুমের ঘোরে চমকে উঠেছি। শুনি পাখিটা বলছে, ‘মেহমান এসেছে, বসতে দাও।’ ঘুম ভেঙে গেলে বুঝি, স্বপ্ন দেখছিলাম। চোখের জল বাঁধ মানল না। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। বালিশ ভিজে যাচ্ছে। বাইরে বোধ হয় বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতিও আমার সঙ্গে কাঁদছে।
২
ওপরের গল্পটা বললাম আপনাদের মনটা আর্দ্র করে দেওয়ার জন্য। লেখকদের এই কৌশলগুলো জানা থাকে। তাঁরা লেখার মাধ্যমে পাঠককে হাসাতে পারেন, কাঁদাতেও পারেন। এই যে পাথর দিয়ে টিয়া পাখির মাথা থেঁতলে দেওয়ার ঘটনা, এটা পড়তে আমাদের কষ্ট হয়। এত নিষ্ঠুরতা আমরা সহ্য করতে পারি না।
এবার আরেকটা গল্প।
ছেলেটার নাম আনিস। সে এসেছে রংপুর থেকে। রংপুর কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকায় এসেছে কোথাও ভর্তি হবে বলে। জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছেলে। তার ইচ্ছা বুয়েটে ভর্তি হয়া। কিন্তু বুয়েটে বড় কঠিন প্রতিযোগিতা। হাজার হাজার ছেলে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫৫০ জন সুযোগ পাবে বুয়েটে। ছেলেটা ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছে কোচিং সেন্টারে। ঢাকায় সে থাকে একটা মেসে। একটা চারতলা বাড়ির অন্ধকার নিচতলায় তিনটা রুম, দুটো বাথরুম, রান্নাঘর, এক চিলতে বারান্দা। এটাই তাদের মেস। রায়েরবাজারের এক গলির ভেতরে। প্রতিটা রুমে তিনজন করে বোর্ডার থাকে। এক হাজার টাকায় কেনা চৌকির ওপরে আনিসের শয্যা। বেতের শেলফ কিনেছে। বইপত্র রাখতে হয়। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথের বই ছাড়াও তার বুকশেলফে শোভা পাচ্ছে কবিতার বই, গল্পের বই, প্রবন্ধ। ছেলেটার লেখালেখিরও বড় শখ। সে কবিতা পড়তে পছন্দ করে। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ ছেলেটার প্রিয় কবি।
ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সে নিজে কোচিং সেন্টারে যায়, আবার এরই মধ্যে সে টিউশনিও জোগাড় করে নিয়েছে। দুটো ছাত্রকে সে পড়ায়। একই বাড়ির দুই ভাই। তারা পড়ে ক্লাস নাইনে আর ক্লাস সেভেনে। অপু আর তপু। ওদের বোন আছে, অনন্যা। সে আইএসসি পড়ে। তার শিক্ষকের দরকার হয় না। অনন্যা নিজেই কোচিং সেন্টারে যায়। আনিসের খুব ইচ্ছা করে, অনন্যা তার কাছে এক-আধ দিন আসুক। এসে বলুক, ‘ডিনামিক্সের এই প্রবলেমটা সলভ করতে পারছি না। করে দেবেন একটু?’ আনিস নিশ্চয়ই তা করে দেবে। অনন্যাকে পড়ানোর জন্য সে অতিরিক্ত কোনো টাকা নেবে না।
বাড়িতে তার মা আছেন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ভাইয়েরা সবাই ছাত্র। মা-বাবার কাছ থেকে আনিস কোনো টাকা-পয়সা নেয় না। মাকে সে মাঝেমধ্যে মোবাইলে ফোন করে। মা তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বাবা, কেমন আছিস? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করিস? তোদের মেসে কে রাঁধে? বেটাছেলের রান্না খেতে পারিস? বাড়ির পেছনের গাছটার আম পাকল। তোর জন্য ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। ঈদে এলে খাবি। তুই না খুব পছন্দ করিস?’
আনিস চোখ মোছে। মা কথাটাই যে বড় মায়া দিয়ে তৈরি।
সেদিন সন্ধ্যা। আনিস জিগাতলা দিয়ে রায়েরবাজারের দিকে যাচ্ছে। হঠা ৎ করে হাইজ্যাকার হাইজ্যাকার বলে আওয়াজ। দৌড়াদৌড়ি। আনিস কিছু বুঝতে পারে না, সে কোন দিকে দৌড় দেবে। একটা ছেলে, হাতে একটা রিভলবার, গুলি ছুড়তে ছুড়তে এদিকেই আসছে। আনিস প্রাণভয়ে দৌড়াতে থাকে।
হঠা ৎ তার সামনে এসে থামে একটা টেম্পো। ওই যানবাহন থেকে নামে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ। তারা তাকে জাপটে ধরে।: ‘একটাকে ধরেছি।’ ওদিকে ওই রিভলবারধারীকেও ধরে ফেলা হয়েছে। তাকে জনতা মার দেওয়া শুরু করেছে। জনতা আনিসের কাছেও চলে এল। তাকে ঘিরে ধরল। বলল, ‘এরে ছাইড়া দেন। এরে মাইর দেওন লাগব। মাইরের ওপরে ওষুধ নাই। থানায় নিলেই তো জামিন পাইব। বাইরায়া আইয়া আবার ছিনতাই করব।’
আনিস প্রাণপণে বলছে, ‘শোনেন, আমি ছিনতাইকারী নই। আমি একজন ছাত্র। আমি বুয়েটে পড়ব বলে রংপুর থেকে এসেছি। আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছি।’ কে শোনে কার কথা। লাঠির বাড়ি এসে পড়ে মাথায়। আনিস মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মানুষ যেভাবে সাপ পিটিয়ে মারে, তেমনিভাবে মার খেতে থাকে আনিস। তার মাথার ঘিলু বেরিয়ে গেছে। সে তার মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করছে। মা বলেছেন, ‘ঈদে আয়, তোর জন্য ফ্রিজে আম রেখে দিয়েছি।’
এই গল্পটা তো হতে পারত আমারই জীবনের গল্প। আমার জন্ম যদি হতো ২৫ বছর পরে, তাহলে আমি তো বুয়েটে ভর্তির আগেই মারা যেতে পারতাম। ক্রসফায়ারে। গণপিটুনিতে। শুধু আমি কেন, আপনার-আমার ছেলে, ভাই, ভাগনে, আপনি, আমি নিজেই যেকোনো সময় গণপিটুনির শিকার হতে পারি। ক্রসফায়ারে মারা যেতে পারি।
এক টিয়া পাখির মৃত্যুর গল্প পড়েই যে-আপনি মন খারাপ করেছেন, গণপিটুনিতে মানুষের মৃত্যুর খবর সেই আপনি কীভাবে সহ্য করতে পারেন?
কবি আবুল হাসানের কবিতা আছে:
মৃত্যু আমাকে নেবে জাতিসংঘ আমাকে নেবে না, আমি তাই আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই, বন্ধুগণ ক্ষান্ত হোন, কী লাভ যুদ্ধ করে। ভ্রাতৃহত্যায় কী লাভ?
মাত্র ২৮ বছর বয়সে কবি আবুল হাসান মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যু তাঁকে নিয়েছে, কিন্তু আমরা ক্ষান্ত হইনি। আমরা মেরেই চলেছি। মানুষ হত্যা করে আমরা উল্লাস করছি। আমাদের পাপের পেয়ালা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠছে। এর পরিণতি ভালো হওয়ার নয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
একদিন রাতের বেলা। গ্রিল ভেঙে একটা চোর ঢুকে পড়ল আমাদের বাসায়। আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু টিয়া পাখিটা জেগে গিয়েছিল। সে বলল, ‘মেহমান এসেছে, বসতে দাও।’
আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে চোর। আমরা চোরটাকে জড়িয়ে ধরলাম। চি ৎ কার-চেঁচামেচিতে দারোয়ানেরা ছুটে এল। চোরটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। থানায় ফোন করে পুলিশ ডাকা হলো। পুলিশ এসে চোরটাকে ধরে নিয়ে গেল।
ছয় মাস পরে চোরটা ছাড়া পেল জেলখানা থেকে।
একদিন দুপুরবেলা। আমরা কেউ বাসায় ছিলাম না। চোরটা আমাদের বাসায় এসে ঢুকল বাড়ির পেছন দিয়ে, গ্রিল কেটে। টিয়া পাখিটাকে বের করল খাঁচা থেকে। সে পাখিটাকে পায়ে চেপে ধরে তার মাথাটা ঠেসে ধরল শানের মেঝেতে। একটা পাথরের ইয়া বড় টুকরা নিয়ে ঘা মারল পাখিটার মাথায়। পাখিটার মাথা গেল থেঁতলে। মগজ ছিটকে বেরিয়ে দেয়ালে গেঁথে রইল। চোরটা চলে গেল গ্রিলভাঙা পথ দিয়ে। আমরা ফিরে এসে দেখি, পাখিটা মরে পড়ে আছে। দেয়ালের গায়ে পাখিটার মগজ। থেঁতলানো মাথার পাশে রক্ত। আমরা কাঁদতে লাগলাম।
তাকে আমরা কবর দিয়েছি আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে। আমি রোজ ফুল দিয়ে আসি ওই পাখিটার কবরে।
কাল ঘুমের ঘোরে চমকে উঠেছি। শুনি পাখিটা বলছে, ‘মেহমান এসেছে, বসতে দাও।’ ঘুম ভেঙে গেলে বুঝি, স্বপ্ন দেখছিলাম। চোখের জল বাঁধ মানল না। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। বালিশ ভিজে যাচ্ছে। বাইরে বোধ হয় বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতিও আমার সঙ্গে কাঁদছে।
২
ওপরের গল্পটা বললাম আপনাদের মনটা আর্দ্র করে দেওয়ার জন্য। লেখকদের এই কৌশলগুলো জানা থাকে। তাঁরা লেখার মাধ্যমে পাঠককে হাসাতে পারেন, কাঁদাতেও পারেন। এই যে পাথর দিয়ে টিয়া পাখির মাথা থেঁতলে দেওয়ার ঘটনা, এটা পড়তে আমাদের কষ্ট হয়। এত নিষ্ঠুরতা আমরা সহ্য করতে পারি না।
এবার আরেকটা গল্প।
ছেলেটার নাম আনিস। সে এসেছে রংপুর থেকে। রংপুর কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকায় এসেছে কোথাও ভর্তি হবে বলে। জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছেলে। তার ইচ্ছা বুয়েটে ভর্তি হয়া। কিন্তু বুয়েটে বড় কঠিন প্রতিযোগিতা। হাজার হাজার ছেলে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫৫০ জন সুযোগ পাবে বুয়েটে। ছেলেটা ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছে কোচিং সেন্টারে। ঢাকায় সে থাকে একটা মেসে। একটা চারতলা বাড়ির অন্ধকার নিচতলায় তিনটা রুম, দুটো বাথরুম, রান্নাঘর, এক চিলতে বারান্দা। এটাই তাদের মেস। রায়েরবাজারের এক গলির ভেতরে। প্রতিটা রুমে তিনজন করে বোর্ডার থাকে। এক হাজার টাকায় কেনা চৌকির ওপরে আনিসের শয্যা। বেতের শেলফ কিনেছে। বইপত্র রাখতে হয়। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথের বই ছাড়াও তার বুকশেলফে শোভা পাচ্ছে কবিতার বই, গল্পের বই, প্রবন্ধ। ছেলেটার লেখালেখিরও বড় শখ। সে কবিতা পড়তে পছন্দ করে। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ ছেলেটার প্রিয় কবি।
ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সে নিজে কোচিং সেন্টারে যায়, আবার এরই মধ্যে সে টিউশনিও জোগাড় করে নিয়েছে। দুটো ছাত্রকে সে পড়ায়। একই বাড়ির দুই ভাই। তারা পড়ে ক্লাস নাইনে আর ক্লাস সেভেনে। অপু আর তপু। ওদের বোন আছে, অনন্যা। সে আইএসসি পড়ে। তার শিক্ষকের দরকার হয় না। অনন্যা নিজেই কোচিং সেন্টারে যায়। আনিসের খুব ইচ্ছা করে, অনন্যা তার কাছে এক-আধ দিন আসুক। এসে বলুক, ‘ডিনামিক্সের এই প্রবলেমটা সলভ করতে পারছি না। করে দেবেন একটু?’ আনিস নিশ্চয়ই তা করে দেবে। অনন্যাকে পড়ানোর জন্য সে অতিরিক্ত কোনো টাকা নেবে না।
বাড়িতে তার মা আছেন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ভাইয়েরা সবাই ছাত্র। মা-বাবার কাছ থেকে আনিস কোনো টাকা-পয়সা নেয় না। মাকে সে মাঝেমধ্যে মোবাইলে ফোন করে। মা তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বাবা, কেমন আছিস? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করিস? তোদের মেসে কে রাঁধে? বেটাছেলের রান্না খেতে পারিস? বাড়ির পেছনের গাছটার আম পাকল। তোর জন্য ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। ঈদে এলে খাবি। তুই না খুব পছন্দ করিস?’
আনিস চোখ মোছে। মা কথাটাই যে বড় মায়া দিয়ে তৈরি।
সেদিন সন্ধ্যা। আনিস জিগাতলা দিয়ে রায়েরবাজারের দিকে যাচ্ছে। হঠা ৎ করে হাইজ্যাকার হাইজ্যাকার বলে আওয়াজ। দৌড়াদৌড়ি। আনিস কিছু বুঝতে পারে না, সে কোন দিকে দৌড় দেবে। একটা ছেলে, হাতে একটা রিভলবার, গুলি ছুড়তে ছুড়তে এদিকেই আসছে। আনিস প্রাণভয়ে দৌড়াতে থাকে।
হঠা ৎ তার সামনে এসে থামে একটা টেম্পো। ওই যানবাহন থেকে নামে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ। তারা তাকে জাপটে ধরে।: ‘একটাকে ধরেছি।’ ওদিকে ওই রিভলবারধারীকেও ধরে ফেলা হয়েছে। তাকে জনতা মার দেওয়া শুরু করেছে। জনতা আনিসের কাছেও চলে এল। তাকে ঘিরে ধরল। বলল, ‘এরে ছাইড়া দেন। এরে মাইর দেওন লাগব। মাইরের ওপরে ওষুধ নাই। থানায় নিলেই তো জামিন পাইব। বাইরায়া আইয়া আবার ছিনতাই করব।’
আনিস প্রাণপণে বলছে, ‘শোনেন, আমি ছিনতাইকারী নই। আমি একজন ছাত্র। আমি বুয়েটে পড়ব বলে রংপুর থেকে এসেছি। আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছি।’ কে শোনে কার কথা। লাঠির বাড়ি এসে পড়ে মাথায়। আনিস মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মানুষ যেভাবে সাপ পিটিয়ে মারে, তেমনিভাবে মার খেতে থাকে আনিস। তার মাথার ঘিলু বেরিয়ে গেছে। সে তার মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করছে। মা বলেছেন, ‘ঈদে আয়, তোর জন্য ফ্রিজে আম রেখে দিয়েছি।’
এই গল্পটা তো হতে পারত আমারই জীবনের গল্প। আমার জন্ম যদি হতো ২৫ বছর পরে, তাহলে আমি তো বুয়েটে ভর্তির আগেই মারা যেতে পারতাম। ক্রসফায়ারে। গণপিটুনিতে। শুধু আমি কেন, আপনার-আমার ছেলে, ভাই, ভাগনে, আপনি, আমি নিজেই যেকোনো সময় গণপিটুনির শিকার হতে পারি। ক্রসফায়ারে মারা যেতে পারি।
এক টিয়া পাখির মৃত্যুর গল্প পড়েই যে-আপনি মন খারাপ করেছেন, গণপিটুনিতে মানুষের মৃত্যুর খবর সেই আপনি কীভাবে সহ্য করতে পারেন?
কবি আবুল হাসানের কবিতা আছে:
মৃত্যু আমাকে নেবে জাতিসংঘ আমাকে নেবে না, আমি তাই আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই, বন্ধুগণ ক্ষান্ত হোন, কী লাভ যুদ্ধ করে। ভ্রাতৃহত্যায় কী লাভ?
মাত্র ২৮ বছর বয়সে কবি আবুল হাসান মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যু তাঁকে নিয়েছে, কিন্তু আমরা ক্ষান্ত হইনি। আমরা মেরেই চলেছি। মানুষ হত্যা করে আমরা উল্লাস করছি। আমাদের পাপের পেয়ালা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠছে। এর পরিণতি ভালো হওয়ার নয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments