বিশেষ সাক্ষাৎকার-বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে আমরা অনেক সরে এসেছি by সালাহ্উদ্দীন আহমদ
সালাহ্উদ্দীন আহমদের জন্ম ফরিদপুরে ১৯২২ সালে। তিনি ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫৩ সালে। ১৯৬১ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৪৮ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৫৪ সালে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৭২ সালে তিনি চলে আসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকে ১৯৭৮ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মননশীল অনেক গ্রন্থের রচয়িতা অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো আগস্ট মাস এসে যখন জাতীয় শোক দিবস পালনের আয়োজন চলতে থাকে, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও কর্মের কোন দিকগুলো আপনার তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন যে প্রধান কারণে সেটি হলো এই যে, তাঁর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মানুষ, বাঙালি ও অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এটিই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান। তাঁর আগে এই ভূখণ্ডের মানুষের একক কোনো রাষ্ট্র ছিল না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শেরেবাংলা ফজলুল হক, নেতাজি সুভাষ বসু প্রমুখ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই এই ভূখণ্ডের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতিনির্বিশেষে সব সম্প্র্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের শেষে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি একক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এটিই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তাঁর ভুলত্রুটি-সীমাবদ্ধতা সবকিছু সত্ত্বেও শুধু এ কারণেই তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রথম আলো কী কারণে বা কিসের বলে তিনি এই ভূখণ্ডের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ প্রধান কারণ হচ্ছে, তিনি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে। ধর্মে ধর্মে বিভেদ-বিভাজন থাকলে তো সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি রাষ্ট্র গঠনের কাজে উদ্বুদ্ধ করা যায় না। তাঁর অনুপ্রেরণায় পূর্ববাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষ জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের কারণে। বঙ্গবন্ধু নিজে ধার্মিক ছিলেন, নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তিনি ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি। কারণ, আগে মুসলিম লীগের সময় ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো হয়েছিল বলে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। ওই বিভেদ চলতে থাকলে পূর্ব বাংলার সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু অভিজ্ঞতার আলোকে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন, ধর্ম ও রাজনীতিকে একত্র করলে, দুটোকে মিশিয়ে ফেললে ধর্ম ও রাজনীতি উভয়ই কলুষিত হয়।
প্রথম আলো এখন তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ছে, খোদ সংবিধানেই তার প্রতিফলন ঘটছে।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ আজ যখন আমরা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছি, শোক পালনের নানা আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি চলছে, তখন আমার ভাবতে বড় দুঃখ হয় যে বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ থেকে আমরা কত দূরে সরে গেছি। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তার ফলে আজ কী অবস্থা হয়েছে আমাদের! ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে। সাম্প্রদায়িকতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যেমন ধরুন, বিসমিল্লাহ বলে রাজনৈতিক বক্তব্য শুরু করা। এটা তো বঙ্গবন্ধুর সময় ছিল না। শুধু বঙ্গবন্ধুর সময় কেন, মুসলিম লীগের আমলেও ছিল না। জিন্নাহ সাহেব কোনো দিন বিসমিল্লাহ বলে বক্তব্য শুরু করতেন না। আমাদের শেরেবাংলা, সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব, এমনকি মওলানা ভাসানীও রাজনৈতিক বক্তব্য বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতেন না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেছিলেন ‘ভায়েরা আমার’ বলে। সেখানে হিন্দু, মুলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
প্রথম আলো স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু হলো কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ এটা শুরু হয়েছে পঁচাত্তরের পর থেকে। বিশেষ করে, জিয়াউর রহমান এটা শুরু করেন। সামরিক শাসকদের তো কোনো আদর্শিক ভিত্তি ছিল না। সুতরাং, ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে যদি জনগণের কিছুটা আস্থা অর্জন করা যায়—সেই চিন্তা থেকেই জিয়াউর রহমান, তারপর এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। এখন অবস্থা এমন হয়েছে, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সবাই বিসমিল্লাহ বলে বক্তব্য শুরু করছেন।
প্রথম আলো তাতে অসুবিধা কী? জনগণ পছন্দ করছে বলেই তো তাঁরা এটা করছেন।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ এর অসুবিধাটা হচ্ছে এই যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র নয়, এখানে অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষও আছে, তারাও এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ও মর্যাদার দাবিদার। রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পদে নিয়োজিত একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে কোন ধর্মের অনুসারী সেটি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়, কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় বিষয় নয়। মুসলমানরা এ দেশে সংখ্যায় বেশি বলেই তাদের ধর্ম রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে, তাদের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মকে খাটো করতে হবে—এটা গণতন্ত্র নয়। জন স্টুয়ার্ট মিলের একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের জবরদস্তি নয়। কোনো নাগরিকের যেন মনে না হয় তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো আচরণ করা হচ্ছে। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার ফলে অমুসলমান জনগোষ্ঠীর মনের অবস্থা কী হয়েছে, সেটিও তো আমরা বোঝার চেষ্টা করিনি। যে পাকিস্তান ভেঙে আমরা বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি, আমরা তো সেই পাকিস্তানের মতোই হয়ে গেলাম। এবং এটা ছিল সামরিক শাসকদের উদ্দেশ্য, বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানিয়ে ফেলা। আওয়ামী লীগ কেন এটা বুঝতে পারছে না, সেটা আমার বোধগম্য নয়। বঙ্গবন্ধুর ছবিতে ফুলের মালা দিয়ে তাঁর আদর্শের বিপরীত কাজ করা—এটাকে আমার স্ববিরোধিতা বলে মনে হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে যতই ছাড় দেওয়া হোক, পার পাওয়া যাবে না। আমার খুব আশঙ্কা হয় যে রাজনীতিতে ধর্মের এই ব্যবহার দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
প্রথম আলো ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি ছাড়া আর কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা স্বপ্ন থেকে দিকনির্দেশনা পেতে পারি, যা আমাদের বর্তমানের সমস্যা-সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল এমন একটি দেশ গড়ে তোলা, যেখানে সব মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাবে। মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল এটাই। এ জন্য প্রয়োজন সুশাসন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। এটা শুধু মুখে বললে হবে না, কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলতে হচ্ছে, লক্ষ্মীপুরের বিএনপির নেতার হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দিয়েছেন—এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আইনের শাসনের প্রতি বিরাট অবজ্ঞা প্রকাশিত হয়েছে এর মধ্য দিয়ে। এতে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থক অনেক মানুষের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া আমি লক্ষ করেছি। তাদের সমর্থক পত্রপত্রিকাও এর সমালোচনা করেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও ভীষণ মর্মাহত হয়েছি, আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এটি একটি উদাহরণ। তা ছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগের নামে যেসব উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে, সেসবও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীদের কাছে প্রত্যাশিত নয়। সুতরাং, শক্ত হাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটা বিষয় আগেও আমি বলার চেষ্টা করেছি, রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে, তখন দলের নেতারা মন্ত্রিত্বসহ বড় বড় সরকারি পদ গ্রহণ করেন। এর ফলে জনগণ থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। দলের কাজ হচ্ছে সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতু রচনা করা। দল কাজ করবে সরকারের ওয়াচডগ হিসেবে। সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণ কীভাবে প্রতিক্রিয়া করছে, দলের নেতারা সেটা সরকারকে জানাবেন, সরকার সেভাবে কাজ করার চেষ্টা করবে। দল শুধু দলীয় কর্মী-সমর্থকদের স্বার্থ দেখবে না, দেশের সব মানুষের স্বার্থ দেখবে, সেই অনুযায়ী সরকারকে পরামর্শ দেবে। কিন্তু এটা করা হয় না। এখনো সময় আছে। দেশের প্রকৃত অবস্থা, জনগণের প্রকৃত মনোভাব দলের নেতারা সরকারকে জানাবেন।
প্রথম আলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বা আদর্শ, বাহাত্তরের সংবিধানে যে সমাজতন্ত্রের কথা লেখা হয়েছিল, সেই দিকটা সম্পর্কে কিছু বলবেন? ধনী-গরিবে বৈষম্য তো আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের মতো ব্যবস্থা বোঝানো হয়নি, মানুষের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার বোঝানো হয়েছে। লক্ষ্য ছিল মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা। কিন্তু এই সমাজতন্ত্রকে তো আমরা এক কলমের খোঁচায় বাদ দিলাম। দেশে আজ ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য যে ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে, তা এককথায় অমানবিক। বিপুলসংখ্যক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন এটা ছিল না, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এটা ছিল না। অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তাই আমাদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বিসর্জন দিলে চলবে না। বঙ্গবন্ধু বলতেন, সমাজতন্ত্র হচ্ছে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে গেলে তাঁর এই আদর্শও স্মরণ করতে হবে।
প্রথম আলো প্রচুর রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এবার জননেতা থেকে রাষ্ট্রনেতা হয়েছেন, জাতিগঠন ও দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি যে সামান্য সময়টুকু পেয়েছেন, সে সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে কি আমাদের কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ হ্যাঁ, সেটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। সে সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। আমার মনে হয়, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী করা বঙ্গবন্ধুর একটা বড় ভুল ছিল। তিনি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা থেকে সরে যাওয়া ঠিক হয়নি। দেশের পরিস্থিতি তখন বেশ জটিল ছিল, শক্তিশালী সরকারের প্রয়োজন ছিল—এসবই সত্য, কিন্তু সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যেত, সংবিধান সংশোধন করা ঠিক হয়নি। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছিলেন, বাকশাল গঠন করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা তাঁর জন্য স্ববিরোধী কাজ হয়েছে। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। আমার কাছে যখন বাকশালে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব এল, আমি সম্মত হইনি। এসব সত্ত্বেও তিনি বিকেন্দ্রীকরণের যে কাজ শুরু করেছিলেন, যা সম্পন্ন করার সময়-সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয়নি, সেটি ছিল একটি বড় কাজ।
প্রথম আলো পরিশেষে, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে আপনি কী বলবেন?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ প্রতিকৃতিতে ফুলের মালা দিয়ে, শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কোনো অর্থ নেই, যদি আমরা তাঁর আদর্শগুলো মনে না রাখি, যদি তাঁর স্বপ্ন-আদর্শ থেকে সরে যাই।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো আগস্ট মাস এসে যখন জাতীয় শোক দিবস পালনের আয়োজন চলতে থাকে, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও কর্মের কোন দিকগুলো আপনার তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন যে প্রধান কারণে সেটি হলো এই যে, তাঁর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মানুষ, বাঙালি ও অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এটিই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান। তাঁর আগে এই ভূখণ্ডের মানুষের একক কোনো রাষ্ট্র ছিল না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শেরেবাংলা ফজলুল হক, নেতাজি সুভাষ বসু প্রমুখ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই এই ভূখণ্ডের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতিনির্বিশেষে সব সম্প্র্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের শেষে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি একক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এটিই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তাঁর ভুলত্রুটি-সীমাবদ্ধতা সবকিছু সত্ত্বেও শুধু এ কারণেই তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রথম আলো কী কারণে বা কিসের বলে তিনি এই ভূখণ্ডের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ প্রধান কারণ হচ্ছে, তিনি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে। ধর্মে ধর্মে বিভেদ-বিভাজন থাকলে তো সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি রাষ্ট্র গঠনের কাজে উদ্বুদ্ধ করা যায় না। তাঁর অনুপ্রেরণায় পূর্ববাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষ জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের কারণে। বঙ্গবন্ধু নিজে ধার্মিক ছিলেন, নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তিনি ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি। কারণ, আগে মুসলিম লীগের সময় ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো হয়েছিল বলে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। ওই বিভেদ চলতে থাকলে পূর্ব বাংলার সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু অভিজ্ঞতার আলোকে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন, ধর্ম ও রাজনীতিকে একত্র করলে, দুটোকে মিশিয়ে ফেললে ধর্ম ও রাজনীতি উভয়ই কলুষিত হয়।
প্রথম আলো এখন তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ছে, খোদ সংবিধানেই তার প্রতিফলন ঘটছে।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ আজ যখন আমরা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছি, শোক পালনের নানা আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি চলছে, তখন আমার ভাবতে বড় দুঃখ হয় যে বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ থেকে আমরা কত দূরে সরে গেছি। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তার ফলে আজ কী অবস্থা হয়েছে আমাদের! ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে। সাম্প্রদায়িকতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যেমন ধরুন, বিসমিল্লাহ বলে রাজনৈতিক বক্তব্য শুরু করা। এটা তো বঙ্গবন্ধুর সময় ছিল না। শুধু বঙ্গবন্ধুর সময় কেন, মুসলিম লীগের আমলেও ছিল না। জিন্নাহ সাহেব কোনো দিন বিসমিল্লাহ বলে বক্তব্য শুরু করতেন না। আমাদের শেরেবাংলা, সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব, এমনকি মওলানা ভাসানীও রাজনৈতিক বক্তব্য বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতেন না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেছিলেন ‘ভায়েরা আমার’ বলে। সেখানে হিন্দু, মুলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
প্রথম আলো স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু হলো কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ এটা শুরু হয়েছে পঁচাত্তরের পর থেকে। বিশেষ করে, জিয়াউর রহমান এটা শুরু করেন। সামরিক শাসকদের তো কোনো আদর্শিক ভিত্তি ছিল না। সুতরাং, ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে যদি জনগণের কিছুটা আস্থা অর্জন করা যায়—সেই চিন্তা থেকেই জিয়াউর রহমান, তারপর এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। এখন অবস্থা এমন হয়েছে, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সবাই বিসমিল্লাহ বলে বক্তব্য শুরু করছেন।
প্রথম আলো তাতে অসুবিধা কী? জনগণ পছন্দ করছে বলেই তো তাঁরা এটা করছেন।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ এর অসুবিধাটা হচ্ছে এই যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র নয়, এখানে অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষও আছে, তারাও এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ও মর্যাদার দাবিদার। রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পদে নিয়োজিত একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে কোন ধর্মের অনুসারী সেটি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়, কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় বিষয় নয়। মুসলমানরা এ দেশে সংখ্যায় বেশি বলেই তাদের ধর্ম রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে, তাদের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মকে খাটো করতে হবে—এটা গণতন্ত্র নয়। জন স্টুয়ার্ট মিলের একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের জবরদস্তি নয়। কোনো নাগরিকের যেন মনে না হয় তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো আচরণ করা হচ্ছে। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার ফলে অমুসলমান জনগোষ্ঠীর মনের অবস্থা কী হয়েছে, সেটিও তো আমরা বোঝার চেষ্টা করিনি। যে পাকিস্তান ভেঙে আমরা বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি, আমরা তো সেই পাকিস্তানের মতোই হয়ে গেলাম। এবং এটা ছিল সামরিক শাসকদের উদ্দেশ্য, বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানিয়ে ফেলা। আওয়ামী লীগ কেন এটা বুঝতে পারছে না, সেটা আমার বোধগম্য নয়। বঙ্গবন্ধুর ছবিতে ফুলের মালা দিয়ে তাঁর আদর্শের বিপরীত কাজ করা—এটাকে আমার স্ববিরোধিতা বলে মনে হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে যতই ছাড় দেওয়া হোক, পার পাওয়া যাবে না। আমার খুব আশঙ্কা হয় যে রাজনীতিতে ধর্মের এই ব্যবহার দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
প্রথম আলো ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি ছাড়া আর কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা স্বপ্ন থেকে দিকনির্দেশনা পেতে পারি, যা আমাদের বর্তমানের সমস্যা-সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল এমন একটি দেশ গড়ে তোলা, যেখানে সব মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাবে। মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল এটাই। এ জন্য প্রয়োজন সুশাসন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। এটা শুধু মুখে বললে হবে না, কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলতে হচ্ছে, লক্ষ্মীপুরের বিএনপির নেতার হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দিয়েছেন—এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আইনের শাসনের প্রতি বিরাট অবজ্ঞা প্রকাশিত হয়েছে এর মধ্য দিয়ে। এতে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থক অনেক মানুষের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া আমি লক্ষ করেছি। তাদের সমর্থক পত্রপত্রিকাও এর সমালোচনা করেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও ভীষণ মর্মাহত হয়েছি, আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এটি একটি উদাহরণ। তা ছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগের নামে যেসব উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে, সেসবও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীদের কাছে প্রত্যাশিত নয়। সুতরাং, শক্ত হাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটা বিষয় আগেও আমি বলার চেষ্টা করেছি, রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে, তখন দলের নেতারা মন্ত্রিত্বসহ বড় বড় সরকারি পদ গ্রহণ করেন। এর ফলে জনগণ থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। দলের কাজ হচ্ছে সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতু রচনা করা। দল কাজ করবে সরকারের ওয়াচডগ হিসেবে। সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণ কীভাবে প্রতিক্রিয়া করছে, দলের নেতারা সেটা সরকারকে জানাবেন, সরকার সেভাবে কাজ করার চেষ্টা করবে। দল শুধু দলীয় কর্মী-সমর্থকদের স্বার্থ দেখবে না, দেশের সব মানুষের স্বার্থ দেখবে, সেই অনুযায়ী সরকারকে পরামর্শ দেবে। কিন্তু এটা করা হয় না। এখনো সময় আছে। দেশের প্রকৃত অবস্থা, জনগণের প্রকৃত মনোভাব দলের নেতারা সরকারকে জানাবেন।
প্রথম আলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বা আদর্শ, বাহাত্তরের সংবিধানে যে সমাজতন্ত্রের কথা লেখা হয়েছিল, সেই দিকটা সম্পর্কে কিছু বলবেন? ধনী-গরিবে বৈষম্য তো আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের মতো ব্যবস্থা বোঝানো হয়নি, মানুষের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার বোঝানো হয়েছে। লক্ষ্য ছিল মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা। কিন্তু এই সমাজতন্ত্রকে তো আমরা এক কলমের খোঁচায় বাদ দিলাম। দেশে আজ ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য যে ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে, তা এককথায় অমানবিক। বিপুলসংখ্যক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন এটা ছিল না, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এটা ছিল না। অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তাই আমাদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বিসর্জন দিলে চলবে না। বঙ্গবন্ধু বলতেন, সমাজতন্ত্র হচ্ছে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে গেলে তাঁর এই আদর্শও স্মরণ করতে হবে।
প্রথম আলো প্রচুর রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এবার জননেতা থেকে রাষ্ট্রনেতা হয়েছেন, জাতিগঠন ও দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি যে সামান্য সময়টুকু পেয়েছেন, সে সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে কি আমাদের কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ হ্যাঁ, সেটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। সে সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। আমার মনে হয়, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী করা বঙ্গবন্ধুর একটা বড় ভুল ছিল। তিনি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা থেকে সরে যাওয়া ঠিক হয়নি। দেশের পরিস্থিতি তখন বেশ জটিল ছিল, শক্তিশালী সরকারের প্রয়োজন ছিল—এসবই সত্য, কিন্তু সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যেত, সংবিধান সংশোধন করা ঠিক হয়নি। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছিলেন, বাকশাল গঠন করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা তাঁর জন্য স্ববিরোধী কাজ হয়েছে। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। আমার কাছে যখন বাকশালে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব এল, আমি সম্মত হইনি। এসব সত্ত্বেও তিনি বিকেন্দ্রীকরণের যে কাজ শুরু করেছিলেন, যা সম্পন্ন করার সময়-সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয়নি, সেটি ছিল একটি বড় কাজ।
প্রথম আলো পরিশেষে, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে আপনি কী বলবেন?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ প্রতিকৃতিতে ফুলের মালা দিয়ে, শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কোনো অর্থ নেই, যদি আমরা তাঁর আদর্শগুলো মনে না রাখি, যদি তাঁর স্বপ্ন-আদর্শ থেকে সরে যাই।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments