সময়চিত্র-সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড: কেন বাড়ছে বিতর্ক by আসিফ নজরুল
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনায় তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আদালতের নির্দেশনায় এই হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত কিছু প্রতিবেদন ও বিরোধী দলের নেত্রীর মন্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন সম্মিলিতভাবে আদালতের নির্দেশনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
বিএনপির মহাসচিবও নির্দেশনা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছেন এবং এর প্রতিবাদ করেছেন।
আদালতের এই নির্দেশনা মানুুষের বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকারের বিষয় বলে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এর আগে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার, সংবাদপত্র ও বিরোধী দলের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে।
২.
সাগর-রুনির হূদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের পরের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার কঠিন, তবে তা অসম্ভব নয়। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা শেষ হওয়ার সময় পুলিশের আইজি জানালেন, মামলার তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবে কাউকে গ্রেপ্তার এখনো করা যাচ্ছে না। অনেকেই প্রথম হোঁচট খেলেন তখন। তবে এই মামলার তদন্ত সম্পর্কে আমার নিজের প্রথম সন্দেহ সৃষ্টি হয়, যখন পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন যে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না!
পৃথিবীর কোনো দেশে পুলিশি তদন্তের দায়িত্ব কখনোই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গ্রেপ্তার করা নয়। এত নিশ্চিত হয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বিচারের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে মুক্ত হয়ে আসত না (বাংলাদেশে এই হার প্রায় ৮০ শতাংশ)। পুলিশ তাই বলে কোনো রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করবে, এটাও আইনের নির্দেশ নয়। আমাদের অপরাধ আইন ও পুলিশি বিধি অনুসারে পুলিশ প্রাথমিক প্রমাণ পেলে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে, এমনকি কেবল সন্দেহের কারণেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। পুলিশ বহু ক্ষেত্রে তা করে থাকে, বাংলাদেশে গ্রেপ্তারের শিকার হয় এমনকি জাজ্বল্যমান নিরপরাধ ব্যক্তিরাও। যে দেশে অসংখ্য নিরপরাধ ব্যক্তি গ্রেপ্তার হন, সেখানে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গ্রেপ্তার করতে চাচ্ছে পুলিশ—এই বক্তব্য তাই কিছুটা সন্দেহজনক ছিল।
তদন্ত সম্পর্কে আরও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে। তদন্ত শেষের আগেই তিনি বললেন, ‘সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে জামায়াত-শিবির জড়িত!’ আমরা অবাক হয়ে ভাবলাম: তাঁরই অধীনে চাকরিরত পুলিশ তাহলে ‘জামায়াত-শিবির’কে গ্রেপ্তার করছে না কেন? আর তাঁর বক্তব্য সত্য না হলে এটি কি তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার কোনো আলামত ছিল?
তদন্তকালে এ দেশে পুলিশি ঘাপলার সুদীর্ঘকালের প্রেক্ষাপট, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে মন্ত্রী-পুলিশের বিভিন্নমুখী বক্তব্য আর প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তদারকির পরও যদি তদন্তের শ্লথগতি থাকে, তাহলে মানুষের সন্দেহ আর ক্ষোভ থাকবেই। এমন পরিস্থিতিতে মামলার তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে গুজব, অপসাংবাদিকতা, অনুমানভিত্তিক খবর ছাপা হতে পারে। এসব সংবাদ অবশ্যই নিন্দনীয়, কিন্তু এর সুযোগ করে দেওয়ার দায় কিছুটা হলেও বর্তমান সরকারের। সরকারপক্ষে অস্বচ্ছতা, বিভ্রান্তি ও পরস্পরবিরোধিতা থাকলে অনুমাননির্ভর ও সন্দিহান সাংবাদিকতা হওয়ার নজির উন্নত বিশ্বেও রয়েছে। সাগর-রুনির ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে।
৩.
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে নিয়ে অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন মন্তব্য করে বসেন আমাদের দুই নেত্রীও। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সাগর-রুনির মামলার তদারক করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তাঁর কোনো মন্তব্য তাই আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সবার কাছে। বিভিন্ন আশ্বাসের পরও যখন তদন্তে কোনো সুরাহা হচ্ছে না, বীভৎস এই হত্যাকাণ্ডের জন্য যখন মানুষের মনে অস্বস্তিকর নিরাপত্তাহীনতা গাঢ় হয়ে উঠছে, তখন প্রধানমমন্ত্রী বলে বসেন: ‘কারও বেডরুম পাহারা দেওয়া সরকারের কাজ না!’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সাধারণ মানুষকে কীভাবে আহত করেছে, মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ হয়েছে, তার কিছু বর্ণনা প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ কে এম জাকারিয়ার লেখায় আমরা পাই। আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর পরিচয় সুবিদিত। তাঁর মতো মানুষও এ মন্তব্য কতটা অপছন্দ করেছেন, তার বিবরণ সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর একটি লেখায় রয়েছে। লেখার একটি অংশে রয়েছে: ‘এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পুলিশ এখনো তদন্ত চালাচ্ছে। সুতরাং এ সম্পর্কে অনুমানমূলক বা গুজবনির্ভর কোনো আলোচনায় আমি যেতে চাই না। তবে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ‘বেডরুমে পাহারা দেওয়ার তুলনা টানা একেবারেই বেমানান। এটি একটি নির্দয় উক্তিও।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘যেকোনো সরকারের দায়িত্ব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধান। তা ঘরের বেডরুমেই হোক আর প্রকাশ্য রাজপথেই হোক। সব সময় এই নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হয় তা নয়। তাই বলে সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়িত্ব এড়াতে চাইলে বুঝতে হবে, সেই সরকার দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক অথবা অপারগ।’
অনেকে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন যে সরকার সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক নয়। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন বক্তব্যে ও তদন্তের গতিপ্রকৃতিতে এই বিশ্বাস কারও টলে গেলে তা-ও অস্বাভাবিক নয়। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিরোধী দলের নেত্রীর বক্তব্যে আমরা সরকারের প্রতি বিশ্বাসহীনতা দেখি। তবে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রকাশে সংযমবোধের পরিচয় দিতে পারেননি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেমন বায়বীয় উৎস থেকে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত উক্তি করেছেন, তিনিও স্রেফ গুজবনির্ভর হয়ে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। তাঁর মাপের নেতার মুখে এটি মানায় না, এটি দায়িত্বশীল কোনো বক্তব্যও নয়।
৪.
উচ্চ আদালতে গুজবনির্ভর সংবাদ ও খালেদা জিয়ার মন্তব্যের বিষয়টি তোলা হয়। রিট আবেদনকারী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য আদালতের নজরে আনেননি। শুনানিকালে অন্য একজন আইনজীবী মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন বক্তব্যের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন, কিন্তু আদালত রুল দেওয়ার সময় নির্দিষ্টভাবে শুধু খালেদা জিয়ার সমালোচনা করেছেন।
আদালত বলেন, ‘লালমনিরহাটে বিরোধীদলীয় নেতা যা বলেছেন, এর মাধ্যমে তিনি রায় দিয়ে দিয়েছেন। এ মন্তব্যের সমালোচনার ভাষা আমাদের নেই। এই বক্তব্য তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে। ব্রিটেন বা অন্য কোনো দেশে এ ধরনের মন্তব্য করলে জেলে যেতে হতো। ওই মন্তব্য শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই নয়, আদালত অবমাননার শামিল। কারণ, ওই ঘটনায় মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। আদালত আশা প্রকাশ করেন, বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনা করবেন।’
আদালতের এই প্রত্যাশার সঙ্গে আমরাও একমত। কিন্তু আমরা বুঝতে অক্ষম স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর (যাঁর অধীন পুলিশই হত্যাকাণ্ডটির তদন্ত করছে) বক্তব্য একই রকমভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং আদালত অবমাননার শামিল বলে বিবেচিত হলো না কেন? আমরা দেখেছি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে ‘রায়’ দিয়েছেন, সরকার ও বিরোধী দলের আরও অনেকেই এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন। সাধারণ বিচারবুদ্ধি বলে, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের বক্তব্য তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়াকে অন্যদের বক্তব্যের চেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। তাঁদের বক্তব্য একইভাবে আদালতের নজরে নেওয়া হলে এবং আদালতের একই রকম শক্ত ভাষার রুলিং পাওয়া গেলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ার পরিবেশ আরও বেশি করে সৃষ্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস।
উচ্চ আদালত তাঁর নির্দেশনায় বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ‘আরেক জজ মিয়া খুঁজছে পুলিশ’ ও ‘আরেক জজ মিয়া প্রস্তুত’ তদন্ত-প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে—এ ধরনের অনুমাননির্ভর সংবাদ প্রকাশ না করার বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নিতে তথ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের এই নির্দেশনার প্রতিবাদ করেছে সাংবাদিকদের প্রায় সব সংগঠন। তারা আদালতের নির্দেশনাকে অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলেছে। হাইকোর্ট তথ্যসচিবকে যে আদেশ দিয়েছেন, তা প্রকারান্তরে গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার আশঙ্কা তারা প্রকাশ করেছে। গতকাল সাংবাদিকেরা গণ-অনশন পালনের দিন বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোথাও গণমাধ্যমের কাজে আদালতের এ রকম হস্তক্ষেপের নজির নেই। আদালত কেন, কারও নির্দেশনা মেনে গণমাধ্যম দায়িত্ব পালন করবে না।’
আমরা জানি, দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা অনন্য ভূমিকা রেখেছে। এ জন্য কোনো কোনো সাংবাদিককে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে জনাব বুলবুলের প্রতিক্রিয়ার কারণ বোঝা সম্ভব। আমাদের সবার মনে থাকার কথা, সাংবাদিকতা দুই হাত খুলে লিখতে পেরেছেন বলেই বিএনপির আমলে জজ মিয়া আর শৈবাল সাহা পার্থ এবং বর্তমান আমলে কাদের আর লিমনের গ্রেপ্তার বা তদন্তের ঘাপলা উন্মোচিত হয়েছিল।
আমরা জানি, পৃথিবীর অন্য বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও কিছু কিছু অপসাংবাদিকতা হয়। সে রকম কিছু হলে তার বিচারের জন্য প্রেস কাউন্সিল রয়েছে। কিন্তু কোনটি অনুমাননির্ভর সংবাদ, তা নির্ণয় করার দায়িত্ব এবং সংবাদটি প্রকাশিত হতে না দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আমলার হাতে দিলে কখনোই আমরা সরকারগুলোর কোনো অপকর্মের হদিস পাব না। ‘জজ মিয়া’ তৈরি করার সম্ভাবনা বরং বাড়বে তাতে।
৫.
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে ধারাবাহিক বিতর্ক ও হতাশার মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সাংবাদিকদের ঐক্য-প্রক্রিয়া। বহু বছর পর বিভক্ত সাংবাদিক সংগঠনগুলো একসঙ্গে বসছে, কথা বলছে, কর্মসূচি দিচ্ছে। আমি তো বিশ্বাস করি, এই ঐক্য আবারও আগের মতো সুদৃঢ় হলে সব সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের সুবিচার হবে। এই ঐক্য অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সাংবাদিককে হত্যা করার বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত করার চেষ্টাও কেউ করতে পারবে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আদালতের এই নির্দেশনা মানুুষের বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকারের বিষয় বলে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এর আগে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার, সংবাদপত্র ও বিরোধী দলের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে।
২.
সাগর-রুনির হূদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের পরের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার কঠিন, তবে তা অসম্ভব নয়। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা শেষ হওয়ার সময় পুলিশের আইজি জানালেন, মামলার তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবে কাউকে গ্রেপ্তার এখনো করা যাচ্ছে না। অনেকেই প্রথম হোঁচট খেলেন তখন। তবে এই মামলার তদন্ত সম্পর্কে আমার নিজের প্রথম সন্দেহ সৃষ্টি হয়, যখন পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন যে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না!
পৃথিবীর কোনো দেশে পুলিশি তদন্তের দায়িত্ব কখনোই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গ্রেপ্তার করা নয়। এত নিশ্চিত হয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বিচারের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে মুক্ত হয়ে আসত না (বাংলাদেশে এই হার প্রায় ৮০ শতাংশ)। পুলিশ তাই বলে কোনো রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করবে, এটাও আইনের নির্দেশ নয়। আমাদের অপরাধ আইন ও পুলিশি বিধি অনুসারে পুলিশ প্রাথমিক প্রমাণ পেলে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে, এমনকি কেবল সন্দেহের কারণেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। পুলিশ বহু ক্ষেত্রে তা করে থাকে, বাংলাদেশে গ্রেপ্তারের শিকার হয় এমনকি জাজ্বল্যমান নিরপরাধ ব্যক্তিরাও। যে দেশে অসংখ্য নিরপরাধ ব্যক্তি গ্রেপ্তার হন, সেখানে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গ্রেপ্তার করতে চাচ্ছে পুলিশ—এই বক্তব্য তাই কিছুটা সন্দেহজনক ছিল।
তদন্ত সম্পর্কে আরও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে। তদন্ত শেষের আগেই তিনি বললেন, ‘সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে জামায়াত-শিবির জড়িত!’ আমরা অবাক হয়ে ভাবলাম: তাঁরই অধীনে চাকরিরত পুলিশ তাহলে ‘জামায়াত-শিবির’কে গ্রেপ্তার করছে না কেন? আর তাঁর বক্তব্য সত্য না হলে এটি কি তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার কোনো আলামত ছিল?
তদন্তকালে এ দেশে পুলিশি ঘাপলার সুদীর্ঘকালের প্রেক্ষাপট, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে মন্ত্রী-পুলিশের বিভিন্নমুখী বক্তব্য আর প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তদারকির পরও যদি তদন্তের শ্লথগতি থাকে, তাহলে মানুষের সন্দেহ আর ক্ষোভ থাকবেই। এমন পরিস্থিতিতে মামলার তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে গুজব, অপসাংবাদিকতা, অনুমানভিত্তিক খবর ছাপা হতে পারে। এসব সংবাদ অবশ্যই নিন্দনীয়, কিন্তু এর সুযোগ করে দেওয়ার দায় কিছুটা হলেও বর্তমান সরকারের। সরকারপক্ষে অস্বচ্ছতা, বিভ্রান্তি ও পরস্পরবিরোধিতা থাকলে অনুমাননির্ভর ও সন্দিহান সাংবাদিকতা হওয়ার নজির উন্নত বিশ্বেও রয়েছে। সাগর-রুনির ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে।
৩.
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে নিয়ে অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন মন্তব্য করে বসেন আমাদের দুই নেত্রীও। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সাগর-রুনির মামলার তদারক করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তাঁর কোনো মন্তব্য তাই আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সবার কাছে। বিভিন্ন আশ্বাসের পরও যখন তদন্তে কোনো সুরাহা হচ্ছে না, বীভৎস এই হত্যাকাণ্ডের জন্য যখন মানুষের মনে অস্বস্তিকর নিরাপত্তাহীনতা গাঢ় হয়ে উঠছে, তখন প্রধানমমন্ত্রী বলে বসেন: ‘কারও বেডরুম পাহারা দেওয়া সরকারের কাজ না!’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সাধারণ মানুষকে কীভাবে আহত করেছে, মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ হয়েছে, তার কিছু বর্ণনা প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ কে এম জাকারিয়ার লেখায় আমরা পাই। আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর পরিচয় সুবিদিত। তাঁর মতো মানুষও এ মন্তব্য কতটা অপছন্দ করেছেন, তার বিবরণ সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর একটি লেখায় রয়েছে। লেখার একটি অংশে রয়েছে: ‘এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পুলিশ এখনো তদন্ত চালাচ্ছে। সুতরাং এ সম্পর্কে অনুমানমূলক বা গুজবনির্ভর কোনো আলোচনায় আমি যেতে চাই না। তবে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ‘বেডরুমে পাহারা দেওয়ার তুলনা টানা একেবারেই বেমানান। এটি একটি নির্দয় উক্তিও।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘যেকোনো সরকারের দায়িত্ব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধান। তা ঘরের বেডরুমেই হোক আর প্রকাশ্য রাজপথেই হোক। সব সময় এই নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হয় তা নয়। তাই বলে সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়িত্ব এড়াতে চাইলে বুঝতে হবে, সেই সরকার দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক অথবা অপারগ।’
অনেকে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন যে সরকার সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক নয়। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন বক্তব্যে ও তদন্তের গতিপ্রকৃতিতে এই বিশ্বাস কারও টলে গেলে তা-ও অস্বাভাবিক নয়। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিরোধী দলের নেত্রীর বক্তব্যে আমরা সরকারের প্রতি বিশ্বাসহীনতা দেখি। তবে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রকাশে সংযমবোধের পরিচয় দিতে পারেননি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেমন বায়বীয় উৎস থেকে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত উক্তি করেছেন, তিনিও স্রেফ গুজবনির্ভর হয়ে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। তাঁর মাপের নেতার মুখে এটি মানায় না, এটি দায়িত্বশীল কোনো বক্তব্যও নয়।
৪.
উচ্চ আদালতে গুজবনির্ভর সংবাদ ও খালেদা জিয়ার মন্তব্যের বিষয়টি তোলা হয়। রিট আবেদনকারী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য আদালতের নজরে আনেননি। শুনানিকালে অন্য একজন আইনজীবী মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন বক্তব্যের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন, কিন্তু আদালত রুল দেওয়ার সময় নির্দিষ্টভাবে শুধু খালেদা জিয়ার সমালোচনা করেছেন।
আদালত বলেন, ‘লালমনিরহাটে বিরোধীদলীয় নেতা যা বলেছেন, এর মাধ্যমে তিনি রায় দিয়ে দিয়েছেন। এ মন্তব্যের সমালোচনার ভাষা আমাদের নেই। এই বক্তব্য তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে। ব্রিটেন বা অন্য কোনো দেশে এ ধরনের মন্তব্য করলে জেলে যেতে হতো। ওই মন্তব্য শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই নয়, আদালত অবমাননার শামিল। কারণ, ওই ঘটনায় মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। আদালত আশা প্রকাশ করেন, বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনা করবেন।’
আদালতের এই প্রত্যাশার সঙ্গে আমরাও একমত। কিন্তু আমরা বুঝতে অক্ষম স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর (যাঁর অধীন পুলিশই হত্যাকাণ্ডটির তদন্ত করছে) বক্তব্য একই রকমভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং আদালত অবমাননার শামিল বলে বিবেচিত হলো না কেন? আমরা দেখেছি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে ‘রায়’ দিয়েছেন, সরকার ও বিরোধী দলের আরও অনেকেই এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন। সাধারণ বিচারবুদ্ধি বলে, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের বক্তব্য তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়াকে অন্যদের বক্তব্যের চেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। তাঁদের বক্তব্য একইভাবে আদালতের নজরে নেওয়া হলে এবং আদালতের একই রকম শক্ত ভাষার রুলিং পাওয়া গেলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ার পরিবেশ আরও বেশি করে সৃষ্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস।
উচ্চ আদালত তাঁর নির্দেশনায় বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ‘আরেক জজ মিয়া খুঁজছে পুলিশ’ ও ‘আরেক জজ মিয়া প্রস্তুত’ তদন্ত-প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে—এ ধরনের অনুমাননির্ভর সংবাদ প্রকাশ না করার বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নিতে তথ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের এই নির্দেশনার প্রতিবাদ করেছে সাংবাদিকদের প্রায় সব সংগঠন। তারা আদালতের নির্দেশনাকে অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলেছে। হাইকোর্ট তথ্যসচিবকে যে আদেশ দিয়েছেন, তা প্রকারান্তরে গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার আশঙ্কা তারা প্রকাশ করেছে। গতকাল সাংবাদিকেরা গণ-অনশন পালনের দিন বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোথাও গণমাধ্যমের কাজে আদালতের এ রকম হস্তক্ষেপের নজির নেই। আদালত কেন, কারও নির্দেশনা মেনে গণমাধ্যম দায়িত্ব পালন করবে না।’
আমরা জানি, দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা অনন্য ভূমিকা রেখেছে। এ জন্য কোনো কোনো সাংবাদিককে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে জনাব বুলবুলের প্রতিক্রিয়ার কারণ বোঝা সম্ভব। আমাদের সবার মনে থাকার কথা, সাংবাদিকতা দুই হাত খুলে লিখতে পেরেছেন বলেই বিএনপির আমলে জজ মিয়া আর শৈবাল সাহা পার্থ এবং বর্তমান আমলে কাদের আর লিমনের গ্রেপ্তার বা তদন্তের ঘাপলা উন্মোচিত হয়েছিল।
আমরা জানি, পৃথিবীর অন্য বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও কিছু কিছু অপসাংবাদিকতা হয়। সে রকম কিছু হলে তার বিচারের জন্য প্রেস কাউন্সিল রয়েছে। কিন্তু কোনটি অনুমাননির্ভর সংবাদ, তা নির্ণয় করার দায়িত্ব এবং সংবাদটি প্রকাশিত হতে না দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আমলার হাতে দিলে কখনোই আমরা সরকারগুলোর কোনো অপকর্মের হদিস পাব না। ‘জজ মিয়া’ তৈরি করার সম্ভাবনা বরং বাড়বে তাতে।
৫.
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে ধারাবাহিক বিতর্ক ও হতাশার মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সাংবাদিকদের ঐক্য-প্রক্রিয়া। বহু বছর পর বিভক্ত সাংবাদিক সংগঠনগুলো একসঙ্গে বসছে, কথা বলছে, কর্মসূচি দিচ্ছে। আমি তো বিশ্বাস করি, এই ঐক্য আবারও আগের মতো সুদৃঢ় হলে সব সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের সুবিচার হবে। এই ঐক্য অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সাংবাদিককে হত্যা করার বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত করার চেষ্টাও কেউ করতে পারবে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments