ধর নির্ভয় গান-কুয়াশায় ঢাকা পড়বে অর্জন? by আলী যাকের

সরকার যেমন আমাদের কাছে দায়বদ্ধ তাদের সব প্রতিশ্রুতি পূরণে, আমরাও তেমনি সরকারের কাছে দায়বদ্ধ তাদের কৃত সব সুকর্মের স্বীকৃতি প্রদানে। আমাদের তরুণদের, প্রবীণদের এবং আপামর জনসাধারণের দায়িত্ব মুক্তির সপক্ষে সোচ্চার হওয়া।


আমাদের শহীদদের রক্তের প্রতিদান দিতে, আমাদের নির্যাতিত নারীদের সম্মান পুনর্বাসনে এই মুহূর্তে সোচ্চার হওয়া
আবার এসেছে স্বাধীনতার মাস। আবার এসেছে কিছু বিশেষ কথা বলার সময়। বসেছিলাম আমার পড়ার ঘরের জানালার পাশে। এই পহেলা মার্চের প্রত্যুষে। হঠাৎ করে বলা নেই, কওয়া নেই, কুয়াশায় ছেয়ে গেছে চারদিক। ঘন এই কুয়াশা কি কোনো ইঙ্গিত বহন করে তবে? আমাদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো, আমাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আমাদের অর্জন_ এসবই কি ঢেকে দিতে চায় এই ঘন কুয়াশা? আজ এই স্বাধীনতার মাসের সূচনায় কুয়াশার ধূম্রজাল কি তবে প্রতীকী অর্থে কোনো দুর্ভাবনা নিয়ে এলো আমাদের জন্য? এসব চিন্তা এসে দেখা দেয় মনে। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন আশাবাদী মানুষ। আমি আশাবাদী ছিলাম আমার যৌবনের উন্মেষ থেকে। আশাবাদী আছি এখনও। বলা যায়, এই আশাই আমায় দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে নতুন একটি দিন পরিক্রমায় উৎসাহ প্রদান করে। ইংরেজ কবি পিবি, শেলির একটি লাইন আমায় সর্বদাই এই আশাবাদে অনুপ্রেরণা জোগায়। লাইনটি হলো, 'শীত যদি আসেই, বসন্ত কি খুব বেশি দূরে থাকতে পারে?' আমরা সবাই জানি যে, প্রতীচ্যে শীতের তীব্রতা কত বেশি। শেলি যখন কবিতা লিখেছেন, তখন নিশ্চয়ই জীবনযাত্রার আধুনিক উপকরণগুলো আবিষ্কৃত হয়নি। অতএব, কাঠের আগুনে যে উষ্ণতা সম্ভব, তার সেঁক নিতে নিতে শীতের কাঁপনের মাঝেও শেলি নিশ্চয়ই দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন বসন্তের ফুটন্ত ফুলের সমাহার। যেন অনুভব করতে পারছিলেন সমাগত সূর্যের কিরণছটায় উষ্ণ পারিপাশর্ি্বকতাকে। আমিও কোনো দৈহিক অথবা মানসিক যন্ত্রণার দ্বারা কাতর না হওয়ারই চেষ্টা করে চলি নিরন্তর। মনকে বোঝাই, 'ওভ রিহঃবৎ পড়সবং, পধহ ংঢ়ৎরহম নব ভধৎ নবযরহফ?' এই মানসিকতা নিয়ে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি। বিজয়ী হয়েছি। সদ্য স্বাধীন দেশে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছি। '৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পরে ষড়যন্ত্রের সব জঞ্জাল দু'হাতে সরিয়ে সরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছি। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দুঃসাহসে হাত উদ্বেলিত করে প্রতিবাদ করেছি। মনে মনে বলেছি যদি শীত আসেই, বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে? এভাবেই সমাজ এগিয়ে গেছে, দেশ এগিয়ে গেছে। আমার সহকর্মী, সহযাত্রী এবং উত্তম অর্ধেক আমার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছে। আমরা বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে গেছি সেই অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে, যার চেতনায় স্নাত হয়ে এক সময় দেশকে স্বাধীন করার শপথ নিয়েছিলাম। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের সন্তানরাও স্বাধীনচেতা এবং আশাবাদী। কথাগুলো নিতান্ত ব্যক্তিগত শোনালেও এর তাৎপর্য সারাদেশের সব তরুণের ওপরই বর্তায়। বড় সুখী হই দেখে যে, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, আমার প্রিয় মাতৃভূমির অধিকাংশ তরুণ আজ স্বাধীন বাংলার জ্যোতিচ্ছটায় অনুপ্রাণিত। তারা সচেতন সেই মূল্যবোধ এবং চেতনা সম্পর্কে, যা নিয়ে তাঁদের পিতৃপুরুষরা অস্ত্র ধারণ করেছিল, বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছিল, জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল অকাতরে। তাদের অতি প্রিয় নারীগণ, তাদের ভগি্ন এবং তাদের মাতারা প্রচণ্ড অসম্মান এং অত্যাচারকে মেনে নিয়েছিল এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতার স্বার্থে। সম্প্রতি এই সাহসী তরুণরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে আবার। ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাদেরই পূর্ব প্রজন্মের মানুষদের মতো। যুদ্ধাপরাধ, সাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এদের দেখে বুকে বল হয়। ভরসা জাগে যে, অতীব ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র দিয়ে আমাদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে নস্যাৎ করে দিতে পারবে না কোনো অপশক্তি। যদিও আমরা জানি যে, যখন আমরা সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে শত্রুর মোকাবেলা করছিলাম, তখন থেকেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। সেই সূচনার সময় থেকেই বাংলাদেশের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে, এ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়ে, বামপন্থি রাজনীতির দোহাই দিয়ে, দেশে চরম অরাজকতার সৃষ্টি করে এবং সবশেষে এ দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে চেষ্টা করা হয়েছিল আরও একটি নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির। সেই চক্রান্তের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল কিছু স্বৈরাচারী ব্যক্তি, যারা মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মবেশে পাকিস্তানেরই পক্ষ অবলম্বন করেছিল। এরপর একটি যুগ চরম তমসায় নিমজ্জিত ছিলাম আমরা। আমাদের তরুণদের জানতে দেওয়া হয়নি আমাদের সত্য ইতিহাস। ক্রমে তারও পরবর্তী প্রজন্ম বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে। তথ্য মাধ্যমগুলো ঋদ্ধ হয়েছে সঠিক সংবাদ পরিবেশনার মাধ্যমে। আজ কড়ায় গণ্ডায় যুদ্ধ শেষের পাওনা পেতে চায় তরুণ প্রজন্ম। 'দিনে দিনে বহু জমে আছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।'
আজকাল পত্রপত্রিকা খুললেই কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রায়ই একটি অভিযোগ শুনি সেই তরুণ সম্প্রদায়ের কণ্ঠে, যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রত্যাখ্যান করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানি দালালদের এই গত নির্বাচনেই। আমাদের সন্তানরা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছেন আজকের সরকারকে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার কই? গণহত্যার শাস্তি কোথায়? সরকার নিশ্চয়ই তার নিজস্ব পন্থায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ওপরে যেমন রয়েছে দেশপ্রেমিকের চাপ, তেমনি স্বচ্ছতার প্রশ্নে বিদেশিদের চাপও তীব্র। এসব কিছুই মাথায় রেখে সঠিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এগোতে হবে সামনের দিকে। এরপর রয়েছে আরও বড় বিপদ। আমাদেরই দেশের কিছু রাজনৈতিক দল এই গোটা বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা নানা ধরনের আবদার শুরু করে দিয়েছে। কেউ বলছে, ৪০ বছরের মাথায় এসে পুরনো ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কেন? কেউ বলছে যে, যারা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, তারা নাকি আসলে যুদ্ধাপরাধী নয়। এই ধরনের যে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা, এর কারণ একটি। যে দাবি নিয়ে আজকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সোচ্চার হয়ে উঠেছে, সেই দাবির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা। ভুলে গেলে চলবে না যে, যারা এই ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত, যদিও তাদের অনেকেরই অতীত স্বচ্ছ নয়, তারা কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমাসীন। তাদের একটি ভোটব্যাংক আছে। অতএব, একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে সরকারকে এগিয়ে যেতে হয় অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে যে ষড়যন্ত্রের শুরু, সেটিকে যদি আমরা তাৎক্ষণিকভাবে নিবৃত্ত করতে পারতাম তাহলে হয়তো বিষয়টি অনেক সহজ হতো দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য। অতএব, যেসব তরুণ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, মনে করেন এ দেশে আইনের শাসন চলতে দিতে হবে, দাবি তোলেন যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবিলম্বে করা প্রয়োজন, তাদের উচিত সামনে এগিয়ে আসা। বিভিন্নভাবে অকল্যাণকামী রাজনীতিবিদদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, আমরা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ এই দেশটির বিরুদ্ধে কোনো ঘৃণ্য চক্রান্ত মেনে নেব না। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের কাছে অনুযোগ এবং সরকারকে সব বিষয়ে দায়ী করলেই কেবল চলবে না। বিষয়টি অত সহজ নয়। সরকার যেমন আমাদের কাছে দায়বদ্ধ তাদের সব প্রতিশ্রুতি পূরণে, আমরাও তেমনি সরকারের কাছে দায়বদ্ধ তাদের কৃত সব সুকর্মের স্বীকৃতি প্রদানে। আমাদের তরুণদের, প্রবীণদের এবং আপামর জনসাধারণের দায়িত্ব মুক্তির সপক্ষে সোচ্চার হওয়া। আমাদের শহীদদের রক্তের প্রতিদান দিতে, আমাদের নির্যাতিত নারীদের সম্মান পুনর্বাসনে এই মুহূর্তে সোচ্চার হওয়া। যারা যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে এমন দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা যাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং চেতনা প্রতিষ্ঠিত করে ভবিষ্যতে একটি উন্নয়নকামী, সবল এবং জঙ্গম বাংলাদেশকে আমরা গড়তে পারি। আজ আমি আমার এই নগণ্য কলামটি উৎসর্গ করি আমাদের উত্তর পুরুষদের, যারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই দেশটির অগ্রযাত্রার সব দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। কল্যাণ হোক সব মানুষের। জয় হোক বাংলাদেশের।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.