ইতিহাসের অন্য রকম-ঢাকা by আখতার হুসেন
ঢাকার ৪০০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে এই বই। এই বইয়ে সন্নিবেশিত ছবিগুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীও হয়ে গেছে সম্প্রতি। দ্বিভাষিক এই ছবির সংকলন ঢাকার অতীতকে জানতে সাহায্য করবে তার রূপ-রস-গন্ধসমেত।
ক্যামেরা বা ফটোগ্রাফির যুগান্তকারী আবিষ্কার যখন সাধিত হয়নি, তখন বিশ্বজুড়ে জয়জয়কার ছিল অঙ্কন বা চিত্রশিল্পীদেরই। ত্রয়োদশ থেকে শুরু করে অষ্টাদশ, এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় চিত্রশিল্পের ইতিহাস আমাদের সামনে এই সত্যকেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে তোলে যে, মানবসভ্যতার বহু প্রাচীন নিদর্শন বিলুপ্তির চির অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যেত চিত্রশিল্পী বা চিত্রকরের অস্তিত্ব যদি না থাকত এবং তাঁদের তুলি-কলম ও পেনসিলের শৈল্পিক ছোঁয়ায় যদি অঙ্কিত না হতো তখনকার ভূদৃশ্য, চলমান জীবনযাত্রার দিনানুদৈনিকতার ছবি। এই উচ্চারণ সমভাবে যেমন প্রযোজ্য বিশ্বের প্রধান সব দেশ ও মহাদেশের ক্ষেত্রে, তেমনি প্রযোজ্য অঞ্চল বা এলাকাবিশেষের ক্ষেত্রেও। একইভাবে আমরা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে নতুন করে গড়ে উঠতে থাকা ঢাকাকে আবিষ্কার করি কিছু বিদেশি এবং জনাকয়েক দেশি চিত্রকরের তুলি, কালি এবং পেনসিলের রং ও রেখার দৌলতে। খুঁজে পাই তার একটা কালপর্বের জীবনযাত্রার সচল ধারাপ্রবাহকে। শামীম আমিনুর রহমানের শিল্পীর চোখে ঢাকা ১৭৮৯-১৯৪৭ শিরোনামের চিত্রের সংকলন রাজধানী ঢাকা তো বটেই, পাশাপাশি একসময়ের বৃহত্তর ঢাকাকেও নতুন করে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে আমাদের।
মোগল মিনিয়েচার বা চিত্রকলার কথা বাদ দিলেও আঠারো শতকের প্রথম চতুর্থাংশে দিল্লি থেকে অনেক দূরবর্তী বাংলা প্রদেশের রাজধানী মুর্শিদাবাদে নবাবি দরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদী চিত্রকলার একটা পৃথক ধারা বা ঘরানা। অবশ্য মুর্শিদ কুলি খানের আমলে (১৭১৬-২৭) মুর্শিদাবাদে চিত্রকলার তেমন কোনো হদিস মেলে না। কারণটা মূলত মুর্শিদ কুলি খানের নিজের ধর্মের প্রতি গভীর আনুগত্য এবং বিলাসিতাশূন্য জীবনযাপন। তার পরও আমরা পাই তাঁর আমলের কিছু স্মরণীয় চিত্রকর্ম। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ভাগীরথী নদীর তীরে মুর্শিদ কুলী খানের দরবার অনুষ্ঠান’, ‘মুহররম মিছিল’ ও ‘খাজা খিজিরের উৎসব’ শিরোনামে কয়েকটি চিত্রকর্ম। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ক্লাইভ অ্যালবামের অংশ হিসেবে ছবিগুলো সংরক্ষিত। চিত্রগুলোর অঙ্কনরীতিতে মোগল শিল্পকলার বিকশিত রূপ এবং স্থানিক বা আঞ্চলিক রূপ প্রতিফলিত।
মুর্শিদাবাদ ঘরানার চিত্রকর্মের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে আলীবর্দি খান (১৭৪০-৫৬) ও তাঁর দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে। আলীবর্দি খানের সমসাময়িক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের বর্ণনা থেকে এসবের বিবরণ পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে এত কথা তোলা হলো এ কারণে যে, মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়বির কল্যাণে আমরা ঢাকার তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি স্থানবিশেষের বিবরণ পেলেও, পাচ্ছি না চিত্রকর্ম বা চিত্রকলার কোনো ধরনের বিবরণ। এ রীতিমতো এক ধাঁধার মতোই বিষয়। ইসলাম খান সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে ঢাকায় পা রাখলেও ঢাকাকে রাজধানীতে রূপান্তর করলেও ইংরেজ শাসকদের ঢাকায় আগমনের আগ পর্যন্ত আমরা ঢাকা নিয়ে কোনো স্থানীয় শিল্পীর আঁকা কোনো ধরনের চিত্রকর্মের সন্ধান পাই না বললেই চলে। লর্ড ক্লাইভের হাতে মুর্শিদাবাদের পতনের আগ পর্যন্ত অতিক্রান্ত প্রায় ১৪৫ বছর কালপরিসরে ঢাকায় এমন কী হয়েছিল, যার ফলে কোনো ধরনের চিত্রকর্মের মাধ্যমে ঢাকার জনজীবন, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের কোনো কিছুরই প্রতিফলন আমরা লক্ষ করার সুযোগ পাই না! আগেই বলেছি, এ এক বিরাট ধাঁধা। শামীম আমিনুর রহমান সম্ভবত এই আক্ষেপ মোচনের তাড়না থেকেই তাঁর অনুসন্ধানকর্মে ব্রতী হয়েছেন। তারই প্রামাণ্য, জ্বলজ্বলে সাক্ষ্য তাঁর সদ্য প্রকাশিত অ্যালবাম শিল্পীর চোখে ঢাকা ১৭৮৯-১৯৪৭।
এই অ্যালবামে জায়গা পাওয়া ছবিগুলোর কালানুক্রমিক বিন্যাস থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের এই ভূখণ্ডে, বিশেষত ঢাকায় বিদেশি শিল্পীদের—যাঁদের বেশির ভাগই ব্রিটিশ—পা পড়েছে পলাশীর পতনের ৩২ বছর পর থেকে। প্রমাণ ফ্রান্সিসকো রেনাল্ডির ১৭৮৯ সালে তেলরঙে আঁকা ‘আয়েশি ভঙ্গিতে মুসলিম নারী’ (ঢাকা) ছবিটি। হয়তো এর আগেও কোনো শিল্পী ছবি এঁকে থাকতে পারেন, কিন্তু তার সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
মজার ব্যাপার, এই অ্যালবামভুক্ত ছবিগুলোর বেশির ভাগই পেশাদার-অপেশাদার শিল্পীরা এঁকেছেন নানাবিধ প্রয়োজনের তাগিদে। শামীম আমিনুর রহমান আমাদের জানাচ্ছেন সে কথা ঠিক এভাবে, ‘সে সময় ব্রিটেনে ইংরেজ চিত্রশিল্পীদের ছবির বাজার ছিল বড় মন্দা। খোদ লন্ডনে ইংরেজ শিল্পীদের চেয়ে ইতালীয় চিত্রশিল্পীদের কদর ছিল অনেক বেশি। তেলরং বা জলরঙে আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ক্রেতা নেই, নেই প্রতিকৃতি শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকও।...হঠাৎ তাদের আশার আলো দেখাল ভারতবর্ষ।...রাজা-মহারাজার দেশ ভারত। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে প্রভূত পারিশ্রমিক আর অঢেল সম্পদ। ইউরোপের নানা দেশের চিত্রশিল্পীরা আশায় বুক বেঁধে জাহাজে চড়ে বসলেন।...ভারতে এসে অনেকেই বিপুল পারিশ্রমিকে দেশীয় রাজা-মহারাজা ও কোম্পানির বড় বড় সাহেবের প্রতিকৃতি এঁকে চললেন।’ তবে তাঁরা ‘উপেক্ষা করতে পারেননি এখানকার প্রকৃতি, ভাঙা ইমারত, নিসর্গের হাতছানি।’ এভাবেই তাঁদের অনেকের খোদ ঢাকা এবং বৃহত্তর ঢাকা জেলায় পদার্পণ।
স্থানীয় শিল্পীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁদের আঁকা ছবিও এই অ্যালবামে জায়গা করে নিয়েছে। যে কালে আঁকা হয়েছে এই ছবিগুলো, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আলম মুসাব্বিরের জলরঙে আঁকা যে কয়টি ছবি আমরা অ্যালবামে দেখার সুযোগ পাই, তাতে তাঁর কাজের ডিটেলস বা অনুপুঙ্খতায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এই গ্রন্থের সুবাদে মেহের বানু খানম নামের একজন মহিলা চিত্রশিল্পীর ছবিও দেখার প্রায় বিরল সুযোগ ঘটে। তিনি বিংশ শতাব্দীর শিল্পী। সম্ভবত তিনিই আমাদের প্রথম মুসলিম মহিলা চিত্রকর।
বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে কত নামের উল্লেখ করব! তাঁদের মধ্যে আছেন ফ্রান্সিসকো রেনাল্ডি, উইলিয়াম হজেস, জোহান জোফানি, টিলি কেটল, ওজিয়াস হামফ্রে, রবার্ট হোম, চার্লস ড’য়লি, জর্জ চিনারি, চার্লস পোট, ডি ফেবেক, ফিলিপস ও মোলসওয়ার্থ। সরকারি কর্মকর্তা অথচ ছবি আঁকিয়েদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জোসেফ স্কট, আর্থার ক্লে ও হেনরি ব্রিজেসের নাম। এ ছাড়া আছেন বেশ কজন দেশি ও অজ্ঞাত শিল্পী। তাঁদের ঢাকাকেন্দ্রিক সৃষ্টিকর্ম নিয়েই শিল্পীর চোখে ঢাকা ১৭৮৯-১৯৪৭ ।
ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে শামীম আমিনুর রহমান জানিয়েছেন, ‘জানা-অজানা নানা উৎস থেকে এই বইয়ের ছবিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। পুরোনো ছবির পাশাপাশি নতুন অনেক ছবি এতে আছে। তবে ৪০ থেকে ৪৫টি ছবি একেবারেই নতুন, যা এর আগে আর কোথাও দেখা যায়নি। এই প্রথমবারের মতো এ বইয়ের সুবাদে সেগুলো দেখা যাবে।’
এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছেন সাজ্জাদ শরিফ। বইটি প্রকাশের নেপথ্য-লক্ষ্যের জানান দিয়েছে তাঁর বিবৃত বয়ান। ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলামের ভূমিকা ঋদ্ধ করেছে এই সংকলনের মর্যাদাকে। খুবই সুলিখিত শামীম আমিনুর রহমানের ভূমিকাটিও। দ্বি-ভাষিক এই ছবির সংকলন ঢাকার অতীতকে আমাদের জানতে সাহায্য করবে তার রূপরসগন্ধসমেত।
শিল্পীর চোখে ঢাকা ১৭৮৯-১৯৪৭
লেখক: শামীম আমিনুর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা-গ্রামীণ ফোন, দাম: ১২০০ টাকা।
প্রাপ্তিস্থান: প্রথমা প্রকাশন, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।
এই অ্যালবামে ধরা পড়েছে একটি বিশাল ঐতিহাসিক কালপর্বের তথা ১৫৮ বছর সময়পরিসরের ঢাকার চালচিত্র। তার দিনানুদৈনিকতার সমাচার। এখানে অন্দরমহলে সুবেশী সুসজ্জিতা নারীর দর্শন যেমন মিলবে, তেমনি মিলবে লালবাগ দুর্গের তোরণ, বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী মসজিদ, মন্দির, ঢাকার অভ্যন্তরভাগে নৌ-চলাচলের দৃশ্য, ভগ্নপ্রায় সেতু, পাগলা পুল, ধোলাই খাল, চক ও হোসেনি দালান এবং বড় কাটরার দৃশ্য। পাশাপাশি দেখা মিলবে এ দেশীয় মুনশির সঙ্গে জজ কোরমান বার্ডের তেলচিত্র। ঢাকা যতই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে পা দিচ্ছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার পরিবর্তনের রূপটি। ঢাকার রেস গ্রুপের দৃশ্য, জলরঙে আঁকা ‘প্যানোরমা অব ঢাকা’ভুক্ত ছবিগুলো এবং বুড়িগঙ্গার তীরজুড়ে গড়ে ওঠা সুউচ্চ ভবনের সারি তো তারই জ্বলজ্বলে সাক্ষী। সে কালটি ছিল নারীদের অবরোধবাসিনী হয়ে থাকার কাল। অথচ উন্মুক্ত বাজারস্থলে আমরা দেখি পসরা বিক্রেতা নারীদের, ঈদের মিছিলেও দেখি তাদের প্রায় সমান অংশগ্রহণ, তাদের বেশভূষা, দেখি উটের সারি, হাতির মিছিল।
মোগল মিনিয়েচার বা চিত্রকলার কথা বাদ দিলেও আঠারো শতকের প্রথম চতুর্থাংশে দিল্লি থেকে অনেক দূরবর্তী বাংলা প্রদেশের রাজধানী মুর্শিদাবাদে নবাবি দরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদী চিত্রকলার একটা পৃথক ধারা বা ঘরানা। অবশ্য মুর্শিদ কুলি খানের আমলে (১৭১৬-২৭) মুর্শিদাবাদে চিত্রকলার তেমন কোনো হদিস মেলে না। কারণটা মূলত মুর্শিদ কুলি খানের নিজের ধর্মের প্রতি গভীর আনুগত্য এবং বিলাসিতাশূন্য জীবনযাপন। তার পরও আমরা পাই তাঁর আমলের কিছু স্মরণীয় চিত্রকর্ম। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ভাগীরথী নদীর তীরে মুর্শিদ কুলী খানের দরবার অনুষ্ঠান’, ‘মুহররম মিছিল’ ও ‘খাজা খিজিরের উৎসব’ শিরোনামে কয়েকটি চিত্রকর্ম। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ক্লাইভ অ্যালবামের অংশ হিসেবে ছবিগুলো সংরক্ষিত। চিত্রগুলোর অঙ্কনরীতিতে মোগল শিল্পকলার বিকশিত রূপ এবং স্থানিক বা আঞ্চলিক রূপ প্রতিফলিত।
মুর্শিদাবাদ ঘরানার চিত্রকর্মের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে আলীবর্দি খান (১৭৪০-৫৬) ও তাঁর দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে। আলীবর্দি খানের সমসাময়িক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের বর্ণনা থেকে এসবের বিবরণ পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে এত কথা তোলা হলো এ কারণে যে, মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়বির কল্যাণে আমরা ঢাকার তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি স্থানবিশেষের বিবরণ পেলেও, পাচ্ছি না চিত্রকর্ম বা চিত্রকলার কোনো ধরনের বিবরণ। এ রীতিমতো এক ধাঁধার মতোই বিষয়। ইসলাম খান সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে ঢাকায় পা রাখলেও ঢাকাকে রাজধানীতে রূপান্তর করলেও ইংরেজ শাসকদের ঢাকায় আগমনের আগ পর্যন্ত আমরা ঢাকা নিয়ে কোনো স্থানীয় শিল্পীর আঁকা কোনো ধরনের চিত্রকর্মের সন্ধান পাই না বললেই চলে। লর্ড ক্লাইভের হাতে মুর্শিদাবাদের পতনের আগ পর্যন্ত অতিক্রান্ত প্রায় ১৪৫ বছর কালপরিসরে ঢাকায় এমন কী হয়েছিল, যার ফলে কোনো ধরনের চিত্রকর্মের মাধ্যমে ঢাকার জনজীবন, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের কোনো কিছুরই প্রতিফলন আমরা লক্ষ করার সুযোগ পাই না! আগেই বলেছি, এ এক বিরাট ধাঁধা। শামীম আমিনুর রহমান সম্ভবত এই আক্ষেপ মোচনের তাড়না থেকেই তাঁর অনুসন্ধানকর্মে ব্রতী হয়েছেন। তারই প্রামাণ্য, জ্বলজ্বলে সাক্ষ্য তাঁর সদ্য প্রকাশিত অ্যালবাম শিল্পীর চোখে ঢাকা ১৭৮৯-১৯৪৭।
এই অ্যালবামে জায়গা পাওয়া ছবিগুলোর কালানুক্রমিক বিন্যাস থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের এই ভূখণ্ডে, বিশেষত ঢাকায় বিদেশি শিল্পীদের—যাঁদের বেশির ভাগই ব্রিটিশ—পা পড়েছে পলাশীর পতনের ৩২ বছর পর থেকে। প্রমাণ ফ্রান্সিসকো রেনাল্ডির ১৭৮৯ সালে তেলরঙে আঁকা ‘আয়েশি ভঙ্গিতে মুসলিম নারী’ (ঢাকা) ছবিটি। হয়তো এর আগেও কোনো শিল্পী ছবি এঁকে থাকতে পারেন, কিন্তু তার সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
মজার ব্যাপার, এই অ্যালবামভুক্ত ছবিগুলোর বেশির ভাগই পেশাদার-অপেশাদার শিল্পীরা এঁকেছেন নানাবিধ প্রয়োজনের তাগিদে। শামীম আমিনুর রহমান আমাদের জানাচ্ছেন সে কথা ঠিক এভাবে, ‘সে সময় ব্রিটেনে ইংরেজ চিত্রশিল্পীদের ছবির বাজার ছিল বড় মন্দা। খোদ লন্ডনে ইংরেজ শিল্পীদের চেয়ে ইতালীয় চিত্রশিল্পীদের কদর ছিল অনেক বেশি। তেলরং বা জলরঙে আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ক্রেতা নেই, নেই প্রতিকৃতি শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকও।...হঠাৎ তাদের আশার আলো দেখাল ভারতবর্ষ।...রাজা-মহারাজার দেশ ভারত। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে প্রভূত পারিশ্রমিক আর অঢেল সম্পদ। ইউরোপের নানা দেশের চিত্রশিল্পীরা আশায় বুক বেঁধে জাহাজে চড়ে বসলেন।...ভারতে এসে অনেকেই বিপুল পারিশ্রমিকে দেশীয় রাজা-মহারাজা ও কোম্পানির বড় বড় সাহেবের প্রতিকৃতি এঁকে চললেন।’ তবে তাঁরা ‘উপেক্ষা করতে পারেননি এখানকার প্রকৃতি, ভাঙা ইমারত, নিসর্গের হাতছানি।’ এভাবেই তাঁদের অনেকের খোদ ঢাকা এবং বৃহত্তর ঢাকা জেলায় পদার্পণ।
স্থানীয় শিল্পীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁদের আঁকা ছবিও এই অ্যালবামে জায়গা করে নিয়েছে। যে কালে আঁকা হয়েছে এই ছবিগুলো, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আলম মুসাব্বিরের জলরঙে আঁকা যে কয়টি ছবি আমরা অ্যালবামে দেখার সুযোগ পাই, তাতে তাঁর কাজের ডিটেলস বা অনুপুঙ্খতায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এই গ্রন্থের সুবাদে মেহের বানু খানম নামের একজন মহিলা চিত্রশিল্পীর ছবিও দেখার প্রায় বিরল সুযোগ ঘটে। তিনি বিংশ শতাব্দীর শিল্পী। সম্ভবত তিনিই আমাদের প্রথম মুসলিম মহিলা চিত্রকর।
বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে কত নামের উল্লেখ করব! তাঁদের মধ্যে আছেন ফ্রান্সিসকো রেনাল্ডি, উইলিয়াম হজেস, জোহান জোফানি, টিলি কেটল, ওজিয়াস হামফ্রে, রবার্ট হোম, চার্লস ড’য়লি, জর্জ চিনারি, চার্লস পোট, ডি ফেবেক, ফিলিপস ও মোলসওয়ার্থ। সরকারি কর্মকর্তা অথচ ছবি আঁকিয়েদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জোসেফ স্কট, আর্থার ক্লে ও হেনরি ব্রিজেসের নাম। এ ছাড়া আছেন বেশ কজন দেশি ও অজ্ঞাত শিল্পী। তাঁদের ঢাকাকেন্দ্রিক সৃষ্টিকর্ম নিয়েই শিল্পীর চোখে ঢাকা ১৭৮৯-১৯৪৭ ।
ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে শামীম আমিনুর রহমান জানিয়েছেন, ‘জানা-অজানা নানা উৎস থেকে এই বইয়ের ছবিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। পুরোনো ছবির পাশাপাশি নতুন অনেক ছবি এতে আছে। তবে ৪০ থেকে ৪৫টি ছবি একেবারেই নতুন, যা এর আগে আর কোথাও দেখা যায়নি। এই প্রথমবারের মতো এ বইয়ের সুবাদে সেগুলো দেখা যাবে।’
এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছেন সাজ্জাদ শরিফ। বইটি প্রকাশের নেপথ্য-লক্ষ্যের জানান দিয়েছে তাঁর বিবৃত বয়ান। ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলামের ভূমিকা ঋদ্ধ করেছে এই সংকলনের মর্যাদাকে। খুবই সুলিখিত শামীম আমিনুর রহমানের ভূমিকাটিও। দ্বি-ভাষিক এই ছবির সংকলন ঢাকার অতীতকে আমাদের জানতে সাহায্য করবে তার রূপরসগন্ধসমেত।
শিল্পীর চোখে ঢাকা ১৭৮৯-১৯৪৭
লেখক: শামীম আমিনুর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা-গ্রামীণ ফোন, দাম: ১২০০ টাকা।
প্রাপ্তিস্থান: প্রথমা প্রকাশন, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।
এই অ্যালবামে ধরা পড়েছে একটি বিশাল ঐতিহাসিক কালপর্বের তথা ১৫৮ বছর সময়পরিসরের ঢাকার চালচিত্র। তার দিনানুদৈনিকতার সমাচার। এখানে অন্দরমহলে সুবেশী সুসজ্জিতা নারীর দর্শন যেমন মিলবে, তেমনি মিলবে লালবাগ দুর্গের তোরণ, বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী মসজিদ, মন্দির, ঢাকার অভ্যন্তরভাগে নৌ-চলাচলের দৃশ্য, ভগ্নপ্রায় সেতু, পাগলা পুল, ধোলাই খাল, চক ও হোসেনি দালান এবং বড় কাটরার দৃশ্য। পাশাপাশি দেখা মিলবে এ দেশীয় মুনশির সঙ্গে জজ কোরমান বার্ডের তেলচিত্র। ঢাকা যতই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে পা দিচ্ছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার পরিবর্তনের রূপটি। ঢাকার রেস গ্রুপের দৃশ্য, জলরঙে আঁকা ‘প্যানোরমা অব ঢাকা’ভুক্ত ছবিগুলো এবং বুড়িগঙ্গার তীরজুড়ে গড়ে ওঠা সুউচ্চ ভবনের সারি তো তারই জ্বলজ্বলে সাক্ষী। সে কালটি ছিল নারীদের অবরোধবাসিনী হয়ে থাকার কাল। অথচ উন্মুক্ত বাজারস্থলে আমরা দেখি পসরা বিক্রেতা নারীদের, ঈদের মিছিলেও দেখি তাদের প্রায় সমান অংশগ্রহণ, তাদের বেশভূষা, দেখি উটের সারি, হাতির মিছিল।
No comments