আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬৫)-জীবনে প্রথম মৃত্যুভয় by আলী যাকের

এর পরের দিনই আমাদের বাড়ি থেকেই দেখা যায় ভৈরবের ব্রিজের ওপরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দুটি জেট নিচুতে নেমে গুলিবর্ষণ করছে। অল্প কিছুক্ষণ পরই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে ওঠে। যদিও ভৈরব আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। তবু ফাঁকা ময়দানের ওপর দিয়ে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায় তখন। আমরা আতঙ্কিত হই।


এর আগেই শুনেছিলাম, নৌকার ভেতরে থাকা অবস্থায়, চট্টগ্রামে স্বাধীনবাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে ভেসে আসে বিদ্রোহের ডাক। মেজর জিয়ার কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পাই। ইতিমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমাদের কিছু আত্মীয় এসে হাজির হয়। তাঁদের মুখে শুনতে পাই, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সেখানে মেজর খালেদ মোশাররফ ২৬ তারিখ সকাল থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। পরে এ-ও জানতে পারি যে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়ে মেজর শফিউল্লাহ্্র নেতৃত্বে একটি বাহিনী ময়মনসিংহে অবস্থান নেয়। এই খবরও আসে জয়দেবপুর থেকে প্রত্যাগত আমাদের পরিচিত এক গ্রামবাসীর সূত্রে। আমরা অনুমান করি, ওই ২৫ মার্চ রাতেই বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি সৈনিকরা পাকিস্তানি ছাউনি পরিত্যাগ করে বেরিয়ে এসে নিজেরাই যুদ্ধ শুরু করে। পরে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা নানা গ্রন্থ থেকে এই অনুমানের সত্যতা আমরা খুঁজে পাই।
মার্চের ৩০ থেকে এপ্রিলের ১১ তারিখ পর্যন্ত আমরা গ্রামে ছিলাম। ওই সময়ের মধ্যে আমরা বিভিন্ন দিকে খবরাখবর নিয়ে মনস্থির করি যে আমাদের মধ্যে কয়েকজন সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলায় চলে যাবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে আমরা পায়ে হেঁটে রওনা হই সীমান্তের পার্শ্ববর্তী একটি এলাকা 'বেজোড়া'র উদ্দেশ্যে। সেখানে আমার এক মধ্যবয়সী চাচাতো বোন এবং তাঁর স্বামী (ওই অঞ্চলের চেয়ারম্যান) বাস করতেন। আমরা গ্রামের কাঁচা রাস্তায়, ক্ষেতের আল পথে হেঁটে হেঁটে এসে পেঁৗছাই কোম্পানীগঞ্জ বাজারে। আমাদের গ্রাম থেকে এই বাজারের দূরত্ব আনুমানিক ১৬ কিলোমিটার। আমাদের দলে ছিলেন আমার বড় খালাতো বোন, তাঁর স্বামী (গোপালগঞ্জের একটি নির্বাচনী এলাকার এমএনএ, খায়ের সাহেব), তাঁদের তিন সন্তান, আমার ছোট বোন, তাঁর স্বামী ও এক কন্যা, মুনা এবং আমার তখনকার এক বন্ধু। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছিল আমার এক ভাগ্নে, যে থাকত রতনপুরেই। কোম্পানীগঞ্জ বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ ছিল। কেননা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালেদ মোশাররফের বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে প্রতিহত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাওয়ার সময় পথে জনসমাগম দেখলেই নির্বিচারে গুলি করত। আমরা একটি দোকানের ঝাঁপির ওপরে টোকা দিতেই ভেতর থেকে একজন কেউ জিজ্ঞেস করল, 'কে?' আমরা আমাদের বৃত্তান্ত বলার পর ঝাঁপিটা একটু ফাঁক করে সে আমাদের এ সব তথ্য দিয়েছিল। আমরা তার পরামর্শ চাইলাম রাস্তা পার হব কি না। বস্তুতপক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা সড়ক তখন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত রেখা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর অপর পারে যেতে পারলেই পাকিস্তানিদের আওতা থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমাদের কথা শুনে দোকানের মালিক বললেন, চেষ্টা করে দেখেন আর আল্লাহ, আল্লাহ করেন। তখন আমাদের ফিরে যাওয়া সত্যিই দুঃসাধ্য। এতগুলো বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এত পথ হেঁটে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া যে বিবেচনায় গ্রাম ছেড়েছি, যেকোনো সময় আমাদের গ্রামে পাকিস্তানিরা হানা দিতে পারে, সে ভয় তো রয়েই গেছে। অতএব আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যাই হোক না কেন রাস্তা আমাদের পার হতেই হবে। তখন এই মহাসড়কটি পরিচিত ছিল সিঅ্যান্ডবি সড়ক হিসেবে। আমরা ধীরে ধীরে ওই রাস্তার কাছাকাছি চলে গেলাম। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ কোথাও নেই। আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে সবাই সড়ক পার হব না। দফায়, দফায় পার হব। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি, আমার ভাগি্ন রুমা এবং ভাগ্নে শাকিলকে নিয়ে রাস্তা পেরুতে লাগলাম। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর হঠাৎ কানে এলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ছুটে আসা একটি জীপের আওয়াজ। আমি হিম হয়ে গেলাম। কোনোমতে রাস্তা পেরুলাম। ভাগ্নে-ভাগি্নর হাত দুটো আমার হাতে ধরা। জানি না কেন, ওদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি আমার চশমা ও ঘড়িটা খুলে আমার শার্টের পকেটে রেখেছিলাম। গোঁফধারী আমার বিশাল চেহারাটি দেখে এর আগে গ্রামের মধ্যে জমা হয়ে থাকা অনেকেই বলেছে, সিঅ্যান্ডবি রাস্তা পার হতে যেন সাবধান থাকি। আমাকে নাকি শেখ মুজিবের মতো দেখায়। অথচ গোঁফধারী আমার চেহারাটি কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর অমন চেহারার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার নয়। তবে আমার দৈর্ঘ্য ও চালচলনের সঙ্গে হয়তো বা তাঁর কিছু মিল ছিল। জিপটি ক্রমেই আমাদের কাছে এলো। আরো কাছে। জীবনে এই প্রথম আমার মধ্যে দেখা দিল মৃত্যু ভয়। মনে হলো এক্ষুণি আমাদের পিঠ ভেদ করে একরাশ গুলি বেরিয়ে যাবে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। আমার প্রয়াত মায়ের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি ফিসফিসিয়ে রুমা ও শাকিলকে বললাম একদম চুপচাপ থাক, ভয় পেও না। আমাদের পেছনে এসেই কয়েক মুহূর্তের জন্য জিপটা থেমে গেল। তারপর একটা হুংকার শুনলাম, 'যাও ভাগো।' বলেই জিপটা ভোঁ করে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গিয়ে আমাদের অদূরে গোমতী নদীর ওপরে একটি ব্রিজ পার হওয়ার সময় একরাশ গুলি ছুঁড়ল। বুঝলাম না, ফাঁকা গুলি করল, না কি কাউকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়েছিল। এক পাতি বক সেই গুলির শব্দে সচকিত হয়ে উড়ে গেল। আমি আমার ভাগ্নে-ভাগি্নর হাত ধরে আস্তে, আস্তে সামনে এগিয়ে চললাম। ততক্ষণে আমার আপা, দুলাভাই, তাদের ছোট সন্তান সোহেল এবং আমার ছোট বোন, বোনাই, তাদের সন্তান সোমা, আমার দিদির বড় মেয়ে মুনা এবং আমার বন্ধু রফিক রাস্তা পার হয়ে এপারে চলে এসেছে।
(চলবে.....)

No comments

Powered by Blogger.