সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড : ধামাচাপা নয়, বিচার চাই by মজুমদার জুয়েল

সাগর সরওয়ার ও রুনির হত্যাকাণ্ড আমার কাছে এক অবাক আর অবিশ্বাস করা সত্যের মতো। ওরা দুজন আমার প্রথম কলিগ ছিল। সাগর তখন পুরোদমে সাংবাদিক। কাজ করছে দৈনিক সংবাদে। রুনি সংবাদেরই জলসা পাতায় লিখত। আমিও তখনই সাংবাদিকতা শুরু করি। পেশাগত দিক দিয়ে সাগর আমার কিছুটা সিনিয়রও বটে।


তখন থেকেই ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। পরে রুনি চলে গেল এটিএনে আর সাগর ইত্তেফাকে। তারপর থেকে দেখা-সাক্ষাৎও কম হতো। দুজন বিয়ের দাওয়াত যখন দিল অবাকই হয়েছিলাম, তাই নাকি! বিয়ে করছো নাকি! মাঝে এটিএনে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছি সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে। নানা সময় কথা হতো। ইটিভিতে এসে রুনির ছোট ভাই নওশেরকে পেলাম কলিগ হিসেবে। ওর কাছ থেকে প্রায়ই খবর নিতাম-পেতাম। সাগরের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে প্রায় বছর তো হবেই, আর রুনির সঙ্গে কবে, মনে নেই।
সেদিন শনিবার সকালে বার্তা সম্পাদক হিসেবে অফিসেই ছিলাম আমি। ৭টার খবর শেষ হয়েছে মাত্র, হঠাৎ এটিএন বাংলার স্ক্রল দেখে কেমন যেন হিম হয়ে গেল গোটা শরীর। কিছুক্ষণ যেন সম্বিৎ ছিল না। বারবার স্ক্রলটি পড়ছি, 'সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হয়েছেন।' বিশ্বাস হচ্ছিল না, তাই কয়েকবার পড়লাম। নাইট রিপোর্টারকে ফোন করলাম, কী ব্যাপার? আসলে কী? ও বলল কিছু জানে না। পরে মামুন ভাইকে (জ ই মামুন) ফোন দিলাম। ভাই খবরটা আসলে কী, তিনিও বললেন, ডাকাতির ঘটনা সম্ভবত। কোনো প্রশ্ন খুঁজে পাচ্ছিলাম না, জিজ্ঞেস করলাম আপনারা কি যাচ্ছেন? তিনি বিরক্তই হলেন, আসলেই তো এটা একটা প্রশ্ন হলো? তারপর কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দিই। তড়িঘড়ি রিপোর্টার জোগাড় করে ঘটনাস্থলে পাঠাই, স্ক্রল দিই, ৯টার খবরে খবরটা জানাই দর্শকদের। কিন্তু খবরটা লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। এটা সাগর-রুনি না, অন্য কেউ। বারবার জিয়া খানকে ফোন দিই, জিয়া আসলে কী হয়েছে? কতটুকু জানলেন? ফুটেজ পাঠান। ছুটে যেতে চাইছিলাম বারবার, কিন্ত ওই বীভৎস দৃশ্য কি করে দেখব? ফুটেজটা অফিসে পেঁৗছানোর পর সত্যি সত্যিই দেখলাম, হ্যাঁ, সাগর-রুনিই তো। অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারলাম না। নীলাকে (আমার স্ত্রী) ফোন দিলাম, জান সাগর-রুনি খুন হয়েছে। ছুটির সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার কাছ থেকে এই কথা শুনে ও তো স্তব্ধ। সাগর-রুনিকে সেও চিনত খুব ভালো করেই। আঁতকে উঠে বলল, ওদের ছেলেটার কী খবর? আমারও তখনো মাথায় আসেনি মেঘের কথা। পরে খোঁজ নিয়ে যা জানলাম, তা সবাই এখন জানে। এর পর তো গেল কয়েকটা দিন।
সাংবাদিক সমাজ তো বটেই, গোটা দেশবাসী যেন হাঁ করে তাকিয়ে আছে পুলিশের দিকে, এই বুঝি জানা যাবে খুনিদের খবর। কিন্তু অবাক কাণ্ড স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টা, আইজিপির ঘটা ব্রিফিং কিছুতেই তো কোনো খবর নেই। রাস্তায় যে পাচ্ছে, সেই জানতে চাচ্ছে_কী হলো, কে করল? সঙ্গে সাবধান বাণী_'সাবধানে থাকবেন।' আরে সাগর, ওর মতো নম্র-ভদ্র, ভালো ছেলে হয় নাকি? ওকে কে খুন করবে? আর রুনি? আমাদের ছোট বোনটা সে কী দোষ করল? কিছুই মাথায় আসে না, কিছুই না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? আমাদের একটা ধারণা আছে, পুলিশ ইচ্ছে করলে সব পারে। আমাদের এখনো বদ্ধমূল ধারণা, আপনারা পেরেছেন। তা হলে কেন এই লুকোচুরি খেলা? প্লিজ বলুন না, কার ভয়ে আপনারা ভীত? আপনারা কি কারো মান-ইজ্জতের কথা ভাবছেন? দয়া করে ভাববেন না। কারণ খুনি খুনিই, সে যেই হোক, যতবড় মানুষই হোক। গোটা জাতি আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আপনারা রহস্য উন্মোচন করুন। বাতাসে নানা কথা ভেসে বেড়াচ্ছে, বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে একে ব্যাখ্যা করছেন, উষ্মা প্রকাশ করছেন। এসব গল্প বা উষ্মা_সব কিছুকে বিদায় জানাতে হবে জলদি, পারলে এই মুহূর্তে। নানা জায়গা থেকে নানা কথা শোনা যায়, অনেকে প্রশ্ন করেন, কি ভাই, জজ মিয়া গল্প সাজানোর চেষ্টা হচ্ছে নাকি? সত্যিই কি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে? আমরা সত্য জানতে চাই, তা আপনাদের কাছ থেকেই। সত্য অবশ্যই সত্য, এখানে কোনো রাখঢাক চলবে না। তাতে যদি সাগর বা রুনিরও এতটুকু দায় থেকে থাকে সেটা সহই আমরা জানতে চাই। কারণ যদি কোনোভাবে অপরাধীকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয় তা হলে জানবেন, অপরাধী নয় অপরাধকে জিইয়ে রাখা হলো। এই অপরাধ আরো খাবে অন্য কোনো সাগর-রুনিকে। তাই আর বোধ হয় দেরি করা ঠিক হবে না। জাতিকে সত্য জানান, মেঘকে তার মা-বাবার খুনিদের বিচার দেখতে দিন, আর আমাদের বাঁচান।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন

No comments

Powered by Blogger.