মিডিয়া ভাবনা-‘মানি না’ সংস্কৃতি থেকে বিএনপিকে বেরোতে হবে by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
রাজনীতির একটা বৈশিষ্ট্যই হলো বিরোধিতা করা ও অপর পক্ষের সমালোচনা করা। বিরোধিতা বা সমালোচনা না করলে তা আর রাজনীতি থাকে না। তবে এটাই রাজনীতির একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। রাজনীতি দেশপ্রেম, দেশের উন্নয়ন, সমাজসেবা ও নানা ইতিবাচক কাজের সমাহার। আন্তর্জাতিকভাবে এটাই রাজনীতির বৈশিষ্ট্য।
যদিও নানা কারণে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর বা আরও স্পষ্ট করে বললে ’৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর আমাদের দেশের প্রধান স্রোতের রাজনীতি এই ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে ফেলেছে।
বিএনপি এ দেশের একটি বড় ও জনপ্রিয় দল। তাদের বিরাট ভোট ব্যাংক রয়েছে। কখনো দলটি সরকার গঠন করে, কখনো বিরোধী দলে থাকে। যখন সরকার পরিচালনা করেছে, তখন তারা কী কী ভালো করেছে, কী কী খারাপ কাজ করেছে, তা দীর্ঘ আলোচনা ও গবেষণার বিষয় । আজ এই নিবন্ধে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করব।
বিএনপির মহা ভাগ্য যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার তিন বছরে নানা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের বেশ কিছু সাফল্য থাকলেও ব্যর্থতার পাল্লা এত ভারী যে জনগণ সাফল্যগুলোর কথা বিশেষ মনে রাখবে না। এটা জনগণের একটা বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনেও আমরা একজনের একটি দুর্বলতা খুঁজে পেলে সেটা নিয়ে সমালোচনা করতে বেশি পছন্দ করি। তার বাকি ১০টা গুণের কথা বিস্মৃত হই। রাজনৈতিক আলোচনা-সমালোচনায়ও আমরা সেটা দেখতে পাই। বিএনপি সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
আমাদের দেশে সচরাচর একই দলকে জনগণ পরপর দুবার সরকার গঠন করতে দেয় না। জনগণের এই বৈশিষ্ট্যও বিএনপির সহায়ক। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনেকের ধারণা, আগামী দুই বছরে সরকারের বড় নাটকীয় কোনো সাফল্য না এলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি বা চারদলীয় জোটের জেতার সম্ভাবনাই বেশি। একটি জাতীয় দৈনিক কয়েক দিন আগে রীতিমতো জরিপ করে একটা নির্বাচনী ফলও ঘোষণা করে দিয়েছে। যদিও এ রকম ধারণা বা জরিপ সব সময় সত্য হয় না। আবার সব সময় মিথ্যাও হয় না। কাজেই বিএনপির পক্ষে অনুকূল অনেক ঘটনাই ঘটছে। বিএনপিকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে ছাত্র লীগ ও শেয়ারবাজার।
কিন্তু এত অনুকূল পরিবেশ পেয়েও বিএনপি রাজনীতির মাঠে ঠিকভাবে খেলতে পারছে বলে মনে হয় না। রাজনীতির মাঠে খেলার মতো দক্ষ খেলোয়াড় বিএনপিতে কম বলেই মনে হয়। অথবা বিএনপির নীতি-নির্ধারণের দক্ষতার মধ্যেই হয়তো ঘাটতি রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্ব, কাঠামো, কর্মপদ্ধতি এমনই ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক যে খুব দক্ষ, আত্মসম্মানসম্পন্ন ব্যক্তি বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হতে চায় বলে মনে হয় না। বিএনপির রাজনীতির মধ্যেও রয়েছে নানা অসংগতি ও প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যানধারণা।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে দলটির নেতৃত্ব কত দুর্বল। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি আহূত সংলাপকে বিএনপি অন্যায়ভাবে সমালোচনা করেছে। সংলাপ হওয়ার আগেই তারা বলেছে, এটা লোক দেখানো। এতে জনমনে এমন ধারণা হতে পারে যে বিএনপি ভালো কিছুই সমর্থন করে না। সংলাপ অনুষ্ঠানে যদি বিএনপি তার বক্তব্য বলার সুযোগ না পেত তাহলে তারা পরে এর সমালোচনা করতে পারত। তবে বিএনপি সংলাপে গিয়ে খুব ভালো করেছে। বেগম খালেদা জিয়া সংলাপে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে আরও ভালো করেছেন। জনগণ এটা বেশ পছন্দ করেছে।
কিন্তু সংলাপ নিয়ে বিএনপি আগে ও পরে যা বলেছে তা মোটেও ঠিক হয়নি। এসব কথা বিএনপির রাজনীতির দেউলিয়াত্ত প্রমাণ করে। অনেকের কাছে মনে হয়েছে, বিএনপি বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করছে। যা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমর্থনযোগ্য নয়।
প্রথমে বিএনপি বলেছিল, ‘আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুর ফয়সালা হোক, তারপর নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গ আলোচনা করা যাবে।’ এটা যে একটা কুযুক্তি তা একজন স্কুলছাত্রও বুঝতে পারে। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ইস্যুটার প্রয়োজন হবে দুই বছর পর। আর ‘নির্বাচন কমিশন’ ইস্যুটি সমাধান করতে হবে এখনই। বিএনপির যুক্তি শুনে মনে হয়েছিল, তারা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন হোক তা চায় না। যাতে আরও একটা ইস্যু পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকার তো তাদের অপশাসনের মধ্য দিয়ে নানা ইস্যু প্রায় প্রতি সপ্তাহে বিএনপিকে দিচ্ছেই। জোর করে ইস্যু তৈরি করার দরকার কী!
রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যদি এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত শুনতে চান ও তাতে যদি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন থাকে তাহলে অসুবিধে কোথায়? আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়াই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। অতীতে কোনো সরকার এ রকম আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়নি। শুধু প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছায় ও পরামর্শে নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়া কি ভালো? বিএনপি এই পদ্ধতিকে যথাযথ বলে মনে করে? আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া বেঠিক মনে করে? অতীতে একক ইচ্ছায় ও পরামর্শে নির্বাচন কমিশন গঠন করে কী কী ঘটনা ঘটেছিল তা বিএনপি ভুলে গেলেও সচেতন জনগণ ভোলেনি। বিএনপি কি সে রকম একজন ‘আজিজ’ নিয়োগ হলে খুশি হতো? যাতে একটা ইস্যু করা যায়?
বিএনপি রাষ্ট্রপতির সংলাপে গিয়েছে কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে কোনো প্রস্তাব বা গঠনমূলক পরামর্শ দেয়নি। এর ফলে বিএনপি সম্পর্কে অনেকের ধারণা হতে পারে তারা গঠনমূলক কিছু করতে পারে না বা চায় না। বিএনপির কি এই সুযোগ নেওয়া উচিত ছিল না? তারা তাদের বিবেচনামতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন কমিশনারের নাম প্রস্তাব দিতে পারত। এমনও তো হতে পারত রাষ্ট্রপতি তাদের তালিকা থেকে একজন বা দুজন কমিশনার নিয়েছেন। যদি বিএনপি দলনিরপেক্ষ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করতে পারত।
বিএনপির সহযোগিতা ছাড়াই রাষ্ট্রপতি ‘নির্বাচন কমিশনে’ নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগ দেওয়া ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর কিছু করার ছিল না। কিন্তু নিয়োগ দানের দিনই বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা এই নিয়োগ মানে না। নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সরকারের তল্পিবাহক। তাঁদের তত্ত্বাবধানে কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না না। কেন? নতুন সিইসি ও কমিশনারদের অপরাধ কী তা তো বিএনপি বলেনি। তাদের ব্যাপারে বিএনপির সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে আগে তা বলা উচিত ছিল। তা না বলে সরাসরি তাদের প্রত্যাখ্যান করা কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। কাজে নামার আগে কমিশনকে অভিযুক্ত করে বিএনপি কাঁচা কাজ করেছে। তারা যে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করতে অভ্যস্ত তা আবার প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির নিজের কোনো পছন্দ নেই, রাষ্ট্রপতির পছন্দেরও বিরোধিতা করবেন, এটা মানা যায় না।
‘এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না’—এটা বলার পেছনেও বা বিএনপির যুক্তি কী? একটা নির্বাচন পরিচালনার পর এই কমিশনের দোষত্রুটি আগে চিহ্নিত হতে হবে—তার পরই ‘আর অংশ নেব না’ বলা যায়। তার আগে কি বলা যায়?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু বিএনপির একটি জনপ্রিয় দাবি। দেশের বহু মানুষ এই দাবি সমর্থন করে। এই দাবি নিয়ে বিএনপি গণ-আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু এই দাবির সঙ্গে অন্যান্য ইস্যু মেলানো ঠিক হচ্ছে না। অন্যান্য ইস্যু নিয়ে আবোল-তাবোল কথা বলে তারা প্রধান ইস্যুকেও হালকা করে ফেলছে। বিএনপির উচিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ইস্যু নিয়েই আন্দোলন গড়ে তোলা। অন্যান্য ইতিবাচক ইস্যুতে সরকারকে সহযোগিতা করা ভালো। এতে বিএনপির প্রতি জনমর্থন বাড়বে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতেও বিএনপি খুব স্পষ্ট অবস্থান না নিয়ে তাদের লাখ লাখ কর্মী ও সমর্থকদের হতাশ করেছে। জামায়াত অনুরাগী কিছু নেতা ও কর্মীর মন জোগাতে গিয়ে বিএনপি একটি জনপ্রিয় দাবির প্রতি সমর্থন দিতে দ্বিধা করছে। বরং কিছু নেতার বক্তব্যে মনে হয় তাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চান না। বিএনপিকে খুব গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে তারা স্পষ্টভাবে কী অবস্থান নেবে। বিচার কার্যকে সমর্থন করলে বিএনপির প্রতি বিমুখ হবে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। অপরদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বিরোধিতা করলে বা নীরব থাকলে বিমুখ হবে আওয়ামী লীগবিরোধী কিন্তু নির্দল জনগণ। বিমুখ হতে পারে দেশের ছাত্র-তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ। এই ইস্যুতে বিএনপি যদি শুধু ভোটকে বিবেচনায় নেয় তাহলে কোন পক্ষ বড় ‘ভোট ব্যাংক’ তা হিসাব করতে হবে।
তবে আমরা মনে করি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটি শুধু ভোট ব্যাংকের ইস্যু নয়। এটা নৈতিক ও আদর্শগত ইস্যু। বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে পারে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতে পারে না। কারণ, বিএনপি প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল। এই দলের মধ্যে রয়েছে অনেক নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। যারা আইনের বিচারে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণিত হবে তাদের রক্ষা করা বিএনপির দায়িত্ব হতে পারে না। বিএনপিকে বুঝতে হবে, দলের জন্য তারা বোঝা। যত দ্রুত সম্ভব এই বোঝা কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলা তাদের দলের জন্য উত্তম। আওয়ামী লীগ ও অন্য দলের মধ্যে যদি যুদ্ধাপরাধী লুকিয়ে থাকে তাদের কৃতকর্মের বিবরণসহ বিএনপি প্রচারণা চালাতে পারে। কাউকে শুধু ‘যুদ্ধাপরাধী’ বললে হবে না। তথ্যপ্রমাণসহ বলতে হবে।
কাজেই সামপ্রতিককালে বিএনপির সামনে নানা ইস্যু রয়েছে। তা প্রাজ্ঞতার সঙ্গে ও বুদ্ধি বিবেচনা করে কাজে লাগাতে পারলে তাদের ইমেজ বাড়বে। ভোটও বাড়তে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ব্যর্থতার জন্য মানুষ একটা বিকল্প খুঁজছে। বিএনপিকে সেই বিকল্প হওয়ার মতো আস্থা অর্জন করতে হবে। বিএনপি যদি তাদের কাজে, কথাবার্তায়, আচরণে মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে নানা অপশাসন সত্ত্বেও নির্দল নিরপেক্ষ মানুষ আবার নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য হবে। বিএনপির জন্য তা হবে আত্মঘাতী।
বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির আরও নানা দুর্বলতা রয়েছে। আজ কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করা হলো। পরে অন্যান্য পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করার আশা রাখি।
কয়েক দিন আগে চাঁদপুরের এক জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘এ সরকারকে আমরা ফেলে দিতে চাই না। তাদের ল্যাংড়া লুলা করে ছেড়ে দেব। দেখি তারা খুঁড়িয়ে কত দূর যেতে পারে।’ এটা কি রাজনীতির ভাষা হলো? এ রকম ভাষা ব্যবহার করলে কি বিএনপি বা খালেদা জিয়ার সুনাম বাড়বে? খালেদা জিয়া তাঁর উচ্চতার কথা ভুলে যান কী করে? নানা কারণে তিনি আজ এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের শিখরে পৌঁছেছেন। এর মর্যাদা রাখা কি তাঁর দায়িত্ব নয়?
খালেদা জিয়ার এই উক্তির সমালোচনা করে পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ যা বলেছেন (আল্লাহর ইচ্ছায় খালেদা...) তাও সমান নিন্দনীয়।
সমালোচনায় এমন ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়, যা সমালোচনার বক্তব্যকে ছাপিয়ে কদর্য ভাষা নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। তাতে সমালোচনার লক্ষ্য আর অর্জিত হয় না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী।
বিএনপি এ দেশের একটি বড় ও জনপ্রিয় দল। তাদের বিরাট ভোট ব্যাংক রয়েছে। কখনো দলটি সরকার গঠন করে, কখনো বিরোধী দলে থাকে। যখন সরকার পরিচালনা করেছে, তখন তারা কী কী ভালো করেছে, কী কী খারাপ কাজ করেছে, তা দীর্ঘ আলোচনা ও গবেষণার বিষয় । আজ এই নিবন্ধে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করব।
বিএনপির মহা ভাগ্য যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার তিন বছরে নানা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের বেশ কিছু সাফল্য থাকলেও ব্যর্থতার পাল্লা এত ভারী যে জনগণ সাফল্যগুলোর কথা বিশেষ মনে রাখবে না। এটা জনগণের একটা বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনেও আমরা একজনের একটি দুর্বলতা খুঁজে পেলে সেটা নিয়ে সমালোচনা করতে বেশি পছন্দ করি। তার বাকি ১০টা গুণের কথা বিস্মৃত হই। রাজনৈতিক আলোচনা-সমালোচনায়ও আমরা সেটা দেখতে পাই। বিএনপি সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
আমাদের দেশে সচরাচর একই দলকে জনগণ পরপর দুবার সরকার গঠন করতে দেয় না। জনগণের এই বৈশিষ্ট্যও বিএনপির সহায়ক। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনেকের ধারণা, আগামী দুই বছরে সরকারের বড় নাটকীয় কোনো সাফল্য না এলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি বা চারদলীয় জোটের জেতার সম্ভাবনাই বেশি। একটি জাতীয় দৈনিক কয়েক দিন আগে রীতিমতো জরিপ করে একটা নির্বাচনী ফলও ঘোষণা করে দিয়েছে। যদিও এ রকম ধারণা বা জরিপ সব সময় সত্য হয় না। আবার সব সময় মিথ্যাও হয় না। কাজেই বিএনপির পক্ষে অনুকূল অনেক ঘটনাই ঘটছে। বিএনপিকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে ছাত্র লীগ ও শেয়ারবাজার।
কিন্তু এত অনুকূল পরিবেশ পেয়েও বিএনপি রাজনীতির মাঠে ঠিকভাবে খেলতে পারছে বলে মনে হয় না। রাজনীতির মাঠে খেলার মতো দক্ষ খেলোয়াড় বিএনপিতে কম বলেই মনে হয়। অথবা বিএনপির নীতি-নির্ধারণের দক্ষতার মধ্যেই হয়তো ঘাটতি রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্ব, কাঠামো, কর্মপদ্ধতি এমনই ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক যে খুব দক্ষ, আত্মসম্মানসম্পন্ন ব্যক্তি বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হতে চায় বলে মনে হয় না। বিএনপির রাজনীতির মধ্যেও রয়েছে নানা অসংগতি ও প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যানধারণা।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে দলটির নেতৃত্ব কত দুর্বল। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি আহূত সংলাপকে বিএনপি অন্যায়ভাবে সমালোচনা করেছে। সংলাপ হওয়ার আগেই তারা বলেছে, এটা লোক দেখানো। এতে জনমনে এমন ধারণা হতে পারে যে বিএনপি ভালো কিছুই সমর্থন করে না। সংলাপ অনুষ্ঠানে যদি বিএনপি তার বক্তব্য বলার সুযোগ না পেত তাহলে তারা পরে এর সমালোচনা করতে পারত। তবে বিএনপি সংলাপে গিয়ে খুব ভালো করেছে। বেগম খালেদা জিয়া সংলাপে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে আরও ভালো করেছেন। জনগণ এটা বেশ পছন্দ করেছে।
কিন্তু সংলাপ নিয়ে বিএনপি আগে ও পরে যা বলেছে তা মোটেও ঠিক হয়নি। এসব কথা বিএনপির রাজনীতির দেউলিয়াত্ত প্রমাণ করে। অনেকের কাছে মনে হয়েছে, বিএনপি বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করছে। যা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমর্থনযোগ্য নয়।
প্রথমে বিএনপি বলেছিল, ‘আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুর ফয়সালা হোক, তারপর নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গ আলোচনা করা যাবে।’ এটা যে একটা কুযুক্তি তা একজন স্কুলছাত্রও বুঝতে পারে। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ইস্যুটার প্রয়োজন হবে দুই বছর পর। আর ‘নির্বাচন কমিশন’ ইস্যুটি সমাধান করতে হবে এখনই। বিএনপির যুক্তি শুনে মনে হয়েছিল, তারা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন হোক তা চায় না। যাতে আরও একটা ইস্যু পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকার তো তাদের অপশাসনের মধ্য দিয়ে নানা ইস্যু প্রায় প্রতি সপ্তাহে বিএনপিকে দিচ্ছেই। জোর করে ইস্যু তৈরি করার দরকার কী!
রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যদি এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত শুনতে চান ও তাতে যদি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন থাকে তাহলে অসুবিধে কোথায়? আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়াই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। অতীতে কোনো সরকার এ রকম আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়নি। শুধু প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছায় ও পরামর্শে নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়া কি ভালো? বিএনপি এই পদ্ধতিকে যথাযথ বলে মনে করে? আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া বেঠিক মনে করে? অতীতে একক ইচ্ছায় ও পরামর্শে নির্বাচন কমিশন গঠন করে কী কী ঘটনা ঘটেছিল তা বিএনপি ভুলে গেলেও সচেতন জনগণ ভোলেনি। বিএনপি কি সে রকম একজন ‘আজিজ’ নিয়োগ হলে খুশি হতো? যাতে একটা ইস্যু করা যায়?
বিএনপি রাষ্ট্রপতির সংলাপে গিয়েছে কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে কোনো প্রস্তাব বা গঠনমূলক পরামর্শ দেয়নি। এর ফলে বিএনপি সম্পর্কে অনেকের ধারণা হতে পারে তারা গঠনমূলক কিছু করতে পারে না বা চায় না। বিএনপির কি এই সুযোগ নেওয়া উচিত ছিল না? তারা তাদের বিবেচনামতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন কমিশনারের নাম প্রস্তাব দিতে পারত। এমনও তো হতে পারত রাষ্ট্রপতি তাদের তালিকা থেকে একজন বা দুজন কমিশনার নিয়েছেন। যদি বিএনপি দলনিরপেক্ষ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করতে পারত।
বিএনপির সহযোগিতা ছাড়াই রাষ্ট্রপতি ‘নির্বাচন কমিশনে’ নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগ দেওয়া ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর কিছু করার ছিল না। কিন্তু নিয়োগ দানের দিনই বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা এই নিয়োগ মানে না। নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সরকারের তল্পিবাহক। তাঁদের তত্ত্বাবধানে কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না না। কেন? নতুন সিইসি ও কমিশনারদের অপরাধ কী তা তো বিএনপি বলেনি। তাদের ব্যাপারে বিএনপির সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে আগে তা বলা উচিত ছিল। তা না বলে সরাসরি তাদের প্রত্যাখ্যান করা কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। কাজে নামার আগে কমিশনকে অভিযুক্ত করে বিএনপি কাঁচা কাজ করেছে। তারা যে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করতে অভ্যস্ত তা আবার প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির নিজের কোনো পছন্দ নেই, রাষ্ট্রপতির পছন্দেরও বিরোধিতা করবেন, এটা মানা যায় না।
‘এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না’—এটা বলার পেছনেও বা বিএনপির যুক্তি কী? একটা নির্বাচন পরিচালনার পর এই কমিশনের দোষত্রুটি আগে চিহ্নিত হতে হবে—তার পরই ‘আর অংশ নেব না’ বলা যায়। তার আগে কি বলা যায়?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু বিএনপির একটি জনপ্রিয় দাবি। দেশের বহু মানুষ এই দাবি সমর্থন করে। এই দাবি নিয়ে বিএনপি গণ-আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু এই দাবির সঙ্গে অন্যান্য ইস্যু মেলানো ঠিক হচ্ছে না। অন্যান্য ইস্যু নিয়ে আবোল-তাবোল কথা বলে তারা প্রধান ইস্যুকেও হালকা করে ফেলছে। বিএনপির উচিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ইস্যু নিয়েই আন্দোলন গড়ে তোলা। অন্যান্য ইতিবাচক ইস্যুতে সরকারকে সহযোগিতা করা ভালো। এতে বিএনপির প্রতি জনমর্থন বাড়বে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতেও বিএনপি খুব স্পষ্ট অবস্থান না নিয়ে তাদের লাখ লাখ কর্মী ও সমর্থকদের হতাশ করেছে। জামায়াত অনুরাগী কিছু নেতা ও কর্মীর মন জোগাতে গিয়ে বিএনপি একটি জনপ্রিয় দাবির প্রতি সমর্থন দিতে দ্বিধা করছে। বরং কিছু নেতার বক্তব্যে মনে হয় তাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চান না। বিএনপিকে খুব গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে তারা স্পষ্টভাবে কী অবস্থান নেবে। বিচার কার্যকে সমর্থন করলে বিএনপির প্রতি বিমুখ হবে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। অপরদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বিরোধিতা করলে বা নীরব থাকলে বিমুখ হবে আওয়ামী লীগবিরোধী কিন্তু নির্দল জনগণ। বিমুখ হতে পারে দেশের ছাত্র-তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ। এই ইস্যুতে বিএনপি যদি শুধু ভোটকে বিবেচনায় নেয় তাহলে কোন পক্ষ বড় ‘ভোট ব্যাংক’ তা হিসাব করতে হবে।
তবে আমরা মনে করি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটি শুধু ভোট ব্যাংকের ইস্যু নয়। এটা নৈতিক ও আদর্শগত ইস্যু। বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে পারে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতে পারে না। কারণ, বিএনপি প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল। এই দলের মধ্যে রয়েছে অনেক নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। যারা আইনের বিচারে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণিত হবে তাদের রক্ষা করা বিএনপির দায়িত্ব হতে পারে না। বিএনপিকে বুঝতে হবে, দলের জন্য তারা বোঝা। যত দ্রুত সম্ভব এই বোঝা কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলা তাদের দলের জন্য উত্তম। আওয়ামী লীগ ও অন্য দলের মধ্যে যদি যুদ্ধাপরাধী লুকিয়ে থাকে তাদের কৃতকর্মের বিবরণসহ বিএনপি প্রচারণা চালাতে পারে। কাউকে শুধু ‘যুদ্ধাপরাধী’ বললে হবে না। তথ্যপ্রমাণসহ বলতে হবে।
কাজেই সামপ্রতিককালে বিএনপির সামনে নানা ইস্যু রয়েছে। তা প্রাজ্ঞতার সঙ্গে ও বুদ্ধি বিবেচনা করে কাজে লাগাতে পারলে তাদের ইমেজ বাড়বে। ভোটও বাড়তে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ব্যর্থতার জন্য মানুষ একটা বিকল্প খুঁজছে। বিএনপিকে সেই বিকল্প হওয়ার মতো আস্থা অর্জন করতে হবে। বিএনপি যদি তাদের কাজে, কথাবার্তায়, আচরণে মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে নানা অপশাসন সত্ত্বেও নির্দল নিরপেক্ষ মানুষ আবার নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য হবে। বিএনপির জন্য তা হবে আত্মঘাতী।
বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির আরও নানা দুর্বলতা রয়েছে। আজ কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করা হলো। পরে অন্যান্য পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করার আশা রাখি।
কয়েক দিন আগে চাঁদপুরের এক জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘এ সরকারকে আমরা ফেলে দিতে চাই না। তাদের ল্যাংড়া লুলা করে ছেড়ে দেব। দেখি তারা খুঁড়িয়ে কত দূর যেতে পারে।’ এটা কি রাজনীতির ভাষা হলো? এ রকম ভাষা ব্যবহার করলে কি বিএনপি বা খালেদা জিয়ার সুনাম বাড়বে? খালেদা জিয়া তাঁর উচ্চতার কথা ভুলে যান কী করে? নানা কারণে তিনি আজ এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের শিখরে পৌঁছেছেন। এর মর্যাদা রাখা কি তাঁর দায়িত্ব নয়?
খালেদা জিয়ার এই উক্তির সমালোচনা করে পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ যা বলেছেন (আল্লাহর ইচ্ছায় খালেদা...) তাও সমান নিন্দনীয়।
সমালোচনায় এমন ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়, যা সমালোচনার বক্তব্যকে ছাপিয়ে কদর্য ভাষা নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। তাতে সমালোচনার লক্ষ্য আর অর্জিত হয় না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী।
No comments