আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-২৮)-বাবার চলে যাওয়ার পর by আলী যাকের
প্রান্তিক মুকুল মেলা সম্পর্কে লেখা যেন শেষ হয়েও শেষ হতে চায় না। এত স্মৃতি ওই মুকুল মেলাকে ঘিরে। সেই স্মৃতি নিয়েই হয়তো একটি গ্রন্থ রচনা সম্ভব। তবুও কিছু কথা আছে, যা বলতেই হয়। আমি আগেই বলেছি, আমি মুকুল মেলার একজন মেঠোকর্মী ছিলাম। কিন্তু সংগঠন চালাতে হলে নানা ধরনের কাজে দক্ষ মানুষের প্রয়োজন পড়ে।
সাংগঠনিক কাজে তাঁরা হন সিদ্ধহস্ত। আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু বজুভাই সে রকম একজন ব্যক্তি। বজুভাই ভেতর-বাইরের সমন্বয়ের কাজে ছিলেন করিৎকর্মা। আমাদের গেণ্ডারিয়া পাড়ার এক তরুণ আমায় ফোন করে কথায় কথায় জানাল, বজুভাইও গত হয়েছেন কয়েক বছর হলো। আমি কল্পনাই করতে পারি না, এসব মানুষ এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে! এই একটা ব্যাপার আছে। আমি লক্ষ করেছি যে যাঁরা বেশি কাছের মানুষ, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও মনে হয় তাঁরা তো আছেনই। চাইলেই দেখা পাওয়া যাবে। তাঁরা যখন চলে যান তখন হঠাৎ করে মনে হয়, আহা! একবার যদি দেখা হতো যাওয়ার আগে? আবার কিছু দিনের মধ্যে প্রায় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমরা আবার ভুলে যাই যে তাঁরা চলে গেছেন। মনে হয়, আছেনই তো। চাইলেই দেখা পাওয়া যাবে। প্রসঙ্গ কথায় অতি সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। এই সেদিন কলকাতা থেকে আমার এক বন্ধু আমায় সেখানকার ইন্ডিয়ান এঙ্প্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা ই-মেইল করে পাঠিয়েছেন। লেখাটির শিরোনাম 'বন্ধ দরজার ভেতর থেকে লেখা'। লেখাটি পড়ে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি। একজন মানুষ, যাঁর সম্পর্কে শুনেছি, আবছা একটা ধারণা ছিল কেবল, লেখাটি তাঁরই ওপরে। সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কনিষ্ঠ মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী সম্পর্কে দীর্ঘদিন পর কিছু লিখিত তথ্য হাতে পেলাম। এর আগে সেই কোনকালে অন্নপূর্ণা দেবীর ওপরে বাংলায় লেখা একটি বই পড়েছিলাম। সেই বইটি তাঁর কোনো এক ভক্ত লিখেছিলেন। প্রায় গল্পেরই মতো করে। বইটি কাকে যেন ধার দিয়েছিলাম পড়ার জন্য, আর ফেরত পাইনি। এই প্রথম এই মহীয়সী নারীর নিজের ভাষায় লেখা কিছু তথ্য হাতে পেলাম। তিনি মুম্বাইয়ের একটি ভবনের ছয় তলায় থাকেন প্রায় স্বেচ্ছানির্বাসনে। নিজের মনে তিনি সংগীত সাধনা করেন। তাঁর যন্ত্রটি হচ্ছে সুরবাহার। এখানে, এই লেখায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সম্পর্কে, সংগীত শিক্ষক হিসেবে তাঁর বিশেষত্ব সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পাই। এর বিস্তারে গেলে আমার এই লেখার জন্য তা প্রাসঙ্গিক হবে না হয়তো। কেবল এটুকুই বলি, অন্নপূর্ণা মনে করেন, তাঁর সংগীত সাধনা হচ্ছে গিয়ে একধরনের উপাসনা। আমি এই লেখাটি আমার এক বন্ধুকে পাঠাই, যিনি নিজেও একজন সংগীতপ্রেমী মানুষ। তাঁর প্রতিক্রিয়াটি চমৎকার। তিনি আমায় লিখেছেন, 'এই লেখাটি বছর তিনেক আগে পেলে বড় ভালো হতো। ওয়াহিদ ভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করা যেত যে সংগীতের কত গভীরে প্রবেশ করলে সংগীতচর্চা উপাসনা হয়ে ওঠে?' আমার এই বন্ধুটির নাম জিয়াউদ্দিন তারেক আলী। সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে ওর সঙ্গে সখ্য। আর এখন তো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি হিসেবে আমাদের নিত্যই দেখা হয়। ওয়াহিদুল হক, আমাদের ওয়াহিদ ভাই, বাংলাদেশে শুদ্ধ সংগীতের, আমার জানা মতে, সবচেয়ে বড় একজন বিশেষজ্ঞ। কেবল শুদ্ধ সংগীত কেন, প্রায় সব বিষয়েই তাঁর লেখাপড়া ছিল বিস্তর। বছর তিনেক আগে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মাঝেমধ্যেই মনে হয়, যখন জীবনের কঠিনতম সংস্কৃতিসম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন পড়ে, তখন কার কাছে যাব? ওয়াহিদ ভাই যে নেই!
ফিরে আসি ১৯৬১ সালের সেই নিদাঘে, যখন বাবার মৃদু হাসিমাখা প্রত্যয়ী চেহারা আমাকে আমার কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দেয়। ওই সময় আমার এবং আমাদের পরিবারের সব বন্ধুবান্ধব, এমনকি পাড়ার পরিচিতজনরাও আমাদের পরিবারের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসে। তখন যদি তারা আমাদের পাশে না দাঁড়াত, তাহলে আমাদের পক্ষে এ ধরনের বড় একটি শোকের ধাক্কা সামলে ওঠা দুষ্কর হতো।
আমার বাবার চলে যাওয়ার পর প্রায় মাসখানেক ধরে আমরা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে শোকের তীব্রতা যখন একটু কমে এল, তখন আমাদের ভাবতে হলো, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে। আমাদের বাড়িতে তখন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমার বাবা। গেণ্ডারিয়ার বাড়িটি কেনার সময় তাঁর পেনশন বিক্রি করে দেওয়ার ফলে আর কোনো ধরনের অর্থ নিয়মিতভাবে তিনি পেতেন না। যদিও একটি বড় পাকিস্তানি কম্পানিতে প্রশাসনিক দায়িত্বে খুব ভালো বেতন পেতেন, তার সবটাই খরচ হয়ে যেত সংসার চালানোয়। এখন ভাবলে হাসি পায়, বাবার মৃত্যুর পর আমরা তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কেবল ৬২ টাকার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। এ অবস্থায় আমাদের সংসার কিভাবে চলবে_তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক। এ সময় আমার মা, যাঁর ওপরে বাবার আস্থা ছিল সম্পূর্ণ, তিনিই শক্ত হাতে হাল ধরলেন। তাঁর নিজস্ব সামান্য কিছু অর্থ সঞ্চিত ছিল এবং ছিল সামান্য কিছু গয়নাগাঁটি। আমার বাবা মারা যাওয়ার আগেই আমাদের গেণ্ডারিয়ার বাড়ির দোতলায় দুটি ঘর তৈরি করেছিলেন। মায়ের সিদ্ধান্ত অনুুযায়ী নিচের তলার ১০ ঘরের ফ্ল্যাট ছেড়ে আমরা চারজন_মা, ভাইয়া, আমি এবং আমার ছোট বোন ঝুনু, সেই দুই ঘরে আমাদের সংসার পাতলাম। নিচের তলাটি ভাড়া দিয়ে দেওয়া হলো। এটা করার জন্য আনুষঙ্গিক কিছু খরচ আমার মায়ের সঞ্চয় থেকে এবং গয়নাগাঁটি বন্ধক রেখে জোগাড় করা হয়। আমাদের গাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। আমাদের সচ্ছল জীবন থেকে এই পরিমিত উপার্জনের জীবনে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে রূপান্তর ঘটাই। ভাবটা এমন যে আমরা যেন কোনোকালেই অবস্থাপন্ন ছিলাম না। (চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ফিরে আসি ১৯৬১ সালের সেই নিদাঘে, যখন বাবার মৃদু হাসিমাখা প্রত্যয়ী চেহারা আমাকে আমার কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দেয়। ওই সময় আমার এবং আমাদের পরিবারের সব বন্ধুবান্ধব, এমনকি পাড়ার পরিচিতজনরাও আমাদের পরিবারের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসে। তখন যদি তারা আমাদের পাশে না দাঁড়াত, তাহলে আমাদের পক্ষে এ ধরনের বড় একটি শোকের ধাক্কা সামলে ওঠা দুষ্কর হতো।
আমার বাবার চলে যাওয়ার পর প্রায় মাসখানেক ধরে আমরা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে শোকের তীব্রতা যখন একটু কমে এল, তখন আমাদের ভাবতে হলো, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে। আমাদের বাড়িতে তখন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমার বাবা। গেণ্ডারিয়ার বাড়িটি কেনার সময় তাঁর পেনশন বিক্রি করে দেওয়ার ফলে আর কোনো ধরনের অর্থ নিয়মিতভাবে তিনি পেতেন না। যদিও একটি বড় পাকিস্তানি কম্পানিতে প্রশাসনিক দায়িত্বে খুব ভালো বেতন পেতেন, তার সবটাই খরচ হয়ে যেত সংসার চালানোয়। এখন ভাবলে হাসি পায়, বাবার মৃত্যুর পর আমরা তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কেবল ৬২ টাকার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। এ অবস্থায় আমাদের সংসার কিভাবে চলবে_তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক। এ সময় আমার মা, যাঁর ওপরে বাবার আস্থা ছিল সম্পূর্ণ, তিনিই শক্ত হাতে হাল ধরলেন। তাঁর নিজস্ব সামান্য কিছু অর্থ সঞ্চিত ছিল এবং ছিল সামান্য কিছু গয়নাগাঁটি। আমার বাবা মারা যাওয়ার আগেই আমাদের গেণ্ডারিয়ার বাড়ির দোতলায় দুটি ঘর তৈরি করেছিলেন। মায়ের সিদ্ধান্ত অনুুযায়ী নিচের তলার ১০ ঘরের ফ্ল্যাট ছেড়ে আমরা চারজন_মা, ভাইয়া, আমি এবং আমার ছোট বোন ঝুনু, সেই দুই ঘরে আমাদের সংসার পাতলাম। নিচের তলাটি ভাড়া দিয়ে দেওয়া হলো। এটা করার জন্য আনুষঙ্গিক কিছু খরচ আমার মায়ের সঞ্চয় থেকে এবং গয়নাগাঁটি বন্ধক রেখে জোগাড় করা হয়। আমাদের গাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। আমাদের সচ্ছল জীবন থেকে এই পরিমিত উপার্জনের জীবনে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে রূপান্তর ঘটাই। ভাবটা এমন যে আমরা যেন কোনোকালেই অবস্থাপন্ন ছিলাম না। (চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments