সময়ের কথা-নিজস্বতা কেন হারিয়ে যেতে দিচ্ছি by অজয় দাশগুপ্ত
আয়ুর্বেদ-কবিরাজি বা হেকিমি চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পদ্ধতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যয়ও পড়ে কম। কিন্তু তারপরও এখন এটা স্বীকৃত যে আমাদের দেশে লতাপাতা, গুল্মসহ বনজ সম্পদ ব্যবহার করে তৈরি ওষুধের মধ্যে বেশ কিছু ছিল ধন্বন্তরী ক্ষমতাসম্পন্ন।
আমরা কেন তা টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হবো না? জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মেয়ে মাহযূযা হক ইত্তেফাকে ১৯৯২ সালের ১২ জুলাই লিখেছেন :'১৯২৯ সালে আমার বোনের হাত ও পায়ের কিছু অংশ পুড়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসককে ডাকা হয়। তিনি রোগীর পেটে কয়েকটা ইনজেকশন দেন এবং হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে রোগীর প্রতি খুব যত্ন নেওয়ার উপদেশ দেন। আমাদের দাদী সে সময় কলিকাতা ছিলেন। তিনি খবর শুনে ঢাকা এসে বলেন, আমি পোড়া ঘায়ের টোটকা ওষুধ জানি। কিন্তু আব্বা (শহীদুল্লাহ সাহেব) রাজী হলেন না। তিনি বলেন, যেখানে ডাক্তার পাওয়া যায় না সেখানে টোটকা চিকিৎসা করা যায়। ঢাকায় পোড়া ঘা ও ফোড়া ইত্যাদির চিকিৎসক আছে। আমি চাঁদশীর ডাক্তারকেই ডাকব। আব্বা ঢাকার চাঁদশীর মোহিনী মোহন দাশকে কল করলেন। তিনি কম্পাউন্ডারসহ রোজ এসে বোনের হাত-পায়ের ঘা ধুয়ে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতেন। কিন্তু কোনো ফিস নিতেন না।'
কে এই মোহিনী মোহন দাশ? চাঁদশী এলাকাটিই বা কোথায়?
ঢাকার বনানীতে একটি সাইনবোর্ড রয়েছে 'চাঁদশী ক্ষত চিকিৎসা' নাম দিয়ে। বাংলাদেশের আরও অনেক জেলায় এমন সাইনবোর্ড দেখা যাবে। ভারতের নানা প্রান্তেও রয়েছে এ পদ্ধতিতে যারা চিকিৎসা করেন তাদের ডাক্তারখানা। কিন্তু এখন খোদ চাঁদশীতেই কার্যত নেই এর অস্তিত্ব। কোথায় যেন হারিয়ে গেল ধন্বন্তরী বা অব্যর্থ চিকিৎসা পদ্ধতি!
বরিশালের সুবাস ছড়ানো বালাম চাল বিখ্যাত ছিল গোটা বাংলাজুড়ে। এখন এর স্থান হয়েছে ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জিন-ব্যাংকে। একজন বিশেষজ্ঞ জানালেন, কেউ চাইলে এ জাতের ধান উৎপাদন করতে পারে। এ জন্য জিন-ব্যাংক থেকে কয়েকটি বীজ নিয়ে প্রথমে টেস্ট প্লটে চাষ করতে হবে। সেখান থেকে মিলবে নিজের জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ। বাংলাদেশে চাঁদশীর ক্ষত চিকিৎসা পদ্ধতিও এখন তেমন দশায় পতিত হয়েছে। চাঁদশী একটি গ্রামের নাম, একটি ইউনিয়নের নাম। বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় এর অবস্থান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার মেয়ের চিকিৎসার জন্য যে ডা. মোহিনী মোহন দাশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তার জন্মও চাঁদশী গ্রামে। ঢাকা শহরে তার পসার ছিল যথেষ্ট। রোগী দেখতে যেতেন নিজের গাড়িতে চেপে। তিনি রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আবার অভিজাত মহলেও যাতায়াত ছিল। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রয়োজনে ক্ষত চিকিৎসার জন্য সম্রাট পঞ্চম জর্জ তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
চাঁদশী ক্ষত চিকিৎসা প্রণালীর প্রবর্তক বিষ্ণুহরি দাশ। এখন থেকে সাড়ে চারশ' বছরেরও বেশি আগে তিনি এর সূচনা করেন। সমাজে অবহেলিত সম্প্রদায়ের একজন ছিলেন তিনি, কিন্তু জয় করেছিলেন সবার মন। তার চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে বংশপরম্পরায়। চাঁদশী দাশবাড়ি ক্রমে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। লতাপাতা ও গুল্ম ব্যবহার করে ওষুধ বানানো হতো। ওষুধ ব্যবহার ছাড়াও চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করতেন। ডাক্তার বাড়িতে ছিল এক প্রকাণ্ড আটচালা ঘর। সেখানে বহির্বিভাগ বা আউটডোর যেমন ছিল, তেমনি ছিল ৫০টি বেড বা শয্যা_ যেখানে গুরুতর অসুস্থদের ভর্তি করে নেওয়া হতো। হাসপাতালের বেডে থাকার জন্য কিংবা রোগীর সঙ্গে আসা লোকদের থাকার জন্য কোনো ভাড়া দিতে হতো না। একশ' বছরেরও আগে গ্রামে এমন হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল কোন জাদুমন্ত্রে? একটি বাড়ির লোকেরাই এ ব্যবস্থা করেছিল। এখানে আরও একটি তথ্য উল্লেখ করা যায়_ চাঁদশীর দাশ পরিবারের চিকিৎসকরা গ্রামবাসীর কাছ থেকে চিকিৎসার জন্য কোনো অর্থ গ্রহণ করতেন না। যে কোনো ক্ষত রোগ নিরাময়ে চাঁদশীর চিকিৎসকরা সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অর্শ, ভগন্দর, একশিরা, বিখাউজ, ব্রন, ফোড়া, নালী ইত্যাদি পচনশীল ব্যাধির নিরাময়ে ভেষজ ওষুধের গুণাগুণ সম্পর্কে তারা ভালোভাবে অবহিত ছিলেন এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও তা মেনে নিয়েছিলেন। তাদের আবিষ্কৃৃত কয়েক ধরনের মলম খোসপাঁচড়া, ঘা ও চুলকানিতে মোক্ষম দাওয়াই ছিল। কিন্তু কোথায় তা হারিয়ে গেল? এ প্রশ্নও করা যায় যে একটি পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার জন্য ও যে মহাআয়োজন-উদ্যোগ নিয়েছিল, তা থেকে আমাদের সমাজ কি যথাযথ শিক্ষা নিতে পারছে?
এটা ঠিক যে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে। বাজারে এখন মিলছে প্রায় সব রোগের ওষুধ। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা পদ্ধতিতেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এতে মৃত্যুহার কমছে। আয়ুর্বেদ-কবিরাজি বা হেকিমি চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পদ্ধতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যয়ও পড়ে কম। কিন্তু তারপরও এখন এটা স্বীকৃত যে আমাদের দেশে লতাপাতা, গুল্মসহ বনজ সম্পদ ব্যবহার করে তৈরি ওষুধের মধ্যে বেশ কিছু ছিল ধন্বন্তরী ক্ষমতাসম্পন্ন। আমরা কেন তা টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হবো না?
রাজধানী ঢাকায় এখন খেলোয়াড়রা স্পোর্টস মেডিসিনের সহায়তা পায়। মাঠে কেউ আহত হলে পাস করা ফিজিওথেরাপিস্টরা ছুটে যান। উন্নত দেশগুলোতে স্পোর্টস মেডিসিন জনপ্রিয়। নামি-দামি খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষকের পাশাপাশি থাকে নিজস্ব ফিজিও। এক সময়ে মাণ্ডার তেল খুব জনপ্রিয় ও অপরিহার্য ছিল। ঢাকার বাসাবো এলাকার কাছেই মাণ্ডা গ্রাম। চাঁদশীর মতোই এ এলাকার খ্যাতি ছিল হাত-পা ভাঙা কিংবা ব্যথা-বেদনার নিরাময়ে। ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য তেলের পাশাপাশি ছিল বেদনানাশক মালিশের ব্যবস্থা। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, মাদকতা দোষে দুষ্টও নয়। এ 'মহৌষধ' নিয়ে যারা কাজ করেছেন এবং এখনও যারা টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করছেন তাদের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানের একটু ছোঁয়া নিশ্চিত করা গেলে শুধু দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী স্পোর্টস মেডিসিনে বাংলাদেশ হয়তো নতুন কিছু যোগ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী স্পোর্টস মেডিসিন জনপ্রিয় হচ্ছে, একইসঙ্গে জটিলতাও কম নয়। খেলোয়াড়রা ব্যথা-বেদনা কমাতে এমন অনেক ওষুধ ব্যবহার করছেন, যার কিছু অংশ বলবর্ধক এমনকি মাদকতা দোষে দুষ্ট হিসেবে চিহ্নিত এবং এ কারণে নিষিদ্ধের তালিকায়। কেউ তা ব্যবহার করলে আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে ধরা পড়ছে এবং তার পরিণতিতে অনেক সেরা খেলোয়াড়ের সম্ভাবনা হুমকিতে পড়ছে। মাণ্ডার তেল বা মালিশ কিন্তু এ ধরনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত। আমাদের বিজ্ঞানীদের কেউ কি মাণ্ডার তেল নিয়ে সিরিয়াস গবেষণায় আগ্রহ দেখাবেন? বহু বছর এ তেল এবং মালিশ পদ্ধতি যে খেলোয়াড়দের কাছে জনপ্রিয় ছিল, তার নিশ্চয়ই বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। কেন আমরা তা হারিয়ে যেতে দেব?
দেশের আরও অনেক স্থানে 'স্থানীয় চিকিৎসা পদ্ধতি' জনপ্রিয় ছিল। এর সঙ্গে 'ফকিরি-কেরামতি'র বা 'টোটকা চিকিৎসার' মিল খুঁজলে চলবে না। ভেষজ ওষুধ নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। নিমগাছ এখন বিশ্বের বিস্ময়। আরও অনেক ঔষধি গাছে সমৃদ্ধ ছিল আমাদের বনাঞ্চল। এমনকি অনেক বাড়িতেও ছিল মূল্যবান ভেষজ গুণসম্পন্ন গাছপালা। অবহেলায় কিংবা গুণাগুণ সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে নিজেদের সম্পদ আমরা হারিয়ে যেতে দিয়েছি। এখন বিজ্ঞানই বলছে, নিজের প্রতি ফিরে তাকাতে। আমরা পাটের থলি বা ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পলিথিন বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু তা পরিবেশবান্ধব নয়, বরং পরিবেশের জন্য নিদারুণ ক্ষতির কারণ হয়েছে। পাটের উপকারিতা আমরা নতুন করে বুঝতে শুরু করেছি এবং বিশ্বের অনেক দেশও সেটা স্বীকার করছে। এর ফলে সোনালি আঁশ হিসেবে স্বীকৃত যে পাট অনেক বছর কৃষকের গলার ফাঁস বলে মনে হচ্ছিল, তার জন্য সৃষ্টি হতে চলেছে নতুন সম্ভাবনা। কৃষকরা পাট চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন। পাটের দাম মিলছে ভালো। আমাদের বিজ্ঞানীদের একটি দল পাটের জিন-রহস্য ভেদ করেছেন। এর ফলে আরও গুণসম্পন্ন পাট উৎপাদনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পাটের প্রচলিত ব্যবহার, যেমন ব্যাগ ও সুতলি তৈরি_ এর বাইরেও উন্নত মানের পণ্য তৈরির জন্য তা সহায়ক হবে। বিশ্ব বাজারের বিচিত্র ও বহুমুখী চাহিদা পূরণে পাট শিল্প রাখতে পারবে নতুন অবদান। হাসি ফুটবে চাষিদের মুখে। তারা নিজেদের আর অবহেলিত চাষা নয় বরং গণ্য করতে থাকবেন সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলার অপরিহার্য কারিগর হিসেবে। আমরা নিশ্চয়ই এমন সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে চলব না?
চাঁদশীর ক্ষত নিরাময় চিকিৎসা ব্যবস্থা কোনোভাবেই সর্বরোগহর দাওয়াই নয়। মাণ্ডার তেলকেও একইভাবে আমরা দেখব না। কিন্তু আমাদের নিজস্বতা যেখানে, তা যেন আর হেলাফেলা করা না হয়।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
কে এই মোহিনী মোহন দাশ? চাঁদশী এলাকাটিই বা কোথায়?
ঢাকার বনানীতে একটি সাইনবোর্ড রয়েছে 'চাঁদশী ক্ষত চিকিৎসা' নাম দিয়ে। বাংলাদেশের আরও অনেক জেলায় এমন সাইনবোর্ড দেখা যাবে। ভারতের নানা প্রান্তেও রয়েছে এ পদ্ধতিতে যারা চিকিৎসা করেন তাদের ডাক্তারখানা। কিন্তু এখন খোদ চাঁদশীতেই কার্যত নেই এর অস্তিত্ব। কোথায় যেন হারিয়ে গেল ধন্বন্তরী বা অব্যর্থ চিকিৎসা পদ্ধতি!
বরিশালের সুবাস ছড়ানো বালাম চাল বিখ্যাত ছিল গোটা বাংলাজুড়ে। এখন এর স্থান হয়েছে ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জিন-ব্যাংকে। একজন বিশেষজ্ঞ জানালেন, কেউ চাইলে এ জাতের ধান উৎপাদন করতে পারে। এ জন্য জিন-ব্যাংক থেকে কয়েকটি বীজ নিয়ে প্রথমে টেস্ট প্লটে চাষ করতে হবে। সেখান থেকে মিলবে নিজের জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ। বাংলাদেশে চাঁদশীর ক্ষত চিকিৎসা পদ্ধতিও এখন তেমন দশায় পতিত হয়েছে। চাঁদশী একটি গ্রামের নাম, একটি ইউনিয়নের নাম। বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় এর অবস্থান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার মেয়ের চিকিৎসার জন্য যে ডা. মোহিনী মোহন দাশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তার জন্মও চাঁদশী গ্রামে। ঢাকা শহরে তার পসার ছিল যথেষ্ট। রোগী দেখতে যেতেন নিজের গাড়িতে চেপে। তিনি রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আবার অভিজাত মহলেও যাতায়াত ছিল। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রয়োজনে ক্ষত চিকিৎসার জন্য সম্রাট পঞ্চম জর্জ তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
চাঁদশী ক্ষত চিকিৎসা প্রণালীর প্রবর্তক বিষ্ণুহরি দাশ। এখন থেকে সাড়ে চারশ' বছরেরও বেশি আগে তিনি এর সূচনা করেন। সমাজে অবহেলিত সম্প্রদায়ের একজন ছিলেন তিনি, কিন্তু জয় করেছিলেন সবার মন। তার চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে বংশপরম্পরায়। চাঁদশী দাশবাড়ি ক্রমে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। লতাপাতা ও গুল্ম ব্যবহার করে ওষুধ বানানো হতো। ওষুধ ব্যবহার ছাড়াও চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করতেন। ডাক্তার বাড়িতে ছিল এক প্রকাণ্ড আটচালা ঘর। সেখানে বহির্বিভাগ বা আউটডোর যেমন ছিল, তেমনি ছিল ৫০টি বেড বা শয্যা_ যেখানে গুরুতর অসুস্থদের ভর্তি করে নেওয়া হতো। হাসপাতালের বেডে থাকার জন্য কিংবা রোগীর সঙ্গে আসা লোকদের থাকার জন্য কোনো ভাড়া দিতে হতো না। একশ' বছরেরও আগে গ্রামে এমন হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল কোন জাদুমন্ত্রে? একটি বাড়ির লোকেরাই এ ব্যবস্থা করেছিল। এখানে আরও একটি তথ্য উল্লেখ করা যায়_ চাঁদশীর দাশ পরিবারের চিকিৎসকরা গ্রামবাসীর কাছ থেকে চিকিৎসার জন্য কোনো অর্থ গ্রহণ করতেন না। যে কোনো ক্ষত রোগ নিরাময়ে চাঁদশীর চিকিৎসকরা সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অর্শ, ভগন্দর, একশিরা, বিখাউজ, ব্রন, ফোড়া, নালী ইত্যাদি পচনশীল ব্যাধির নিরাময়ে ভেষজ ওষুধের গুণাগুণ সম্পর্কে তারা ভালোভাবে অবহিত ছিলেন এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও তা মেনে নিয়েছিলেন। তাদের আবিষ্কৃৃত কয়েক ধরনের মলম খোসপাঁচড়া, ঘা ও চুলকানিতে মোক্ষম দাওয়াই ছিল। কিন্তু কোথায় তা হারিয়ে গেল? এ প্রশ্নও করা যায় যে একটি পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার জন্য ও যে মহাআয়োজন-উদ্যোগ নিয়েছিল, তা থেকে আমাদের সমাজ কি যথাযথ শিক্ষা নিতে পারছে?
এটা ঠিক যে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে। বাজারে এখন মিলছে প্রায় সব রোগের ওষুধ। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা পদ্ধতিতেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এতে মৃত্যুহার কমছে। আয়ুর্বেদ-কবিরাজি বা হেকিমি চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পদ্ধতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যয়ও পড়ে কম। কিন্তু তারপরও এখন এটা স্বীকৃত যে আমাদের দেশে লতাপাতা, গুল্মসহ বনজ সম্পদ ব্যবহার করে তৈরি ওষুধের মধ্যে বেশ কিছু ছিল ধন্বন্তরী ক্ষমতাসম্পন্ন। আমরা কেন তা টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হবো না?
রাজধানী ঢাকায় এখন খেলোয়াড়রা স্পোর্টস মেডিসিনের সহায়তা পায়। মাঠে কেউ আহত হলে পাস করা ফিজিওথেরাপিস্টরা ছুটে যান। উন্নত দেশগুলোতে স্পোর্টস মেডিসিন জনপ্রিয়। নামি-দামি খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষকের পাশাপাশি থাকে নিজস্ব ফিজিও। এক সময়ে মাণ্ডার তেল খুব জনপ্রিয় ও অপরিহার্য ছিল। ঢাকার বাসাবো এলাকার কাছেই মাণ্ডা গ্রাম। চাঁদশীর মতোই এ এলাকার খ্যাতি ছিল হাত-পা ভাঙা কিংবা ব্যথা-বেদনার নিরাময়ে। ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য তেলের পাশাপাশি ছিল বেদনানাশক মালিশের ব্যবস্থা। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, মাদকতা দোষে দুষ্টও নয়। এ 'মহৌষধ' নিয়ে যারা কাজ করেছেন এবং এখনও যারা টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করছেন তাদের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানের একটু ছোঁয়া নিশ্চিত করা গেলে শুধু দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী স্পোর্টস মেডিসিনে বাংলাদেশ হয়তো নতুন কিছু যোগ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী স্পোর্টস মেডিসিন জনপ্রিয় হচ্ছে, একইসঙ্গে জটিলতাও কম নয়। খেলোয়াড়রা ব্যথা-বেদনা কমাতে এমন অনেক ওষুধ ব্যবহার করছেন, যার কিছু অংশ বলবর্ধক এমনকি মাদকতা দোষে দুষ্ট হিসেবে চিহ্নিত এবং এ কারণে নিষিদ্ধের তালিকায়। কেউ তা ব্যবহার করলে আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে ধরা পড়ছে এবং তার পরিণতিতে অনেক সেরা খেলোয়াড়ের সম্ভাবনা হুমকিতে পড়ছে। মাণ্ডার তেল বা মালিশ কিন্তু এ ধরনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত। আমাদের বিজ্ঞানীদের কেউ কি মাণ্ডার তেল নিয়ে সিরিয়াস গবেষণায় আগ্রহ দেখাবেন? বহু বছর এ তেল এবং মালিশ পদ্ধতি যে খেলোয়াড়দের কাছে জনপ্রিয় ছিল, তার নিশ্চয়ই বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। কেন আমরা তা হারিয়ে যেতে দেব?
দেশের আরও অনেক স্থানে 'স্থানীয় চিকিৎসা পদ্ধতি' জনপ্রিয় ছিল। এর সঙ্গে 'ফকিরি-কেরামতি'র বা 'টোটকা চিকিৎসার' মিল খুঁজলে চলবে না। ভেষজ ওষুধ নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। নিমগাছ এখন বিশ্বের বিস্ময়। আরও অনেক ঔষধি গাছে সমৃদ্ধ ছিল আমাদের বনাঞ্চল। এমনকি অনেক বাড়িতেও ছিল মূল্যবান ভেষজ গুণসম্পন্ন গাছপালা। অবহেলায় কিংবা গুণাগুণ সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে নিজেদের সম্পদ আমরা হারিয়ে যেতে দিয়েছি। এখন বিজ্ঞানই বলছে, নিজের প্রতি ফিরে তাকাতে। আমরা পাটের থলি বা ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পলিথিন বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু তা পরিবেশবান্ধব নয়, বরং পরিবেশের জন্য নিদারুণ ক্ষতির কারণ হয়েছে। পাটের উপকারিতা আমরা নতুন করে বুঝতে শুরু করেছি এবং বিশ্বের অনেক দেশও সেটা স্বীকার করছে। এর ফলে সোনালি আঁশ হিসেবে স্বীকৃত যে পাট অনেক বছর কৃষকের গলার ফাঁস বলে মনে হচ্ছিল, তার জন্য সৃষ্টি হতে চলেছে নতুন সম্ভাবনা। কৃষকরা পাট চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন। পাটের দাম মিলছে ভালো। আমাদের বিজ্ঞানীদের একটি দল পাটের জিন-রহস্য ভেদ করেছেন। এর ফলে আরও গুণসম্পন্ন পাট উৎপাদনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পাটের প্রচলিত ব্যবহার, যেমন ব্যাগ ও সুতলি তৈরি_ এর বাইরেও উন্নত মানের পণ্য তৈরির জন্য তা সহায়ক হবে। বিশ্ব বাজারের বিচিত্র ও বহুমুখী চাহিদা পূরণে পাট শিল্প রাখতে পারবে নতুন অবদান। হাসি ফুটবে চাষিদের মুখে। তারা নিজেদের আর অবহেলিত চাষা নয় বরং গণ্য করতে থাকবেন সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলার অপরিহার্য কারিগর হিসেবে। আমরা নিশ্চয়ই এমন সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে চলব না?
চাঁদশীর ক্ষত নিরাময় চিকিৎসা ব্যবস্থা কোনোভাবেই সর্বরোগহর দাওয়াই নয়। মাণ্ডার তেলকেও একইভাবে আমরা দেখব না। কিন্তু আমাদের নিজস্বতা যেখানে, তা যেন আর হেলাফেলা করা না হয়।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments