সময়ের কথা-উচিত-অনুচিত by অজয় দাশগুপ্ত
ভাষাসংগ্রামীদের কেউ কেউ ৬০ টাকার সুন্দর নোটটি বাজারে ছাড়া যায় কি-না তা বিবেচনার অনুরোধ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তবে এ নোটের মূল আবেদন একুশের চেতনা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এ জন্য ডিজাইনাররা কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন।
যারা আমাদের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রেরণা, তাদের সর্বদা স্মরণে রাখা চাই। শুধু ছবি টানিয়ে রেখে নয়, আদর্শ ধারণ করাটাই আসল কথা। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গঠন আমাদের স্বপ্ন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এর বিপরীতটি চেয়েছে। তাদের পরাস্ত করতে একাত্তরে জীবন দিয়েছে ৩০ লাখ বাঙালি
এক যুগ আগে বাংলাদেশে 'ব্যাংকিংয়ের তিন দশক' বিষয়ে একটি কাজে যুক্ত ছিলাম। গবেষণাধর্মী এ কাজে খুব উৎসাহবোধ করেন সে সময়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের কর্ণধার ড. মইনুল ইসলাম। তিনি আমার কাজের ওপর তার প্রতিষ্ঠানে একটি সেমিনার আয়োজন করেন, যেখানে অতিথি ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। এখন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। আমারও ভাবনায় রয়েছে 'বাংলাদেশে ব্যাংকিংয়ের চার দশক' শিরোনামে কিছু কাজ করার। এক যুগ আগে আতিউর রহমান সেমিনারে বলেছিলেন, ব্যাংকের কাজ শুধু আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান নয়। তার রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা, এলাকার প্রতি দায়বদ্ধতা। যে এলাকায় ব্যাংকের শাখা এবং যাদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের কল্যাণের বিষয়টি অবশ্যই বিশেষ বিবেচনায় রাখা চাই। ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্মারক নোট প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গভর্নর এবং অন্য অতিথিদের আলোচনা শুনতে শুনতে ফের এ দায়বদ্ধতা ভাবনায় এলো।
আমাদের অর্থনীতির একটি পরিসংখ্যানে ফিরে যাই। এর উৎস বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকগুলোতে মাত্র ৫টি বেসরকারি অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা কিংবা তার বেশি অর্থ জমা ছিল। এ সংখ্যা ১৯৯৯ সালের শেষে পেঁৗছায় ২১০৫-এ। বেসরকারি অ্যাকাউন্টে ব্যক্তির টাকা জমা থাকে, প্রতিষ্ঠানের টাকাও থাকে। প্রতিষ্ঠানে অনেক ব্যক্তির মালিকানা থাকতে পারে। এ কারণে ব্যাংকে বেসরকারি অ্যাকাউন্ট যাদের রয়েছে তারা সবাই কোটি টাকার মালিক_ এমন সরল ব্যাখ্যা মেলে না। তারপরও অনেকে এমনটি ভাবেন এবং আমার সেমিনারের পর কোনো কোনো সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল : 'বাংলাদেশে ২১০৫ কোটিপতি'। দুই যুগের ব্যবধানে কোটিপতির সংখ্যা ৫ থেকে বেড়ে ২১০৫ হওয়ায় কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, দেশের সম্পদ সীমিত কিছু লোকের হাতে জমা হচ্ছে এবং এর পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে।
এর ঠিক এক যুগ পর আমরা দেখছি : ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দেশের ব্যাংকগুলোতে বেসরকারি খাতের অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে সর্বমোট প্রায় সাড়ে ২২ হাজার অ্যাকাউন্টে। আগের দুই যুগে বেড়েছে ২ হাজার ১০০, পরের এক যুগে ১৯ হাজারের বেশি। এখন কি তাহলে লেখা হবে : 'বাংলাদেশে ২২ হাজারের বেশি কোটিপতি?' দেশে বৈষম্য বাড়ছে_ কিছু লোকের হাতে অঢেল সম্পদ, আবার বিপুল সংখ্যক লোক দরিদ্র ও হতদরিদ্র। এ অবস্থায় ব্যাংকে কোটি টাকার অ্যাকাউন্টকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? ব্যাংকে যে অর্থ জমা থাকে, তার বাইরেও অনেকের সম্পদ থাকে। এখন গুলশান-উত্তরা-ধানমণ্ডিতে ছোট এক খণ্ড জমি যার রয়েছে, তিনিও কিন্তু কোটিপতির সারিতে স্থান পাবেন। 'বনের রাজা ওসমানরা' বালিশের নিচেও কোটি টাকা রেখে দিতে পারেন। দেশের বাইরেও অর্থ পাচারের অনেক ঘটনার কথা শোনা যায়। শেয়ারবাজার থেকেও কিছু লোক অনেক লোককে পথে বসিয়ে মস্ত দাঁও মেরেছেন।
মানুষের ওপর মানুষের শোষণের কারণে কিছু লোকের হাতে অঢেল সম্পদ জমা হয়_ এমন ব্যাখ্যা করাই যায়। আবার কেউ কেউ বলবেন, উপার্জনের সুযোগ বেড়েছে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ঘটছে। বিল গেটস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন আমাদের :এক সময়ে ধনবান হতে হলে বিশাল আয়তনের কলকারখানা কিংবা শত শত একর জমি অথবা খনির মালিক হতে হতো। কিন্তু এখন ছোট একটি ঘরে বসেই কেউ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতে পারে, যদি আয়ত্তে থাকে প্রযুক্তি জ্ঞান এবং উপযুক্ত উপকরণ। ব্যাংকও এমন সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনকি যার পুঁজি নেই বা সামান্য আছে, তার পক্ষেও নিজের ভাগ্য ফেরানো সম্ভব হতে পারে। গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলছিলেন, পেঁয়াজ-মরিচ-রসুন-আদার মতো মসলা জাতীয় পণ্য উৎপাদনের কৃষকদের মাত্র ২ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্গা চাষিরাও ঋণ পাচ্ছেন। কৃষক-ক্ষেতমজুররা মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে পারছেন এবং সরকার তাদের কোনো আর্থিক সুবিধা দিতে চাইলে এ অ্যাকাউন্টে তা জমা পড়ছে। কৃষি খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ভালো করছে, আমাদের যে চাল আমদানি করতে হচ্ছে না, শীতকালে যে মোটামুটি কম দামে আলু-কপি খাওয়া গেছে তার পেছনে এসব সহায়ক কর্মসূচিরও অবদান রয়েছে। ব্যাংক কেবল ধনবানদের ঋণ জোগান দেয়_ এ অপবাদ ঢালাওভাবে দেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি থেকেও উপকৃত হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কয়েকটি এনজিও এ ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজের মধ্যে পড়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন। ব্যাংক ঋণ কাদের দেওয়া হবে, কোন সেক্টরে তা ঢালাওভাবে দেওয়া হবে, কোথায় কখন রাশ টেনে ধরা হবে_ এসব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করে দেয়। এখন যে বিলাসদ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, তার মূলে এই মুদ্রানীতি। কিন্তু সরকারের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা কি এসব মানেন? সমকালে ৩ ফেব্রুয়ারি 'মন্ত্রী-এমপির গাড়িবিলাস' শিরোনামে খবর বের হয়েছিল। এতে বলা হয়, মহাজোট সরকারের আমলে মন্ত্রী-এমপিরা ১৫ মাসে ২২৫টি গাড়ি আমদানি করেছেন। এর মধ্যে ১০৬টি গাড়ি এসেছে, যার প্রতিটির দাম ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা। সমকালের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সারোয়ার সুমন লিখেছেন, 'গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য না থাকলেও দামি গাড়ি আনার প্রতিযোগিতায় মিলেমিশেই হাঁটছেন সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদরা। গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিরা শুল্ক সুবিধা ভোগ করেন এবং এ কারণে সরকার এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।'
এর অন্যদিকও রয়েছে। ১০৬টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা। এর বাইরেও মন্ত্রী-এমপিরা যেসব গাড়ি এনেছেন তার মূল্য হবে আরও অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডারে টানাটানির সময় এ কাজ তো অপরাধের শামিল। যেখানে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নড়বড়ে অবস্থা মজবুত করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ১০০ কোটি ডলার ঋণ চাইছে, সেখানে মন্ত্রী-এমপিদের গাড়িবিলাসে এত বিপুল অর্থ কী করে পাচার হতে পারল? বাংলাদেশ ব্যাংকের করিডোরে একটি কথা শোনা গেল_ কোনো এক আমদানিকারক ৬-৭ লাখ টন খেজুর আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ চাইছেন। কারও বা দাবি_ মালয়েশিয়া থেকে রুটি ও চিনি মাখানো আনারস ও আম আমদানির এলসি খুলতে ডলার দিতে হবে। এ জন্য ওপর থেকে চাপও সৃষ্টি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এখন বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারে কড়াকড়ি করায় এ মহল নাখোশ। যেমন তারা নাখোশ হয়েছিল 'শেয়ারবাজার অযৌক্তিকভাবে তেজি' এমন হুশিয়ারি দেওয়ায়। সে সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক সাবেক সভাপতির সম্পূর্ণ অযৌক্তিক অভিযোগ টেলিভিশনে প্রচার হয় : 'গভর্নর বিনিয়োগকারীদের পেটে লাথি মারছেন'।
অর্থনীতি ভালো থাকলে উদার আমদানিতে তেমন ভাবনা হয় না। এখন ভাবতে হয়। কারণ বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় ভাড়াভিত্তিক ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল দরকার হয়। এ জন্য প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। তার জোগানে ডলারের ভাণ্ডারে প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। মন্ত্রী-এমপিদের এসব নিয়ে কোনো ভাবনা থাকতে নেই যে! বিদ্যুৎ কোম্পানির বেসরকারি মালিকরা ডিজেল-ফার্নেস অয়েলের জন্য সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পায়। এই ভর্তুকি পাওয়া তেলের কিছু অংশ যদি হিসাবের কারচুপিতে আত্মসাৎ হয়? এমন অভিযোগ উঠেছে এবং এর নিষ্পত্তি সরকার করবে কি?
ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর উপলক্ষে স্মারক নোট প্রকাশের সঙ্গে অর্থনীতির এসব জটিল বিষয়ের সম্পর্ক কী_ সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত স্মারক নোটটিতে রয়েছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অবিনাশী গানের প্রথম দুটি লাইন : 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি'। নোটের পেছন দিকে এ গৌরবের আন্দোলনের পাঁচ শহীদ আবুল বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর ও সালামের ছবি রয়েছে। পাঁচ জনের ছবির মাঝে রয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারির মূল ঘটনাস্থলে (বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অঙ্গন) নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের ছবি। রাতারাতি গড়ে তোলা এ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে পরদিন ভোর থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল। আর তাতে ভয় পেয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রচণ্ড উন্মত্ততায় ভেঙে দেয় শহীদ মিনারটি। কিন্তু কোটি কোটি বাঙালির মনে তাদের প্রিয় ভাষার প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, সেটা কোনোভাবেই যে মুছে ফেলা যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক একুশের সেই সাহস ও গৌরবের সময় তুলে ধরার জন্য মহৎ উদ্যোগ নিয়েছে। আমাকেসহ সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের এ স্মারক নোট উপহার দেওয়া হয়। নোটে উল্লেখ রয়েছে 'বিনিময়যোগ্য নয়'। বাজারে যেসব নোট চালু তাতে লেখা থাকে : 'চাহিবামাত্র ইহার বাহককে ... টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে'। শূন্য স্থানে এক হাজার, পাঁচ শত, এক শত_ এভাবে টাকার অঙ্ক উল্লেখ থাকে। ৬০ টাকার নোট বাংলাদেশে চালু নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধের মতো গৌরব ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠানের ছবিযুক্ত নোট চালু রয়েছে। কয়েক ধরনের নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি রয়েছে। ভাষাসংগ্রামীদের কেউ কেউ ৬০ টাকার সুন্দর নোটটি বাজারে ছাড়া যায় কি-না তা বিবেচনার অনুরোধ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তবে এ নোটের মূল আবেদন একুশের চেতনা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এ জন্য ডিজাইনাররা কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন। যারা আমাদের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রেরণা, তাদের সর্বদা স্মরণে রাখা চাই। শুধু ছবি টানিয়ে রেখে নয়, আদর্শ ধারণ করাটাই আসল কথা। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গঠন আমাদের স্বপ্ন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এর বিপরীতটি চেয়েছে। তাদের পরাস্ত করতে একাত্তরে জীবন দিয়েছে ৩০ লাখ বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধে লড়েছে লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র। এত আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশে এমপি-মন্ত্রীদের এ ধরনের গাড়িবিলাস কিংবা শেয়ারবাজারের লুটেরাদের আস্ফালন একেবারেই বেমানান।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
এক যুগ আগে বাংলাদেশে 'ব্যাংকিংয়ের তিন দশক' বিষয়ে একটি কাজে যুক্ত ছিলাম। গবেষণাধর্মী এ কাজে খুব উৎসাহবোধ করেন সে সময়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের কর্ণধার ড. মইনুল ইসলাম। তিনি আমার কাজের ওপর তার প্রতিষ্ঠানে একটি সেমিনার আয়োজন করেন, যেখানে অতিথি ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। এখন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। আমারও ভাবনায় রয়েছে 'বাংলাদেশে ব্যাংকিংয়ের চার দশক' শিরোনামে কিছু কাজ করার। এক যুগ আগে আতিউর রহমান সেমিনারে বলেছিলেন, ব্যাংকের কাজ শুধু আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান নয়। তার রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা, এলাকার প্রতি দায়বদ্ধতা। যে এলাকায় ব্যাংকের শাখা এবং যাদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের কল্যাণের বিষয়টি অবশ্যই বিশেষ বিবেচনায় রাখা চাই। ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্মারক নোট প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গভর্নর এবং অন্য অতিথিদের আলোচনা শুনতে শুনতে ফের এ দায়বদ্ধতা ভাবনায় এলো।
আমাদের অর্থনীতির একটি পরিসংখ্যানে ফিরে যাই। এর উৎস বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকগুলোতে মাত্র ৫টি বেসরকারি অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা কিংবা তার বেশি অর্থ জমা ছিল। এ সংখ্যা ১৯৯৯ সালের শেষে পেঁৗছায় ২১০৫-এ। বেসরকারি অ্যাকাউন্টে ব্যক্তির টাকা জমা থাকে, প্রতিষ্ঠানের টাকাও থাকে। প্রতিষ্ঠানে অনেক ব্যক্তির মালিকানা থাকতে পারে। এ কারণে ব্যাংকে বেসরকারি অ্যাকাউন্ট যাদের রয়েছে তারা সবাই কোটি টাকার মালিক_ এমন সরল ব্যাখ্যা মেলে না। তারপরও অনেকে এমনটি ভাবেন এবং আমার সেমিনারের পর কোনো কোনো সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল : 'বাংলাদেশে ২১০৫ কোটিপতি'। দুই যুগের ব্যবধানে কোটিপতির সংখ্যা ৫ থেকে বেড়ে ২১০৫ হওয়ায় কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, দেশের সম্পদ সীমিত কিছু লোকের হাতে জমা হচ্ছে এবং এর পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে।
এর ঠিক এক যুগ পর আমরা দেখছি : ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দেশের ব্যাংকগুলোতে বেসরকারি খাতের অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে সর্বমোট প্রায় সাড়ে ২২ হাজার অ্যাকাউন্টে। আগের দুই যুগে বেড়েছে ২ হাজার ১০০, পরের এক যুগে ১৯ হাজারের বেশি। এখন কি তাহলে লেখা হবে : 'বাংলাদেশে ২২ হাজারের বেশি কোটিপতি?' দেশে বৈষম্য বাড়ছে_ কিছু লোকের হাতে অঢেল সম্পদ, আবার বিপুল সংখ্যক লোক দরিদ্র ও হতদরিদ্র। এ অবস্থায় ব্যাংকে কোটি টাকার অ্যাকাউন্টকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? ব্যাংকে যে অর্থ জমা থাকে, তার বাইরেও অনেকের সম্পদ থাকে। এখন গুলশান-উত্তরা-ধানমণ্ডিতে ছোট এক খণ্ড জমি যার রয়েছে, তিনিও কিন্তু কোটিপতির সারিতে স্থান পাবেন। 'বনের রাজা ওসমানরা' বালিশের নিচেও কোটি টাকা রেখে দিতে পারেন। দেশের বাইরেও অর্থ পাচারের অনেক ঘটনার কথা শোনা যায়। শেয়ারবাজার থেকেও কিছু লোক অনেক লোককে পথে বসিয়ে মস্ত দাঁও মেরেছেন।
মানুষের ওপর মানুষের শোষণের কারণে কিছু লোকের হাতে অঢেল সম্পদ জমা হয়_ এমন ব্যাখ্যা করাই যায়। আবার কেউ কেউ বলবেন, উপার্জনের সুযোগ বেড়েছে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ঘটছে। বিল গেটস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন আমাদের :এক সময়ে ধনবান হতে হলে বিশাল আয়তনের কলকারখানা কিংবা শত শত একর জমি অথবা খনির মালিক হতে হতো। কিন্তু এখন ছোট একটি ঘরে বসেই কেউ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতে পারে, যদি আয়ত্তে থাকে প্রযুক্তি জ্ঞান এবং উপযুক্ত উপকরণ। ব্যাংকও এমন সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনকি যার পুঁজি নেই বা সামান্য আছে, তার পক্ষেও নিজের ভাগ্য ফেরানো সম্ভব হতে পারে। গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলছিলেন, পেঁয়াজ-মরিচ-রসুন-আদার মতো মসলা জাতীয় পণ্য উৎপাদনের কৃষকদের মাত্র ২ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্গা চাষিরাও ঋণ পাচ্ছেন। কৃষক-ক্ষেতমজুররা মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে পারছেন এবং সরকার তাদের কোনো আর্থিক সুবিধা দিতে চাইলে এ অ্যাকাউন্টে তা জমা পড়ছে। কৃষি খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ভালো করছে, আমাদের যে চাল আমদানি করতে হচ্ছে না, শীতকালে যে মোটামুটি কম দামে আলু-কপি খাওয়া গেছে তার পেছনে এসব সহায়ক কর্মসূচিরও অবদান রয়েছে। ব্যাংক কেবল ধনবানদের ঋণ জোগান দেয়_ এ অপবাদ ঢালাওভাবে দেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি থেকেও উপকৃত হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কয়েকটি এনজিও এ ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজের মধ্যে পড়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন। ব্যাংক ঋণ কাদের দেওয়া হবে, কোন সেক্টরে তা ঢালাওভাবে দেওয়া হবে, কোথায় কখন রাশ টেনে ধরা হবে_ এসব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করে দেয়। এখন যে বিলাসদ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, তার মূলে এই মুদ্রানীতি। কিন্তু সরকারের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা কি এসব মানেন? সমকালে ৩ ফেব্রুয়ারি 'মন্ত্রী-এমপির গাড়িবিলাস' শিরোনামে খবর বের হয়েছিল। এতে বলা হয়, মহাজোট সরকারের আমলে মন্ত্রী-এমপিরা ১৫ মাসে ২২৫টি গাড়ি আমদানি করেছেন। এর মধ্যে ১০৬টি গাড়ি এসেছে, যার প্রতিটির দাম ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা। সমকালের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সারোয়ার সুমন লিখেছেন, 'গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য না থাকলেও দামি গাড়ি আনার প্রতিযোগিতায় মিলেমিশেই হাঁটছেন সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদরা। গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিরা শুল্ক সুবিধা ভোগ করেন এবং এ কারণে সরকার এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।'
এর অন্যদিকও রয়েছে। ১০৬টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা। এর বাইরেও মন্ত্রী-এমপিরা যেসব গাড়ি এনেছেন তার মূল্য হবে আরও অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডারে টানাটানির সময় এ কাজ তো অপরাধের শামিল। যেখানে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নড়বড়ে অবস্থা মজবুত করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ১০০ কোটি ডলার ঋণ চাইছে, সেখানে মন্ত্রী-এমপিদের গাড়িবিলাসে এত বিপুল অর্থ কী করে পাচার হতে পারল? বাংলাদেশ ব্যাংকের করিডোরে একটি কথা শোনা গেল_ কোনো এক আমদানিকারক ৬-৭ লাখ টন খেজুর আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ চাইছেন। কারও বা দাবি_ মালয়েশিয়া থেকে রুটি ও চিনি মাখানো আনারস ও আম আমদানির এলসি খুলতে ডলার দিতে হবে। এ জন্য ওপর থেকে চাপও সৃষ্টি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এখন বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারে কড়াকড়ি করায় এ মহল নাখোশ। যেমন তারা নাখোশ হয়েছিল 'শেয়ারবাজার অযৌক্তিকভাবে তেজি' এমন হুশিয়ারি দেওয়ায়। সে সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক সাবেক সভাপতির সম্পূর্ণ অযৌক্তিক অভিযোগ টেলিভিশনে প্রচার হয় : 'গভর্নর বিনিয়োগকারীদের পেটে লাথি মারছেন'।
অর্থনীতি ভালো থাকলে উদার আমদানিতে তেমন ভাবনা হয় না। এখন ভাবতে হয়। কারণ বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় ভাড়াভিত্তিক ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল দরকার হয়। এ জন্য প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। তার জোগানে ডলারের ভাণ্ডারে প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। মন্ত্রী-এমপিদের এসব নিয়ে কোনো ভাবনা থাকতে নেই যে! বিদ্যুৎ কোম্পানির বেসরকারি মালিকরা ডিজেল-ফার্নেস অয়েলের জন্য সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পায়। এই ভর্তুকি পাওয়া তেলের কিছু অংশ যদি হিসাবের কারচুপিতে আত্মসাৎ হয়? এমন অভিযোগ উঠেছে এবং এর নিষ্পত্তি সরকার করবে কি?
ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর উপলক্ষে স্মারক নোট প্রকাশের সঙ্গে অর্থনীতির এসব জটিল বিষয়ের সম্পর্ক কী_ সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত স্মারক নোটটিতে রয়েছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অবিনাশী গানের প্রথম দুটি লাইন : 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি'। নোটের পেছন দিকে এ গৌরবের আন্দোলনের পাঁচ শহীদ আবুল বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর ও সালামের ছবি রয়েছে। পাঁচ জনের ছবির মাঝে রয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারির মূল ঘটনাস্থলে (বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অঙ্গন) নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের ছবি। রাতারাতি গড়ে তোলা এ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে পরদিন ভোর থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল। আর তাতে ভয় পেয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রচণ্ড উন্মত্ততায় ভেঙে দেয় শহীদ মিনারটি। কিন্তু কোটি কোটি বাঙালির মনে তাদের প্রিয় ভাষার প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, সেটা কোনোভাবেই যে মুছে ফেলা যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক একুশের সেই সাহস ও গৌরবের সময় তুলে ধরার জন্য মহৎ উদ্যোগ নিয়েছে। আমাকেসহ সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের এ স্মারক নোট উপহার দেওয়া হয়। নোটে উল্লেখ রয়েছে 'বিনিময়যোগ্য নয়'। বাজারে যেসব নোট চালু তাতে লেখা থাকে : 'চাহিবামাত্র ইহার বাহককে ... টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে'। শূন্য স্থানে এক হাজার, পাঁচ শত, এক শত_ এভাবে টাকার অঙ্ক উল্লেখ থাকে। ৬০ টাকার নোট বাংলাদেশে চালু নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধের মতো গৌরব ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠানের ছবিযুক্ত নোট চালু রয়েছে। কয়েক ধরনের নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি রয়েছে। ভাষাসংগ্রামীদের কেউ কেউ ৬০ টাকার সুন্দর নোটটি বাজারে ছাড়া যায় কি-না তা বিবেচনার অনুরোধ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তবে এ নোটের মূল আবেদন একুশের চেতনা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এ জন্য ডিজাইনাররা কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন। যারা আমাদের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রেরণা, তাদের সর্বদা স্মরণে রাখা চাই। শুধু ছবি টানিয়ে রেখে নয়, আদর্শ ধারণ করাটাই আসল কথা। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গঠন আমাদের স্বপ্ন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এর বিপরীতটি চেয়েছে। তাদের পরাস্ত করতে একাত্তরে জীবন দিয়েছে ৩০ লাখ বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধে লড়েছে লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র। এত আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশে এমপি-মন্ত্রীদের এ ধরনের গাড়িবিলাস কিংবা শেয়ারবাজারের লুটেরাদের আস্ফালন একেবারেই বেমানান।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments