সমঝোতা দুই দেশেরই দরকার by আকবর আলি খান
তিস্তা চুক্তি নিয়ে সম্প্রতি যেসব নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে, তা থেকে আমাদের দুটি শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, ভারত একটি বহুস্তরবিশিষ্ট গণতন্ত্র। ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় শুধু কেন্দ্রীয় নির্বাহী কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া বহুস্তরবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হলেও অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য হয়।
বাংলাদেশের বেলায় দেখা যায়, আন্তর্জাতিক চুক্তি হওয়ার আগে সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা অত্যন্ত সীমিত থাকে। এবং তাতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগও নেই বললেই চলে। অনেক সময় বিষয়টি সংসদ পর্যন্তও যায় না।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাই, তিনি আমাদের একটি বড় সত্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেটা হলো এই: ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বন্ধুত্ব হলেও, জাতিগত সম্প্রীতি থাকলেও, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বন্ধুত্বের ভিত্তিতে হয় না—তা সব সময় স্বার্থের ভিত্তিতেই হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে চুক্তিই করা হোক না কেন, তাতে দেশের স্বার্থ প্রাধান্য লাভ করতে হবে, এ ক্ষেত্রে তাঁর দেশ ভারতের স্বার্থ তিনি দেখেছেন। এ থেকে এই শিক্ষাই পাওয়া গেল যে, যদি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পন্ন হয়, তাহলেই আমরা বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারব।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পর্কে যেসব আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে গণমাধ্যমে যেসব তথ্য আমরা পাচ্ছি, তা নিতান্তই অপ্রতুল। তা হলেও আমাদের কাছে যা মনে হয় তা হলো, তিস্তার সমস্যা শুধু পানি বণ্টনের সমস্যা নয়, তিস্তা অববাহিকা অঞ্চল এখন একটি ব্যাপক পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
প্রথমত, তিস্তা অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন, ততটা পানি নেই। জলাধার নির্মাণ করে বর্ষার পানি জমিয়ে না রাখলে পরে এ সমস্যার সমাধান হবে না। দ্বিতীয়ত, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় বর্তমানে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তা দিয়ে তিস্তা নদী বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। অথচ বর্ষার সময় তিস্তায় প্রচণ্ড জলপ্রবাহ অবশ্যই আসবে। এর ফলে তিস্তা অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার প্রকোপ বেড়ে যাবে। এর জন্য প্রয়োজন ভারত-বাংলাদেশের সমন্বিত কর্মসূচি।
তৃতীয়ত, ভারত ঘোষণা করেছে, তিস্তার উজান অঞ্চলে, ভারতের সিকিম প্রদেশে ৫০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। তিস্তার পানিতে পলির পরিমাণ খুবই বেশি। তাই জলবিদ্যুতের জন্য যেসব জলাধার নির্মাণ করা হবে, সেগুলোয় পলির আধিক্যের ফলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কাজেই বিষয়টি সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। তিস্তার পানি বণ্টন সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র।
তিস্তার জন্য চীনের মেকং রিভার কমিশনের মতো একটি কমিশন গড়ে তুলতে হবে। এই কমিশনে চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস একযোগে তাদের অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহের বণ্টন এবং মেকং নদী ও মেকং অববাহিকা অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদেরও অনুরূপ একটি কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে তিস্তা অববাহিকার সামগ্রিক উন্নয়ন করা সম্ভব হয়। এবং তা কেবল কাগুজে পদক্ষেপ হলেই চলবে না, তার আন্তরিক বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ধরনের সহযোগিতার রূপায়ণ হলে তিস্তা অববাহিকায় টেকসই পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। বিশেষত, অতিমাত্রায় সেচের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সামনে অসহায় অবস্থায় পতিত হবে।
সার্বিক বিচারে তিস্তা নিয়ে জনকল্যাণমুখী সুষম সমঝোতা না হলে ভারত ও বাংলাদেশ—উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ড. আকবর আলি খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাই, তিনি আমাদের একটি বড় সত্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেটা হলো এই: ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বন্ধুত্ব হলেও, জাতিগত সম্প্রীতি থাকলেও, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বন্ধুত্বের ভিত্তিতে হয় না—তা সব সময় স্বার্থের ভিত্তিতেই হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে চুক্তিই করা হোক না কেন, তাতে দেশের স্বার্থ প্রাধান্য লাভ করতে হবে, এ ক্ষেত্রে তাঁর দেশ ভারতের স্বার্থ তিনি দেখেছেন। এ থেকে এই শিক্ষাই পাওয়া গেল যে, যদি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পন্ন হয়, তাহলেই আমরা বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারব।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পর্কে যেসব আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে গণমাধ্যমে যেসব তথ্য আমরা পাচ্ছি, তা নিতান্তই অপ্রতুল। তা হলেও আমাদের কাছে যা মনে হয় তা হলো, তিস্তার সমস্যা শুধু পানি বণ্টনের সমস্যা নয়, তিস্তা অববাহিকা অঞ্চল এখন একটি ব্যাপক পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
প্রথমত, তিস্তা অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন, ততটা পানি নেই। জলাধার নির্মাণ করে বর্ষার পানি জমিয়ে না রাখলে পরে এ সমস্যার সমাধান হবে না। দ্বিতীয়ত, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় বর্তমানে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তা দিয়ে তিস্তা নদী বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। অথচ বর্ষার সময় তিস্তায় প্রচণ্ড জলপ্রবাহ অবশ্যই আসবে। এর ফলে তিস্তা অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার প্রকোপ বেড়ে যাবে। এর জন্য প্রয়োজন ভারত-বাংলাদেশের সমন্বিত কর্মসূচি।
তৃতীয়ত, ভারত ঘোষণা করেছে, তিস্তার উজান অঞ্চলে, ভারতের সিকিম প্রদেশে ৫০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। তিস্তার পানিতে পলির পরিমাণ খুবই বেশি। তাই জলবিদ্যুতের জন্য যেসব জলাধার নির্মাণ করা হবে, সেগুলোয় পলির আধিক্যের ফলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কাজেই বিষয়টি সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। তিস্তার পানি বণ্টন সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র।
তিস্তার জন্য চীনের মেকং রিভার কমিশনের মতো একটি কমিশন গড়ে তুলতে হবে। এই কমিশনে চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস একযোগে তাদের অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহের বণ্টন এবং মেকং নদী ও মেকং অববাহিকা অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদেরও অনুরূপ একটি কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে তিস্তা অববাহিকার সামগ্রিক উন্নয়ন করা সম্ভব হয়। এবং তা কেবল কাগুজে পদক্ষেপ হলেই চলবে না, তার আন্তরিক বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ধরনের সহযোগিতার রূপায়ণ হলে তিস্তা অববাহিকায় টেকসই পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। বিশেষত, অতিমাত্রায় সেচের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সামনে অসহায় অবস্থায় পতিত হবে।
সার্বিক বিচারে তিস্তা নিয়ে জনকল্যাণমুখী সুষম সমঝোতা না হলে ভারত ও বাংলাদেশ—উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ড. আকবর আলি খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব।
No comments