ইতিউতি-বাজেট আসে-যায়, মূল্যস্ফীতি থাকে by আতাউস সামাদ
বছর ঘুরে, সরকার বাজেট দেয়। তখন সরকার যে ট্যাঙ্ বসায় সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসের মধ্যে আমরা সেই অনুযায়ী আয়কর দিই। আর আমরা প্রতিবছর, প্রতিদিন দেশের সবাই দিচ্ছি ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর। গত পরশু সন্ধ্যায় চ্যানেল আইতে বাজেট-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে প্রতিবেদক মন্তব্য করলেন, 'আয়কর যেমন সরাসরি কর, মূল্য সংযোজন করও (মূসক ভ্যাট) তেমনি প্রত্যক্ষ কর।' ভালো লাগল তাঁর মন্তব্যটি।
আমরা সবাই করদাতা রাজার রাজত্বে। আমি নিজেও বিশ্বাস করি, যখন থেকে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বাংলাদেশে মূসক চালু করেছেন, তখন থেকে দেশের সবাই সরকারকে ট্যাঙ্ দিচ্ছেন, কারণ যা কিছুর ওপর ভ্যাট বসানো আছে, তা যিনিই কিনছেন তিনিই সরকারকে সরাসরি কর দিচ্ছেন।
ট্যাঙ্ আদায়ের ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের হেরফের হয় না। ট্যাঙ্ আদায় হবেই হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর কিছুদিন পরপরই ঘোষণা দেয় তাদের কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। কখনো কখনো তাঁরা খুশি হয়ে এও বলেন যে ট্যাঙ্ আদায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের জন্য এটা একটা সুখবর। তবে ওই খবর প্রচারিত হওয়ার অল্প কয়েক দিনের ভেতরই আসে দুঃসংবাদ। সরকারের খরচ বেড়ে গেছে, কাজেই যে ট্যাঙ্ আদায় হয়েছে, তা দিয়ে চলবে না। এখন দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে।
আমরা তখন চিন্তায় পড়ি, জনগণের জীবনযাপন, কাজকর্মের সুবিধা করার জন্য যেসব উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছিল, সেগুলো হবে তো! সেগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারবে কি সরকার? এ ছাড়া আরেকটা দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়, সরকার যদি তার খরচ মেটানোর জন্য আরো ট্যাঙ্ বসায় তাহলে জরুরি জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়ে যাবে না তো?
ওইসব ভয়ের মধ্যে থাকতে থাকতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই পাড়ার ভাঙা রাস্তা আর তার মাঝে ডোবাতুল্য পানিভর্তি গর্ত লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে পথ চলতে, ডেঙ্গু মশা এডিসের কামড় খাই নির্বিবাদে। দূষিত পানি পান করে ডায়রিয়া নিয়ে ছুটে যাই আইসিডিডিআর-বিতে। ওটার পুরনো নাম কলেরা হাসপাতাল জনগণের মুখে মুখে আবার ফেরত আসছে। অন্য অসুখ হলে সরকারি হাসপাতালে জায়গা পাব না বলে শেষ সঞ্চয় নিয়ে বা টাকা ধার করে ছুটতে হয় বেসরকারি তথাকথিত হাসপাতালে, যেখানে হাঁচি দেওয়ার জন্য কাগজের ন্যাপকিন পেতে হলেও পয়সা দিতে হয়, আর তার সঙ্গে দিতে হয় ভ্যাট। অন্যদিকে সুস্থ থাকলে কাজে যাওয়ার সময় মাথা ধরে যায়, বাসে উঠতে পারব কি না সেই চিন্তায়। যদি বাস পাই তাহলেও দুশ্চিন্তা হতে থাকে_'আজকে জানি কত বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়।' সেই বাসের জন্য ছোটাছুটি করার আগেই সকালে বাজার করে বারবার শরীর হিম করা সব অভিজ্ঞতা হয় জিনিসপত্রের দাম শুনে। আমি নিজে বুড়িয়ে গেছি বলে আমাকে বাজার করতে যেতে দেওয়া হয় না। তবে নিজের ঘরে বসেই যখন গিনি্নকে বাজারের হিসাব নিতে শুনি, রোজকার খাবারদাবার বা নিয়মিত প্রয়োজন এমন ওষুধপত্রের দাম শুনি, তখন আপনা থেকেই ভাবনা এসে যায় এ মাসে বাড়তি কিছু টাকা আয় করব কী লিখে। লিখবই বা আর কত। এখন তো আঙুলগুলোও শক্ত হয়ে আসছে। কলম ধরে রাখতেও অসুবিধা হয়। এরই মাঝে সেদিন পথের পাশের দোকানে বেশ পুষ্ট শবরি কলা দেখে কিনতে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু দোকানি বললেন কী? একেকটা কলার দাম ছয় টাকা। চমকে গেলাম। তবে দাম করে ফেলেছি, হটি কী করে। এক হালি, মানে চারটা কলা কিনেই ফেললাম। দোকানি এককথার মানুষ। চবি্বশ টাকা নিয়েই ছাড়লেন। বাড়িতে এসে আরেক দফা হাঁ-হুতাশ। চারটি কলার মধ্যে একটা একেবারেই মজে গেছে। ওটা গেলার লোক নেই বাড়িতে। অতঃপর খাওয়া গেল তিনটা কলা। তাহলে প্রকৃত দাম পড়ল চবি্বশ টাকা ভাগ তিন সমান আট টাকা একেকটা। এবার ভাবছি বাংলা ভাষা থেকে 'দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষা' কথাটা অপ্রযোজ্য হয়ে অব্যবহারে বিস্মৃত হবে আর ক'দিনের ভেতর?
এবারের বাজেট কেমন হলো? আমি তার কী জানি! আমি মন্ত্রী না যে বলব, 'এবারের বাজেট যুগান্তকারী।' যে দলই বা যারাই সরকারে থাকুক না, যিনি কোনো মন্ত্রী তিনি অবশ্যই বলবেন, 'প্রধানমন্ত্রীর কৃপায় ও দিকনির্দেশনায় অর্থমন্ত্রী যুগান্তকারী বাজেট ঘোষণা করেছেন।' আর যাঁরা বিরোধী দলে তাঁরা বলবেন, 'এ বাজেট অর্থহীন। উন্নয়নের কোনো সুস্পষ্ট পথ দেখা যাচ্ছে না এতে।' আর যাঁরা বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি তাঁরা বলবেন, 'সময়টা জটিল, তবে সদিচ্ছা থাকলে এর মধ্যেও এই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব।' এ মন্তব্য যাঁরা করেন তাঁরা অবশ্য অতীব ভদ্র ও বিনয়ী বিধায় কিঞ্চিৎ অসত্য বলেন। তাঁরা খুব ভালো মতোই জানেন, বাজেটে যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থাকে সেটা অতীতে কখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, চলতি অর্থবছরেও হচ্ছে না এবং সামনের বারও তা হবে না। আর মূল্যস্ফীতি? সে তো অপ্রতিরোধ্য। এখন কোনো বাজেটদাতার ক্ষমতা নেই তা ঠেকানোর। আমাদের যারা বাজেট দেন সম্ভবত তাদের ইচ্ছা-শক্তিও লোপ পেয়েছে। শুধু টেলিভিশন বা রেডিওতে শুনে বাজেট সম্পর্কে মূল্যায়ন করা যায় না। তা ছাড়া অর্থমন্ত্রীদের ভাষণ আর বাজেট এক কথা নয়। বাজেট দলিলে আরো অনেক কিছু থাকে, যার প্রতিক্রিয়া দিন কয়েক পরে অনুভব করা যায়। তা ছাড়া সরকারের হাতে এসআরও (ঝজঙ) নামে এক অস্ত্র আছে, যা দিয়ে পার্লামেন্টে পাস হওয়া কর প্রস্তাবের পরও বাড়তি ট্যাঙ্ বসানো যায়। সরকার তা করেও থাকে। কাজেই বাজেট নামে যা দেখা গেল সেটাই বাজেটের সবটা নয়। অর্থবছরের শেষে সংশোধিত বাজেট যখন পেশ হবে তখন বোঝা যায় আসলে বাজেট কী ছিল।
তবে গত পরশু (বৃহস্পতিবার) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে বিশাল বাজেট ঘোষণা করলেন তাতে ঘাটতিও খুব বড়। অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন যে ঘাটতি বাজেট বাস্তবায়ন করতে যেসব প্রক্রিয়ায় সরকারকে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়, তাতে মূল্যস্ফীতি ঘটে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এবারের প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না। অনিচ্ছায় হলেও তাঁর সঙ্গে আমি একমত। আমার মনে হয়_প্রথমত, 'ডেফিসিট ফিন্যান্সিং'-এর চাপে মূল্যস্ফীতি হবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার দাম পড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। দুঃখজনক হলেও এ কথা তো সত্যি, বাংলাদেশকে চাল, ডাল, তেল, জ্বালানি, কাপড়, তুলা, লোহালক্কড়, ভারী যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, কাঠ, বই সবই আমদানি করতে হয়। আমদানিনির্ভর এই অর্থনীতিতে যদি দেশি টাকার দাম পড়ে যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিবারের মতো এবারও কিছু সামগ্রীর ওপর কর বাড়ানো হয়েছে, কিছু জিনিসের কর কমানো হয়েছে। দিন কয়েক পর হয়তো হিসাব করা যাবে যে মোট ফলাফল কী হলো। তবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, টায়ার ও ব্যাটারির ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়া আরেক দফা বাড়িয়ে দেওয়ার একটা অজুহাত পাবেন বাস-ট্রাক মালিকরা।
ঢাকা শহরে এখন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার আছে যাদের উপার্জনকারীরা প্রতিদিনের খাবার, বাজারের টাকা যোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে। খাদ্য কেনার খরচ মেটানোর পর তাদের দুশ্চিন্তা থাকে বাড়ি ভাড়া জোগাড় হবে কোথা থেকে। সরকারের বাজেট ২০১১-১২ তাদের জন্য কোনো স্বস্তি এনেছে কি? মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘরে বসে থাকলে সে স্বস্তি আসার সম্ভাবনা কম। পল্লী অঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে বেশি হয়েছে। এ মুহূর্তে কৃষকের ঘরে বোরো ধান আছে বলে তাদের ওপর বাড়তি অর্থ জোগাড় করার সরাসরি চাপ একটু কম। তবে আমন ধান ওঠার আগে তারা আবার চাপের মধ্যে পড়বে, যদি মূল্যস্ফীতি হতেই থাকে।
লখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ট্যাঙ্ আদায়ের ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের হেরফের হয় না। ট্যাঙ্ আদায় হবেই হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর কিছুদিন পরপরই ঘোষণা দেয় তাদের কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। কখনো কখনো তাঁরা খুশি হয়ে এও বলেন যে ট্যাঙ্ আদায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের জন্য এটা একটা সুখবর। তবে ওই খবর প্রচারিত হওয়ার অল্প কয়েক দিনের ভেতরই আসে দুঃসংবাদ। সরকারের খরচ বেড়ে গেছে, কাজেই যে ট্যাঙ্ আদায় হয়েছে, তা দিয়ে চলবে না। এখন দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে।
আমরা তখন চিন্তায় পড়ি, জনগণের জীবনযাপন, কাজকর্মের সুবিধা করার জন্য যেসব উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছিল, সেগুলো হবে তো! সেগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারবে কি সরকার? এ ছাড়া আরেকটা দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়, সরকার যদি তার খরচ মেটানোর জন্য আরো ট্যাঙ্ বসায় তাহলে জরুরি জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়ে যাবে না তো?
ওইসব ভয়ের মধ্যে থাকতে থাকতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই পাড়ার ভাঙা রাস্তা আর তার মাঝে ডোবাতুল্য পানিভর্তি গর্ত লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে পথ চলতে, ডেঙ্গু মশা এডিসের কামড় খাই নির্বিবাদে। দূষিত পানি পান করে ডায়রিয়া নিয়ে ছুটে যাই আইসিডিডিআর-বিতে। ওটার পুরনো নাম কলেরা হাসপাতাল জনগণের মুখে মুখে আবার ফেরত আসছে। অন্য অসুখ হলে সরকারি হাসপাতালে জায়গা পাব না বলে শেষ সঞ্চয় নিয়ে বা টাকা ধার করে ছুটতে হয় বেসরকারি তথাকথিত হাসপাতালে, যেখানে হাঁচি দেওয়ার জন্য কাগজের ন্যাপকিন পেতে হলেও পয়সা দিতে হয়, আর তার সঙ্গে দিতে হয় ভ্যাট। অন্যদিকে সুস্থ থাকলে কাজে যাওয়ার সময় মাথা ধরে যায়, বাসে উঠতে পারব কি না সেই চিন্তায়। যদি বাস পাই তাহলেও দুশ্চিন্তা হতে থাকে_'আজকে জানি কত বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়।' সেই বাসের জন্য ছোটাছুটি করার আগেই সকালে বাজার করে বারবার শরীর হিম করা সব অভিজ্ঞতা হয় জিনিসপত্রের দাম শুনে। আমি নিজে বুড়িয়ে গেছি বলে আমাকে বাজার করতে যেতে দেওয়া হয় না। তবে নিজের ঘরে বসেই যখন গিনি্নকে বাজারের হিসাব নিতে শুনি, রোজকার খাবারদাবার বা নিয়মিত প্রয়োজন এমন ওষুধপত্রের দাম শুনি, তখন আপনা থেকেই ভাবনা এসে যায় এ মাসে বাড়তি কিছু টাকা আয় করব কী লিখে। লিখবই বা আর কত। এখন তো আঙুলগুলোও শক্ত হয়ে আসছে। কলম ধরে রাখতেও অসুবিধা হয়। এরই মাঝে সেদিন পথের পাশের দোকানে বেশ পুষ্ট শবরি কলা দেখে কিনতে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু দোকানি বললেন কী? একেকটা কলার দাম ছয় টাকা। চমকে গেলাম। তবে দাম করে ফেলেছি, হটি কী করে। এক হালি, মানে চারটা কলা কিনেই ফেললাম। দোকানি এককথার মানুষ। চবি্বশ টাকা নিয়েই ছাড়লেন। বাড়িতে এসে আরেক দফা হাঁ-হুতাশ। চারটি কলার মধ্যে একটা একেবারেই মজে গেছে। ওটা গেলার লোক নেই বাড়িতে। অতঃপর খাওয়া গেল তিনটা কলা। তাহলে প্রকৃত দাম পড়ল চবি্বশ টাকা ভাগ তিন সমান আট টাকা একেকটা। এবার ভাবছি বাংলা ভাষা থেকে 'দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষা' কথাটা অপ্রযোজ্য হয়ে অব্যবহারে বিস্মৃত হবে আর ক'দিনের ভেতর?
এবারের বাজেট কেমন হলো? আমি তার কী জানি! আমি মন্ত্রী না যে বলব, 'এবারের বাজেট যুগান্তকারী।' যে দলই বা যারাই সরকারে থাকুক না, যিনি কোনো মন্ত্রী তিনি অবশ্যই বলবেন, 'প্রধানমন্ত্রীর কৃপায় ও দিকনির্দেশনায় অর্থমন্ত্রী যুগান্তকারী বাজেট ঘোষণা করেছেন।' আর যাঁরা বিরোধী দলে তাঁরা বলবেন, 'এ বাজেট অর্থহীন। উন্নয়নের কোনো সুস্পষ্ট পথ দেখা যাচ্ছে না এতে।' আর যাঁরা বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি তাঁরা বলবেন, 'সময়টা জটিল, তবে সদিচ্ছা থাকলে এর মধ্যেও এই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব।' এ মন্তব্য যাঁরা করেন তাঁরা অবশ্য অতীব ভদ্র ও বিনয়ী বিধায় কিঞ্চিৎ অসত্য বলেন। তাঁরা খুব ভালো মতোই জানেন, বাজেটে যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থাকে সেটা অতীতে কখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, চলতি অর্থবছরেও হচ্ছে না এবং সামনের বারও তা হবে না। আর মূল্যস্ফীতি? সে তো অপ্রতিরোধ্য। এখন কোনো বাজেটদাতার ক্ষমতা নেই তা ঠেকানোর। আমাদের যারা বাজেট দেন সম্ভবত তাদের ইচ্ছা-শক্তিও লোপ পেয়েছে। শুধু টেলিভিশন বা রেডিওতে শুনে বাজেট সম্পর্কে মূল্যায়ন করা যায় না। তা ছাড়া অর্থমন্ত্রীদের ভাষণ আর বাজেট এক কথা নয়। বাজেট দলিলে আরো অনেক কিছু থাকে, যার প্রতিক্রিয়া দিন কয়েক পরে অনুভব করা যায়। তা ছাড়া সরকারের হাতে এসআরও (ঝজঙ) নামে এক অস্ত্র আছে, যা দিয়ে পার্লামেন্টে পাস হওয়া কর প্রস্তাবের পরও বাড়তি ট্যাঙ্ বসানো যায়। সরকার তা করেও থাকে। কাজেই বাজেট নামে যা দেখা গেল সেটাই বাজেটের সবটা নয়। অর্থবছরের শেষে সংশোধিত বাজেট যখন পেশ হবে তখন বোঝা যায় আসলে বাজেট কী ছিল।
তবে গত পরশু (বৃহস্পতিবার) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে বিশাল বাজেট ঘোষণা করলেন তাতে ঘাটতিও খুব বড়। অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন যে ঘাটতি বাজেট বাস্তবায়ন করতে যেসব প্রক্রিয়ায় সরকারকে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়, তাতে মূল্যস্ফীতি ঘটে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এবারের প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না। অনিচ্ছায় হলেও তাঁর সঙ্গে আমি একমত। আমার মনে হয়_প্রথমত, 'ডেফিসিট ফিন্যান্সিং'-এর চাপে মূল্যস্ফীতি হবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার দাম পড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। দুঃখজনক হলেও এ কথা তো সত্যি, বাংলাদেশকে চাল, ডাল, তেল, জ্বালানি, কাপড়, তুলা, লোহালক্কড়, ভারী যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, কাঠ, বই সবই আমদানি করতে হয়। আমদানিনির্ভর এই অর্থনীতিতে যদি দেশি টাকার দাম পড়ে যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিবারের মতো এবারও কিছু সামগ্রীর ওপর কর বাড়ানো হয়েছে, কিছু জিনিসের কর কমানো হয়েছে। দিন কয়েক পর হয়তো হিসাব করা যাবে যে মোট ফলাফল কী হলো। তবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, টায়ার ও ব্যাটারির ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়া আরেক দফা বাড়িয়ে দেওয়ার একটা অজুহাত পাবেন বাস-ট্রাক মালিকরা।
ঢাকা শহরে এখন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার আছে যাদের উপার্জনকারীরা প্রতিদিনের খাবার, বাজারের টাকা যোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে। খাদ্য কেনার খরচ মেটানোর পর তাদের দুশ্চিন্তা থাকে বাড়ি ভাড়া জোগাড় হবে কোথা থেকে। সরকারের বাজেট ২০১১-১২ তাদের জন্য কোনো স্বস্তি এনেছে কি? মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘরে বসে থাকলে সে স্বস্তি আসার সম্ভাবনা কম। পল্লী অঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে বেশি হয়েছে। এ মুহূর্তে কৃষকের ঘরে বোরো ধান আছে বলে তাদের ওপর বাড়তি অর্থ জোগাড় করার সরাসরি চাপ একটু কম। তবে আমন ধান ওঠার আগে তারা আবার চাপের মধ্যে পড়বে, যদি মূল্যস্ফীতি হতেই থাকে।
লখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments