শ্রদ্ধাঞ্জলি-কিবরিয়া এবং তাঁর রংতুলির সংসার by ড. মোহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ
শঙ্কা তাড়া করছিল আমরা কখন সংবাদ পাই, শ্রদ্ধেয় শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া আর নেই। শেষ পর্যন্ত শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিল ৭ জুন ২০১১ সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে। ওই দিন ঢাকা থেকে বন্ধুবর সৈয়দ মাহমুদ জামান বাংলাদেশ সময় বেলা ১টা ৩০ মিনিটে টেলিফোনে তাঁর প্রয়াণ সংবাদটি জানালেন।
গভীর শ্রদ্ধায় শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়াকে স্মরণ করি, যিনি তাঁর কাজের মধ্যেই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রয়াণ আমাদের জন্য বড় ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি করল। ৮২ বছর বয়সে কিবরিয়া ভাই শারীরিকভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
বাংলাদেশের চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ বরেণ্য চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। তাঁকে প্রত্যক্ষ শেষ দেখি, কথা বলি ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায়। ওই দিন রাতেই আবার লন্ডনে ফিরে আসার তাগিদ ছিল বলে প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটাতে পারিনি। তাঁর কাজের মূল্যায়ন করার যোগ্যতা বা সাধ্য কোনোটাই আমার নেই, তবে এটুকু বুঝি, নানা রঙের বৈচিত্র্যের সমাহারে তিনি তাঁর চিত্রশিল্পে যে অসাধারণ সমন্বয় ঘটাতেন আর অনিন্দ্য বিন্যাসে ফুটিয়ে তুলতেন তা অসম্ভব হৃদয়ছোঁয়া, মনছোঁয়া। শিল্পবোদ্ধারা এ সম্পর্কে আরো গভীর বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তিনি গভীর মমতায় পর্যবেক্ষণ করতেন মাটির ধূসর, গৈরিক পাটকিলে আর ছাই রঙের বৈচিত্র্য। তাঁর কাজের মধ্যেও এসব রঙের গভীর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। আমৃত্যু নিভৃতচারী এই শিল্প-ব্যক্তিত্ব চিত্রকলা ভুবনে নবাগতদের বিশুদ্ধ শিল্পচর্চায় একনিষ্ঠ থাকার প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন। একজন শিল্পী যেসব মহান ব্রতে ব্রতী হন, প্রয়াত কিবরিয়া ভাই এর সব কয়টিই নিজের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন। জীবনসায়াহ্নে এসে কিবরিয়া ভাই নিজের কাজ সম্পর্কে নিজেই খুব পর্যালোচনা করতেন_এমনটি শুনেছি তাঁরই ঘনিষ্ঠজনদের কাছে। তিনি ছিলেন ফলবান বৃক্ষের মতো নতজানু। বড় মাপের মানুষরা বুঝি এমনই হন। তাঁর প্রয়াণে দেশের শিল্পক্ষেত্রে অবশ্যই অনেক বড় ক্ষতি হলো। কারণ চারুকলাচর্চায় তিনি একটি স্বতন্ত্রধারার সৃষ্টি করেছিলেন। অনেকেই বলেন, বিমূর্ত চিত্রকলার এই ধারা 'কিবরিয়াধারা'_তাঁর যাঁরা অনুসারী তাঁদের কাছে এমনটি শুনেছি আরো গভীর বিশ্লেষণে। তিনি নির্বস্তুক ছবির চর্চা করে গেছেন। গভীর সাধনায় তিনি শিল্পকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। নির্দিষ্ট কিছু রং নিয়ে তিনি কাজ করলেও তাঁর ছবির স্নিগ্ধতা অন্য রকম, যা সহজে বর্ণনা করার নয়। অসম্ভব মাধুর্যমণ্ডিতও বটে। তাঁর ছবি দৃষ্টিকে আটকে রাখে। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপচিত্রের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তিনি প্রকৃতির অন্তর্গত সত্তার স্বরূপ উন্মোচনে আরো উন্মুখ হন_এও কয়েকজন শিল্পবোদ্ধার কাছেই শুনেছি। সমসাময়িক শিল্পী হতে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পানুরাগীদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসন।
দেশ-বিদেশে তাঁর একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে অনেক। কয়েকটি প্রদর্শনীতে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে খুব ধন্য মনে করেছিলাম। জাপান, আমেরিকা ও কলকাতার সেই প্রদর্শনীগুলোর কথা চিরদিন মনে থাকবে। আজ কিবরিয়া ভাই শারীরিকভাবে অনুপস্থিত বলেই আরো বেশি করে সেসব চিত্র মানসপটে ভেসে উঠছে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন তাঁর শিল্পকর্মের জন্য। শিল্পজগতের এমন প্রতিভাবান শিল্পীকে কোনো মাপকাঠিতে না মেপে পরম শ্রদ্ধায় যাঁরা তাঁর শিল্পকর্মকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন, একমাত্র তাঁরাই তাঁকে নির্ণয় করতে পারবেন। বর্তমান সমাজের যেসব মহতীকে আমরা পর্যবেক্ষণ করি আমাদের আলোকিত করার জন্য, কিবরিয়া ভাই সে ক্ষেত্রে তাঁদের অন্যতম একজন।
তাঁর খ্যাতির সীমানা বিস্তৃত; বিশ্বের বিখ্যাত বহু গ্যালারিতে যাঁর কাজ সংগৃহীত আছে। তাঁর খ্যাতির সীমানা নির্ধারণ করা দুরূহই। বিনম্র, নিরহংকার চরিত্রের অধিকারী কিবরিয়া ভাই আমাদের গর্ব, অহংকার ও বাতিঘর। তিনি শিল্পী হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও অনেক বড় মাপের ছিলেন। তাঁর কাছে আমরা তাঁর জন্যই হয়ে থাকব চিরঋণী। তাঁর নিজস্ব যে শিল্পজগৎ তিনি তৈরি করেছিলেন, সেটি দৃষ্টান্তযোগ্য। নিজস্ব শিল্পভুবন একজন শিল্পীর জন্য বড় বেশি অপরিহার্য। তাঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী আমরা আর পাব কি না জানি না। সারাটা জীবন শিল্পকর্মের জন্যই ব্যয় করে গেলেন। মাটির প্রতি তাঁর অনুসন্ধিৎসা কিংবা আবেগ কতটা গভীর ছিল এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কাজের মধ্যেই। সব ধরনের দায়বদ্ধতার ঊধর্ে্ব থেকে তিনি শিল্পচর্চা করে গেছেন। এ জন্যই তিনি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি দেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাও। তিনি বৈষয়িক ছিলেন না বটে তবে তাঁর গড়া রং-তুলির সংসার অত্যন্ত আলোকিত। এই সংসারে তিনি ছিলেন নিবেদিত। আজীবন বিশুদ্ধ শিল্পচর্চায় একনিষ্ঠ থেকে যে বর্ণাঢ্য শিল্পজীবন এবং অসামান্য অনেক কিছু সৃষ্টি করে গেছেন, তা শিল্পানুরাগীদের কাছে বিশাল সম্পদসম। এ দেশের চিত্রকলাকে যাঁরা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছেন মোহাম্মদ কিবরিয়া ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যজন। তাঁর কাছে আমাদের অনেক ঋণ।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী গবেষক
বাংলাদেশের চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ বরেণ্য চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। তাঁকে প্রত্যক্ষ শেষ দেখি, কথা বলি ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায়। ওই দিন রাতেই আবার লন্ডনে ফিরে আসার তাগিদ ছিল বলে প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটাতে পারিনি। তাঁর কাজের মূল্যায়ন করার যোগ্যতা বা সাধ্য কোনোটাই আমার নেই, তবে এটুকু বুঝি, নানা রঙের বৈচিত্র্যের সমাহারে তিনি তাঁর চিত্রশিল্পে যে অসাধারণ সমন্বয় ঘটাতেন আর অনিন্দ্য বিন্যাসে ফুটিয়ে তুলতেন তা অসম্ভব হৃদয়ছোঁয়া, মনছোঁয়া। শিল্পবোদ্ধারা এ সম্পর্কে আরো গভীর বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তিনি গভীর মমতায় পর্যবেক্ষণ করতেন মাটির ধূসর, গৈরিক পাটকিলে আর ছাই রঙের বৈচিত্র্য। তাঁর কাজের মধ্যেও এসব রঙের গভীর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। আমৃত্যু নিভৃতচারী এই শিল্প-ব্যক্তিত্ব চিত্রকলা ভুবনে নবাগতদের বিশুদ্ধ শিল্পচর্চায় একনিষ্ঠ থাকার প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন। একজন শিল্পী যেসব মহান ব্রতে ব্রতী হন, প্রয়াত কিবরিয়া ভাই এর সব কয়টিই নিজের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন। জীবনসায়াহ্নে এসে কিবরিয়া ভাই নিজের কাজ সম্পর্কে নিজেই খুব পর্যালোচনা করতেন_এমনটি শুনেছি তাঁরই ঘনিষ্ঠজনদের কাছে। তিনি ছিলেন ফলবান বৃক্ষের মতো নতজানু। বড় মাপের মানুষরা বুঝি এমনই হন। তাঁর প্রয়াণে দেশের শিল্পক্ষেত্রে অবশ্যই অনেক বড় ক্ষতি হলো। কারণ চারুকলাচর্চায় তিনি একটি স্বতন্ত্রধারার সৃষ্টি করেছিলেন। অনেকেই বলেন, বিমূর্ত চিত্রকলার এই ধারা 'কিবরিয়াধারা'_তাঁর যাঁরা অনুসারী তাঁদের কাছে এমনটি শুনেছি আরো গভীর বিশ্লেষণে। তিনি নির্বস্তুক ছবির চর্চা করে গেছেন। গভীর সাধনায় তিনি শিল্পকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। নির্দিষ্ট কিছু রং নিয়ে তিনি কাজ করলেও তাঁর ছবির স্নিগ্ধতা অন্য রকম, যা সহজে বর্ণনা করার নয়। অসম্ভব মাধুর্যমণ্ডিতও বটে। তাঁর ছবি দৃষ্টিকে আটকে রাখে। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপচিত্রের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তিনি প্রকৃতির অন্তর্গত সত্তার স্বরূপ উন্মোচনে আরো উন্মুখ হন_এও কয়েকজন শিল্পবোদ্ধার কাছেই শুনেছি। সমসাময়িক শিল্পী হতে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পানুরাগীদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসন।
দেশ-বিদেশে তাঁর একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে অনেক। কয়েকটি প্রদর্শনীতে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে খুব ধন্য মনে করেছিলাম। জাপান, আমেরিকা ও কলকাতার সেই প্রদর্শনীগুলোর কথা চিরদিন মনে থাকবে। আজ কিবরিয়া ভাই শারীরিকভাবে অনুপস্থিত বলেই আরো বেশি করে সেসব চিত্র মানসপটে ভেসে উঠছে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন তাঁর শিল্পকর্মের জন্য। শিল্পজগতের এমন প্রতিভাবান শিল্পীকে কোনো মাপকাঠিতে না মেপে পরম শ্রদ্ধায় যাঁরা তাঁর শিল্পকর্মকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন, একমাত্র তাঁরাই তাঁকে নির্ণয় করতে পারবেন। বর্তমান সমাজের যেসব মহতীকে আমরা পর্যবেক্ষণ করি আমাদের আলোকিত করার জন্য, কিবরিয়া ভাই সে ক্ষেত্রে তাঁদের অন্যতম একজন।
তাঁর খ্যাতির সীমানা বিস্তৃত; বিশ্বের বিখ্যাত বহু গ্যালারিতে যাঁর কাজ সংগৃহীত আছে। তাঁর খ্যাতির সীমানা নির্ধারণ করা দুরূহই। বিনম্র, নিরহংকার চরিত্রের অধিকারী কিবরিয়া ভাই আমাদের গর্ব, অহংকার ও বাতিঘর। তিনি শিল্পী হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও অনেক বড় মাপের ছিলেন। তাঁর কাছে আমরা তাঁর জন্যই হয়ে থাকব চিরঋণী। তাঁর নিজস্ব যে শিল্পজগৎ তিনি তৈরি করেছিলেন, সেটি দৃষ্টান্তযোগ্য। নিজস্ব শিল্পভুবন একজন শিল্পীর জন্য বড় বেশি অপরিহার্য। তাঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী আমরা আর পাব কি না জানি না। সারাটা জীবন শিল্পকর্মের জন্যই ব্যয় করে গেলেন। মাটির প্রতি তাঁর অনুসন্ধিৎসা কিংবা আবেগ কতটা গভীর ছিল এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কাজের মধ্যেই। সব ধরনের দায়বদ্ধতার ঊধর্ে্ব থেকে তিনি শিল্পচর্চা করে গেছেন। এ জন্যই তিনি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি দেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাও। তিনি বৈষয়িক ছিলেন না বটে তবে তাঁর গড়া রং-তুলির সংসার অত্যন্ত আলোকিত। এই সংসারে তিনি ছিলেন নিবেদিত। আজীবন বিশুদ্ধ শিল্পচর্চায় একনিষ্ঠ থেকে যে বর্ণাঢ্য শিল্পজীবন এবং অসামান্য অনেক কিছু সৃষ্টি করে গেছেন, তা শিল্পানুরাগীদের কাছে বিশাল সম্পদসম। এ দেশের চিত্রকলাকে যাঁরা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছেন মোহাম্মদ কিবরিয়া ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যজন। তাঁর কাছে আমাদের অনেক ঋণ।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী গবেষক
No comments