সকরুণ ভুলের গল্প

তখন ‘ন’টি সিক্সটিন’। চোখ ধূসর। কিন্তু চোখে লাগানো চশমাটা রঙিন। কাজেই স-অ-ব রঙিন দেখায়। মাঝেমধ্যে রাস্তায় হাঁটি আর মনে হয় আরে, ইকারুসের ডানা দুটো কোত্থেকে এল! যাহোক, তখন পাঠ্যবই নিয়ে বন্ধুমহলে দারুণ ক্ষোভ। এমনিতে এটা স্বাভাবিক।


কিন্তু কারণটা ভিন্ন। এই বন্ধুকে দাওয়াত দিয়ে চিঠি লেখো, আব্বার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লেখো—এসব কবে চুলোয় গেছে। শুধু বিপন্নপ্রায় হয়ে বেঁচে আছে প্রেমপত্র। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে তার স্থান নেই (জ্ঞানীর মূল্য নেই)।
সেই সুবাদে আমাদের জাঁহাবাজ বন্ধু উল্লাস, ঠিক করল সে এই বিপন্ন বস্তুটিকে আবার বাঁচিয়ে তুলবে। টেনে আনবে জনতার কাতারে।
আমরা (বাঙালি হিসেবে) তাকে উৎসাহ দিয়ে পেছনে সরে এলাম। উল্লাস আমাদের উৎসাহে পত্র লিখে ঠিক করল পাশের বাসার ঐশীকে দেবে। ভালো ছাত্রদের সিদ্ধান্ত হবে দ্রুত—কথাটা শ্রদ্ধেয় লাল মোহাম্মদ স্যারের। উল্লাসেরও পত্র দিতে দেরি হয় না। এক ভরদুপুরে মুঠি পাকিয়ে ছুড়ে দেয় পাশের বাসার ছাদে। কোন দিকে গেল, না দেখেই উল্লাস দৌড়ে ঘরে যায়।
তারপর কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস যায়। আমাদের উৎসাহও সমানুপাতিক হারে কমতে থাকে। আমরা উল্লাসকে বলি, ‘যাশ্শালা, কি লিকে কী দিইবিস। কাজটা আমরা কোল্লেও ভালো হতো।’
বাব্বা, তার দুই দিন পরই উল্লাস একটা কাগজ নিয়ে ক্লাসে ঢোকে। তার মুখ ১০০ ওয়াটের বাল্ব যেন।
আমরা বলি, কাগজটা কী? কিন্তু উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকি না। কারণ, সবাই জানি, জিনিসখানা কী। হুমড়ি খেয়ে পড়া শুরু করি। চিঠিতে লেখা আছে, ‘প্রাণপাখি, বুলবুলি “অমুক” দিন “তমুক” হোটেলে দেখা করো। তোমরা সবাই, যে কজন বন্ধু আছে।’
আমরা কোরাস গাই। কিন্তু উল্লাস চুপসে গেল। তার অভিযোগ, আমরা সবাই কেন? আমরা অভয় দিয়ে বলি, চল, পরে তোকে পারসোনালি না হয় কথা বলতে দেওয়া যাবে। ডান।
‘অমুক’ তারিখে আমরা ঝকমকে জামাকাপড় পরে ‘তমুক’ হোটেলে উপস্থিত। ওপরে লেখা, ‘হোটেল নিয়ামত।’ দুই পাশে দুটো ছাগল। নিচে আরও কিছু লেখা ছিল, পড়তে পারলাম না।
কারণ, হইচই-মাখা মুখগুলো থমকে গেছে। আমরা যে টেবিলে বসে আছি, সেখানে এসে বসলেন খোদ উল্লাসের আম্মু।
আমরা বজ্রাহত হলাম। উল্লাস ১০ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুতাহত হলো। ওদিকে আন্টি তো হেসেই গড়াগড়ি। তিনি বললেন, উল্লাসের ‘পত্রখানা’ সেদিন রান্নাঘরের জানালায় এসে পড়ে। তিনি তখন থালাবাসন মাজছেন। ‘পত্রপাঠ’ তিনি ‘পত্র রচনা’ করে ফেলেন। তার হাসি দেখে আমরা ‘মরমে’ খুন হয়ে গেলাম। এও কি হয়! এ তো যাকে বলে ‘ইমোশনাল আত্যিয়াচার’।
আন্টি হাসি থামিয়ে বললেন, ‘থাকগে, ছেলেমানুষি করার মজাই আলাদা। তোমরা কী খাবে বলো?’
উল্লাসের কথা, ‘শালা, চিঠি লেখাটাই আমার ভুল হয়েছে। দোস্ত, এই কাহিনি কোত্থাও পাঠাস না যেন, প্লিজ। তুই যা চাবি তা-ই পাবি।’ আমি বললাম, আর একটা প্রেমপত্র লিখে দে।
 জুবায়ের আলম
কুষ্টিয়া।

No comments

Powered by Blogger.