চরাচর-বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর by সাইফুল ইসলাম খান
মানুষ কখন থেকে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেছে, তার সঠিক সময় আমাদের অজানা। সম্ভবত সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ ঘরবাড়ি তৈরি করতে শেখে ও গৃহে বসবাস শুরু করে। গুহাবাসী মানুষ গুহা ছেড়ে জনপদে বসবাস করার সময় থেকেই নানা ধরনের উপকরণ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতে শুরু করে।
তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের এ উপমহাদেশেও একসময় মানুষের আবাস হিসেবে মাটি দিয়ে ঘর তৈরি শুরু হয়। একসময় আমাদের দেশে মাটির তৈরি ঘর অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। সাধারণত মাটি, কাঠ, বাঁশ, ছন, গোলপাতা, ধানের খড়, আখের পাতা, টালি ইত্যাদি দিয়ে মাটির ঘর তৈরি হতো। মাটি দিয়ে দেয়াল, কাঠ দিয়ে দরজা-জানালা এবং ছন, গোলপাতা, ধানের খড়, আখের পাতা, টালি ইত্যাদি দিয়ে ঘরের চাল বা চালা তৈরি করা হতো। কয়েকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য মাটির ঘরকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি এসব ঘরের দেয়াল ছিল দেড় থেকে দুই ফুট প্রশস্ত। ফলে ঘরগুলো হতো অধিক সময় ধরে টেকসই। শুধু টেকসই নয়, মাটির তৈরি দেয়াল বায়ু পরিবাহী হওয়ায় এসব ঘর খুবই স্বাস্থ্যকর। বায়ু পরিবাহিতা ও দেয়ালের প্রশস্ততার কারণে ঘরগুলো হতো উত্তম তাপরোধক। অধিক উষ্ণতা ও ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করতে মাটির দেয়াল সবচেয়ে ভালো উপাদান। এর সঙ্গে চালে (ছাদে) ছনের দুই থেকে তিন ইঞ্চি বেধের আবরণ অধিক তাপ ও ঠাণ্ডা থেকে ঘরকে সুরক্ষা দেয়। তাই মাটির তৈরি ঘরে গরমের দিনে অপেক্ষাকৃত কম গরম ও শীতের দিনে অপেক্ষাকৃত কম শীত অনুভূত হয়। আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় মাটির তৈরি ঘর দেখা যায়। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় কিছু মাটির ঘর দেখা যায়। মাটির ঘর তৈরি করতে ছয় থেকে সাত মাস সময় প্রয়োজন হয়। প্রথমে এঁটেল মাটির সঙ্গে পরিমাণ মতো ধানের তুষ ও পানি মিশিয়ে ছানা তৈরি করা হয়। এ ছানা ২০ থেকে ২৫ দিন রেখে দিলে তা দেয়াল তৈরির উপযোগী হয়। ছানা মাটি দিয়ে দেড় থেকে দুই ফুট প্রশস্ত ও একই উচ্চতার রদা তৈরি করা হয়। বিল্ডিং তৈরির সময় যেমন ইটের গাঁথুনি বলে, তেমনি দেয়াল তৈরির প্রতিটি ধাপকে একেকটি রদা বলে। দেড় ফুট উচ্চতার আট থেকে ৯টি রদা একটির ওপর একটি স্থাপন করলে ঘরের দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। এরপর দেয়ালের ওপর কাঠ বা বাঁশের ফ্রেম তৈরি করে তার ওপর ছন, ধানের খড় বা গোলপাতা দিয়ে চাল বা চালা তৈরি করা হয়। ঘরের দরজা-জানালা তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। বর্তমানে ফসলি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, অধিক হারে ঘরবাড়ি তৈরির ফলে অনাবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ছন প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে। এ ছাড়া যুগের পরিবর্তনে ঘরবাড়ি তৈরিতে ইটের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে মাটির ঘর এখন আর আগের মতো তৈরি হয় না। পাঁচ-সাত যুগ আগে তৈরি ঘরগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেলে সেখানে নতুন করে আর মাটির ঘর তৈরি হয় না। সময়ের প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকর ও আরামদায়ক মাটির ঘর এখন বিলুপ্তির পথে।
সাইফুল ইসলাম খান
No comments