কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নের নতুন দিগন্ত by এ এম এম শওকত আলী

আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণায় বর্তমান সময়ে যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে, তা হলো_কৃষি উৎপাদন স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকেন্দ্রিক হতে হবে। অর্থাৎ কৃষিজাত খাদ্য যাতে স্বাস্থ্যসম্মত এবং পুষ্টি প্রদানে সফল হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়টি একেবারেই অভিনব, তা বলা যাবে না।


কারণ নব্বইয়ের দশকে পুষ্টি-সংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ বিষয়টিই প্রধান বিষয় ছিল। প্রায় ১১টি চিহ্নিত ক্ষেত্রের মাধ্যমে সর্বাধিক ক্ষেত্র ছিল কৃষিজাত খাদ্য-সংক্রান্ত। মূল সুপারিশ ছিল_কৃষিজাত খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমেই সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা অবশ্যই জরুরি। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন বা বহুমাত্রিক ভিটামিন গ্রহণের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার প্রবণতা সঠিক নয় অথবা একমাত্র উপায় নয়। ভিটামিন গ্রহণ পরিপূরক উপায় হিসেবে গ্রহণযোগ্য, তবে তা খাদ্য গ্রহণের বিকল্প হতে পারে না।
এ উপলব্ধির ধারাবাহিকতায় কিছু প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয়। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এ দেশের প্রচলিত শাসন কাঠামোতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিক্ষেত্র; কৃষি মন্ত্রণালয়ের নয়। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হলেও এই উদ্যোগের সার্থকতা দুই মন্ত্রণালয়ের কার্যকর সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ সমন্বয় অর্জন করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রায় ২০০ কোটি টাকার একটি বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ অধিবাসীদের পুষ্টি নিশ্চিত করা। প্রকল্পটির অর্থায়ন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে অর্থ প্রদানকারী বিদেশি সংস্থাটি বলেছিল বেসরকারি সংস্থা নির্বাচনে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি এবং একতরফা নীতির কথা। অস্বচ্ছতা এবং দুর্নীতি যদি হয়েই থাকে, তার জন্য অর্থায়ন কেন বন্ধ হবে? আবার দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে প্রকল্প কেন চালু হবে না?
অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষি মন্ত্রণালয়ও একটি বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়িত করে। ওই দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কয়েকটি স্থানে সরেজমিন প্রকল্পটি পরিদর্শন করে বাস্তবায়ন সফল এবং সার্থক বলে মন্তব্য করেছিলেন। তা সত্ত্বেও প্রকল্পের মেয়াদ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশল ছিল_বসতবাড়িতে শাকসবজিসহ ফলের চাষ।
২০১১ সালের প্রথম ভাগে ধান গবেষণার ক্ষেত্রে পুষ্টিযুক্ত ধানবীজ উৎপাদনে বাংলাদেশ ধান গবেষণাকেন্দ্র (ব্রি) যে সাফল্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এসেছে, এর মধ্য দিয়ে খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির নতুন দিগন্ত সূচিত হবে বলে বর্তমানে সবাই আশাবাদী। দুটি ক্ষেত্রে এই সাফল্য আসবে বলে মনে করা হচ্ছে_১. ভিটামিন-'এ'সংযুক্ত ধানবীজ উদ্ভাবন ২. জিংকসমৃদ্ধ ধানবীজ উদ্ভাবন। প্রথমটির মাধ্যমে ভিটামিন 'এ' উপাদানের অভাব দূরীভূত হবে, দ্বিতীয়টির মাধ্যমে জিংকের অভাব পূরণ করা সম্ভব হবে। এর আগে এ ধরনের উদ্যোগ কখনো গ্রহণ করা হয়নি, যদিও সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলাদেশে চালই প্রধান খাদ্য। শতকরা ৭৪ ভাগ প্রোটিন এর মাধ্যমে পাওয়া যায়। তবে এখন পর্যন্ত কোন কোন ধরনের চালে কী কী ভিটামিন রয়েছে, তা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জানা নেই। এই দুই ধরনের ধানবীজ উৎপাদনে গবেষণা কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণাকেন্দ্র (ইরি) এবং ভিন্ন দুটি বিদেশি সংস্থা সহায়তা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ভিটামিন-'এ'যুক্ত চালের ব্যবহারে এই ভিটামিনের অভাব পূরণ করলে রাতকানা রোগ দূর হবে। অন্যদিকে জিংকসমৃদ্ধ ধানের জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জিংকের অভাবহেতু মা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস করা সম্ভব হবে। এক বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে প্রায় আট মিলিয়ন কৃষিজমির ৫০ শতাংশ জমিতে জিংকের অভাব রয়েছে। সীমিত জমির অধিক ব্যবহারই এর কারণ। তবে এ কথাও সত্য, কৃষিজমিতে প্রয়োজনীয় খনিজের অভাব দূর করার উপায়ও রয়েছে। এ কথা জানা থাকলেও উদ্যোগ নেই। উদ্যোগ না থাকার মূল কারণ একাধিক_১. জিংকের অভাবে জমির এলাকাভিত্তিক বৈজ্ঞানিক মানচিত্র প্রণীত হলেও এ সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ স্তিমিত। ২. স্তিমিত হওয়ার কারণ অর্থায়নের অভাব ছাড়াও প্রয়োজনীয় সমন্বিত উদ্যোগ। ৩. জিংক অনুসার ব্যবহারের জন্য কিছু বিক্ষিপ্ত প্রচারণা সত্ত্বেও মানসম্মত জিংক অনুসার পাওয়া কঠিন। মূল কারণ, মানসম্মত অনুসার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এ ক্ষেত্রেও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সার্বিকভাবে সব ধরনের মানসম্মত সার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যই এই উদ্যোগ। তবে এ কথা বিজ্ঞানীরা এখনো বলেননি, বিভিন্ন অনুসারের ব্যবহার বৃদ্ধি করে বিদ্যমান ধানে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন তথা পুষ্টি উপাদানের অভাব দূর করা সম্ভব কি না।
জিংকসমৃদ্ধ ধান উৎপাদনের সাফল্যের ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন_১. ধান উৎপাদনের ব্যয় যেন কৃষকদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে, ২. ভাত যেন উপাদেয় হয়। এর সঙ্গে যোগ করা হয় অন্য দুটি বিষয়_১. যে দুটি বিদেশি সংস্থা এই গবেষণা প্রক্রিয়ায় যুক্ত, তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের জন্য কোনো চাপ প্রয়োগ করবে কি না। ২. উদ্ভাবিত বীজের স্বত্বাধিকারী কে হবে কিংবা এর জন্য কোনো চুক্তি হয়েছে কি না। হয়ে থাকলে শর্ত কী?
শেষোক্ত বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরিসহ ব্রি আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা-সংক্রান্ত পরামর্শক সংস্থার (সিজিএআর) অংশবিশেষ অথবা সম্পর্কযুক্ত। এর মাধ্যমে কোনো নতুন কৃষি উপকরণ উদ্ভাবিত হলে তা উন্মুক্ত ক্ষেত্রেই বিরাজ করার কথা। সংক্ষেপে ইংরেজিতে বলা হয়_পাবলিক ডমেইন। অর্থাৎ যে দেশে উদ্ভাবিত হবে, সেই দেশের জনগণই হবে এর স্বত্বাধিকারী। বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনুসন্ধানযোগ্য। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি আইনসহ প্লান্ট ভ্যারাইটি প্রোটেকশন আইন প্রণীত হয়েছে। এ পর্যন্ত এসব আইনবলে কতগুলো উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মালিকানা বাংলাদেশ দাবি করতে পারে, সেই সম্পর্কে কোনো তথ্য কখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। সংসদেও কোনো প্রশ্ন এ বিষয়ে উত্থাপিত হয়নি। সংসদ এবং সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন করেই মনে করেছেন, তাঁদের দায়িত্ব শেষ।
জিংকসমৃদ্ধ নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করার প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে বায়োফর্টিফিকেশন (ইরড় ভড়ৎঃরভরপধঃরড়হ)। এ প্রযুক্তিটি স্বীকৃত। তবে অন্য একটি অনুরূপ পন্থা হলো, আটার ফর্টিফিকেশন। অসমর্থিত সূত্রে শোনা যায়, ফর্টিফাইড আটা ভিজিডি কর্মসূচিতে দুস্থ মহিলাদের জন্য বিতরণ করা হয়। যে বিদেশি সংস্থা জিংকসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবনপ্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল, সেই সংস্থাটির দাবি_উগান্ডা ও মোজাম্বিকে মিষ্টি আলুতে ভিটামিন 'এ', রুয়ান্ডা ও কঙ্গোতে ডালজাতীয় খাদ্যে লৌহ (ওৎড়হ), ভারতের বাজরায় লৌহ ও জিংক এবং ভারত-পাকিস্তানে গম জিংকসমৃদ্ধকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা গ্রুপকে তারা এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে। বাজরা বাংলাদেশে প্রচলিত খাদ্য তালিকায় নেই। বিভিন্ন কারণে এটা করাও সম্ভব নয়। আফ্রিকার দুটি দেশের ডালজাতীয় খাদ্যে যে কাজ চলছে, অনুরূপ গবেষণা এ দেশে করা সম্ভব কি না, তা কৃষি গবেষণার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোই বলতে পারবে। তবে গম চাষের এলাকা ও উৎপাদন বর্তমানে আগের তুলনায় অনেক কম।
কৃষিজাত খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়নে যেসব প্রযুক্তির কথা বলা হলো, তা অবশ্যই জরুরি। তবে এ প্রচেষ্টা হতে হবে বহুমুখী, যার মধ্যে কৃষকের বাড়ির আঙিনায় শাকসবজিসহ ফলমূলের চাষও অতি গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে ভূমিহীন কৃষকের অবস্থা এবং বসতবাড়িহীন কৃষিশ্রমিকের অবস্থার কথা। এসব ক্ষেত্রে খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী জোরদার করা প্রয়োজন। যে খাদ্য বিতরণ করা হবে, তার মধ্যে জিংক ও ভিটামিন 'এ'সমৃদ্ধ চাল-গম অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন হবে। এই কর্মসূচি অবশ্য ২০২০ সালের আগে করা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ ২০১২ সালের আগে ভিটামিন 'এ' এবং জিংকসমৃদ্ধ ধান অনুমোদিত হয়ে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক হারে চাষ করা সম্ভব হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয় হতে পাঁচ-সাত বছর সময় প্রয়োজন হয়। আশির দশকের উদ্ভাবিত বীজ বিআর-১১ এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নব্বইয়ের দশকে উদ্ভাবিত বীজ বিআর-২৮ ও ২৯। বিআর-৩৩ বীজের ধান অপেক্ষাকৃত কম সময়ে চাষ করা যায়। এই বীজটি বিশেষ প্রচেষ্টায় কৃষিবিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছিলেন মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের জন্য। কারণ আমন ধান মাঠে বপনের পর আশ্বিন-কার্তিক মাসে কৃষিশ্রমিকরা বেকার অবস্থায় পতিত হন। কাজের সন্ধানে তাঁরা ছুটে আসেন শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকায়। কিছু অর্থ উপার্জনের আশায়। এ জন্য অনেক আলোচনার পর বলা হয়েছিল, অন্যান্য ধানবীজের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ফসল ফলানো যায় এমন একটি বীজ উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তার কথা। ২০০০-পরবর্তী সময়ে এটা করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই বীজ মাঠপর্যায়ে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ অনুসন্ধানযোগ্য।
কিছুসংখ্যক গবেষক প্রথাগতভাবে একটি কারণ জোরগলায় বলেন অথবা তাঁদের বলার প্রবণতা রয়েছে। তা হলো, গবেষণা ও সম্প্রসারণের দুর্বলতা। অনেক কৃষি গবেষক একটি বিষয় স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে করেন। তা হলো, প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কাজ সম্প্রসারণ বিভাগের; গবেষকদের জন্য নয়_ধারণাটি অর্ধসত্য।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.