শেকড়ের ডাক-বাজেট ও অরক্ষিত উপকূলবাসী by ফরহাদ মাহমুদ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল বরাবর জলোচ্ছ্বাস আইলা আঘাত হেনেছিল আজ থেকে দুই বছর আগে। এতে খুলনা বিভাগের কয়েকটি জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে থাকা এক হাজার ৬৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটারই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এর মধ্যে একাধিক বাজেট এসেছে, কিন্তু সেই ভাঙা বাঁধ এখনো সম্পূর্ণ মেরামত করা যায়নি। জোয়ারের সময় বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে আসা নোনা পানিতে বাড়িঘর ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়। ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডরের আঘাতে গোটা উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। লাখ লাখ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছিল। সে সময় ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধগুলোও এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ মেরামত করা যায়নি। জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্য যেসব আশ্রয়কেন্দ্র বা সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে, সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তদুপরি উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশই এখন পরিত্যক্তপ্রায়। গবাদিপশু রক্ষার কোনো ব্যবস্থাই প্রায় নেই। অথচ ১৯৯২ সালে বিশেষজ্ঞ কমিটি কয়েক মাস ধরে এলাকা পর্যবেক্ষণ করে কি পরিমাণ সাইক্লোন শেল্টার এবং গবাদিপশু রক্ষার জন্য কি পরিমাণ উঁচু মাটির ঢিবি তৈরি করতে হবে, সেই সুপারিশ করেছিল। সেসব সুপারিশের খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার একজন দরিদ্র কৃষকের কাছে একটি গবাদিপশুর মূল্য প্রায় তার জীবনের কাছাকাছি। সেগুলো ছেড়ে সাইক্লোন শেল্টারে যেতে তার মন চায় না। যখন গবাদিপশুর মায়া ত্যাগ করে দূরের কোনো সাইক্লোন শেল্টারের উদ্দেশে ছুটতে থাকে, তখন বড় বেশি দেরি হয়ে যায়।
বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে জলোচ্ছ্বাস নয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমার সময়ও জোয়ারের পানিতে বহু এলাকার ঘরবাড়ি-ফসলি জমি তলিয়ে যায়। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর সর্বত্র প্রায় একই অবস্থা। সাগর উত্তাল থাকলে বা একটু বড় জোয়ার হলে তো কথাই নেই। তাই উপকূলীয় এসব জমিতে ফসল উৎপাদনে কৃষকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আর বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে উদ্বাস্তু হচ্ছেন। জীবিকার সন্ধানে রাজধানী বা বড় শহরগুলোর ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশে এই পরিবেশ-উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে বড় শহরগুলোতে যে চাপ সৃষ্টি হবে_তা মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে। সামাজিক শৃঙ্খলাসহ সব ধরনের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশের আসন্ন সেই ভয়াবহ অবস্থার কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বেশ জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু নিজেদের বাজেটে এই লক্ষ্যে আমরা খুব কমই পদক্ষেপ দেখি, যা মোটেও কাম্য নয়।
বিদেশি সাহায্য না পেলে আমরা কি আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করব না? উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষবাস প্রায় বন্ধ রয়েছে। ফলে খাদ্যাভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। অনেক স্থানে খাবারের চেয়েও বেশি সংকট খাবার পানির। আইলায় নষ্ট হওয়া নলকূপগুলোও এখনো ঠিকমতো চালু করা যায়নি। পুকুরেও নোনাপানি। ফলে আইলা উপদ্রুত এলাকায় পানীয় জলের অভাব এতটাই তীব্র যে এলাকায় বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিল ৩৮ হাজার, তার মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। খুলনার দাকোপের অনেককেই ৩০ কিলোমিটার দূরের খুলনা শহর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কমবেশি একই রকম অবস্থা প্রায় উপকূলজুড়ে। উপকূলের প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবনে আজ যে চরম দুর্দশা বিরাজ করছে, তা নিরসনের বিষয়টি কি বাজেটে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে না? কিন্তু বাজেটে তা কতটুকু অগ্রাধিকার পেয়েছে?
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই সাগর আগ্রাসী হয়ে উঠছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যত বাড়ে ততই বাড়তে থাকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে বঙ্গোপসাগরে ছয়টি ঘূর্ণিঝড় এবং ১০৭টি লঘু ও নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শীতকালে উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরের নদীগুলোতে নোনাপানির অনুপ্রবেশ ক্রমেই বাড়ছে। ইতিমধ্যে বাগেরহাটের সীমান্তবর্তী উপজেলা চিতলমারীতেও নোনাপানির কারণে মাঠের পর মাঠ অনাবাদি পড়ে থাকছে। গোপালগঞ্জ সদরের পরই চিতলমারীর অবস্থান। গোপালগঞ্জ সদরেরও কোনো কোনো এলাকায় নোনাপানি ঢুকছে। নোনাপানি ঢুকছে মাদারীপুরের কিছু কিছু অংশে। ফলে এসব এলাকার স্বাভাবিক ফসল উৎপাদন ব্যাহত তো হচ্ছেই, একই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে সমগ্র জৈববৈচিত্র্য। মিঠাপানিনির্ভর গাছপালা সব মরে যাচ্ছে, বাড়ছে নোনাপানিনির্ভর উদ্ভিদ। বাগেরহাট এলাকার একটি প্রধান অর্থকরী ফসল সুপারি। এলাকায় গেলে দেখা যায়, সুপারি বাগানগুলো মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। নারকেল গাছ কিছুটা নোনাপানি-সহিষ্ণু হলেও অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে।
কয়েক শতাব্দী ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির যে হিসাব পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছিল মাত্র দুই সেন্টিমিটার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেড়েছিল ছয় সেন্টিমিটার। আর গত শতকে বেড়েছে ১৯ সেন্টিমিটার। এভাবে ক্রমেই বাড়ছে উচ্চতা বৃদ্ধির হার। সম্প্রতি বরফ-গতিবিদ্যাকে আমলে নিয়ে বিজ্ঞানীরা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির নতুন যে পূর্বাভাস দিয়েছেন, তা আরো বেশি উদ্বেগজনক। তাতে বলা হয়েছে, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দেড় মিটার বা ১৫০ সেন্টিমিটার বাড়তে পারে। অথচ আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষই বাস করে সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উচ্চতার মধ্যে। আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। তখন তাদের অবস্থা কী হবে? তারা তো আশ্রয়হীন হবেই, সেই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়বে। দেশের মোট খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। অথচ দেশের জনসংখ্যা ততদিনে আরো কয়েক কোটি বাড়বে। তখন যে অবস্থা দাঁড়াবে, তার পরিণাম কি দেশের অবশিষ্ট জনসংখ্যাকেও ভোগ করতে হবে না?
'৯২ সালে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে বেড়িবাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তান আমলে তৈরি বেড়িবাঁধই এখন রক্ষা করা যাচ্ছে না কিংবা রক্ষা করা হচ্ছে না। উচ্চতা বৃদ্ধির সুপারিশ সুপারিশই থেকে গেছে। এটি আমাদের এক ধরনের আত্মবিধ্বংসী উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বর্তমান বাজেটে সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা হবে। কিন্তু তা কি আমরা পেয়েছি?
পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং মংলা বন্দরকে পুনরায় গতিশীল করার সিদ্ধান্ত দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হবে, যদি পরবর্তী ব্যবস্থাগুলো ঠিকমতো নেওয়া হয়। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু ও মংলা বন্দরকে সক্রিয় করতে হবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মংলা পর্যন্ত যাতে ব্যাপকভাবে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে পারে, সে জন্য অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাতে কৃষি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া উপকূলীয় লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। তারা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারবে। বেড়িবাঁধ উঁচু করার পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। বিকল্প কৃষি বা বিকল্প চাষাবাদ সম্প্রসারণে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজটিও রাষ্ট্রকেই করতে হবে। কারণ এলাকার দরিদ্র মানুষের সে ক্ষমতা নেই। এগুলো করা না গেলে পদ্মা সেতু দিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের কাফেলা আসতেই থাকবে।
যা হোক, আমরা আশাবাদী থাকতে চাই, ২১০০ সালেও বাংলাদেশ তার বর্তমান অবস্থানে অটুট থাকবে। সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে আমাদের সব প্রচেষ্টা।
লেখক : সাংবাদিকবর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে জলোচ্ছ্বাস নয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমার সময়ও জোয়ারের পানিতে বহু এলাকার ঘরবাড়ি-ফসলি জমি তলিয়ে যায়। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর সর্বত্র প্রায় একই অবস্থা। সাগর উত্তাল থাকলে বা একটু বড় জোয়ার হলে তো কথাই নেই। তাই উপকূলীয় এসব জমিতে ফসল উৎপাদনে কৃষকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আর বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে উদ্বাস্তু হচ্ছেন। জীবিকার সন্ধানে রাজধানী বা বড় শহরগুলোর ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশে এই পরিবেশ-উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে বড় শহরগুলোতে যে চাপ সৃষ্টি হবে_তা মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে। সামাজিক শৃঙ্খলাসহ সব ধরনের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশের আসন্ন সেই ভয়াবহ অবস্থার কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বেশ জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু নিজেদের বাজেটে এই লক্ষ্যে আমরা খুব কমই পদক্ষেপ দেখি, যা মোটেও কাম্য নয়।
বিদেশি সাহায্য না পেলে আমরা কি আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করব না? উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষবাস প্রায় বন্ধ রয়েছে। ফলে খাদ্যাভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। অনেক স্থানে খাবারের চেয়েও বেশি সংকট খাবার পানির। আইলায় নষ্ট হওয়া নলকূপগুলোও এখনো ঠিকমতো চালু করা যায়নি। পুকুরেও নোনাপানি। ফলে আইলা উপদ্রুত এলাকায় পানীয় জলের অভাব এতটাই তীব্র যে এলাকায় বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিল ৩৮ হাজার, তার মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। খুলনার দাকোপের অনেককেই ৩০ কিলোমিটার দূরের খুলনা শহর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কমবেশি একই রকম অবস্থা প্রায় উপকূলজুড়ে। উপকূলের প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবনে আজ যে চরম দুর্দশা বিরাজ করছে, তা নিরসনের বিষয়টি কি বাজেটে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে না? কিন্তু বাজেটে তা কতটুকু অগ্রাধিকার পেয়েছে?
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই সাগর আগ্রাসী হয়ে উঠছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যত বাড়ে ততই বাড়তে থাকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে বঙ্গোপসাগরে ছয়টি ঘূর্ণিঝড় এবং ১০৭টি লঘু ও নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শীতকালে উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরের নদীগুলোতে নোনাপানির অনুপ্রবেশ ক্রমেই বাড়ছে। ইতিমধ্যে বাগেরহাটের সীমান্তবর্তী উপজেলা চিতলমারীতেও নোনাপানির কারণে মাঠের পর মাঠ অনাবাদি পড়ে থাকছে। গোপালগঞ্জ সদরের পরই চিতলমারীর অবস্থান। গোপালগঞ্জ সদরেরও কোনো কোনো এলাকায় নোনাপানি ঢুকছে। নোনাপানি ঢুকছে মাদারীপুরের কিছু কিছু অংশে। ফলে এসব এলাকার স্বাভাবিক ফসল উৎপাদন ব্যাহত তো হচ্ছেই, একই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে সমগ্র জৈববৈচিত্র্য। মিঠাপানিনির্ভর গাছপালা সব মরে যাচ্ছে, বাড়ছে নোনাপানিনির্ভর উদ্ভিদ। বাগেরহাট এলাকার একটি প্রধান অর্থকরী ফসল সুপারি। এলাকায় গেলে দেখা যায়, সুপারি বাগানগুলো মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। নারকেল গাছ কিছুটা নোনাপানি-সহিষ্ণু হলেও অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে।
কয়েক শতাব্দী ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির যে হিসাব পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছিল মাত্র দুই সেন্টিমিটার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেড়েছিল ছয় সেন্টিমিটার। আর গত শতকে বেড়েছে ১৯ সেন্টিমিটার। এভাবে ক্রমেই বাড়ছে উচ্চতা বৃদ্ধির হার। সম্প্রতি বরফ-গতিবিদ্যাকে আমলে নিয়ে বিজ্ঞানীরা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির নতুন যে পূর্বাভাস দিয়েছেন, তা আরো বেশি উদ্বেগজনক। তাতে বলা হয়েছে, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দেড় মিটার বা ১৫০ সেন্টিমিটার বাড়তে পারে। অথচ আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষই বাস করে সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উচ্চতার মধ্যে। আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। তখন তাদের অবস্থা কী হবে? তারা তো আশ্রয়হীন হবেই, সেই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়বে। দেশের মোট খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। অথচ দেশের জনসংখ্যা ততদিনে আরো কয়েক কোটি বাড়বে। তখন যে অবস্থা দাঁড়াবে, তার পরিণাম কি দেশের অবশিষ্ট জনসংখ্যাকেও ভোগ করতে হবে না?
'৯২ সালে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে বেড়িবাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তান আমলে তৈরি বেড়িবাঁধই এখন রক্ষা করা যাচ্ছে না কিংবা রক্ষা করা হচ্ছে না। উচ্চতা বৃদ্ধির সুপারিশ সুপারিশই থেকে গেছে। এটি আমাদের এক ধরনের আত্মবিধ্বংসী উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বর্তমান বাজেটে সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা হবে। কিন্তু তা কি আমরা পেয়েছি?
পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং মংলা বন্দরকে পুনরায় গতিশীল করার সিদ্ধান্ত দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হবে, যদি পরবর্তী ব্যবস্থাগুলো ঠিকমতো নেওয়া হয়। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু ও মংলা বন্দরকে সক্রিয় করতে হবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মংলা পর্যন্ত যাতে ব্যাপকভাবে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে পারে, সে জন্য অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাতে কৃষি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া উপকূলীয় লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। তারা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারবে। বেড়িবাঁধ উঁচু করার পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। বিকল্প কৃষি বা বিকল্প চাষাবাদ সম্প্রসারণে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজটিও রাষ্ট্রকেই করতে হবে। কারণ এলাকার দরিদ্র মানুষের সে ক্ষমতা নেই। এগুলো করা না গেলে পদ্মা সেতু দিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের কাফেলা আসতেই থাকবে।
যা হোক, আমরা আশাবাদী থাকতে চাই, ২১০০ সালেও বাংলাদেশ তার বর্তমান অবস্থানে অটুট থাকবে। সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে আমাদের সব প্রচেষ্টা।
No comments