রুই-কাতলা ও চুনোপুঁটি by এ এম এম শওকত আলী
দুর্নীতি দমন বিষয়ক আলোচনায় প্রায় সব সময় রুই-কাতলা ও চুনোপুঁটি অর্থাৎ বড় মাছ ও ছোট মাছের উপমা দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের দুর্বলতা প্রকাশ করা। জনমনের এ ধারণা অনেকাংশে সত্য। এ ধারণা রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যত্তিদদ্ধদের মধ্যেও রয়েছে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমনের জন্য সরাসরি দায়িত্বপ্রাপ্ত না হয়েও একজন উপদেষ্টা উক্তি করেছিলেন, 'ধরলে বড় রুই-কাতলা ধরব, ছোট মাছ নয়।' উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া যে এই কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজ দুর্নীতিমুক্ত হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আগে ব্যুরো অব অ্যান্টিকরাপশন দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে ছিল। ওই সময় সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা রুজু করার আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিধান ছিল।
দুর্নীতি দমন কমিশন সৃষ্টির পর এই বিধান ক্রমে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যুক্তি প্রদর্শন করা হয়, এর ফলে কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব করা হবে, অর্থাৎ দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। বিষয়টির সম্প্রতি নিষ্পত্তি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইন থেকে এ বিধান বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হওয়ার আগে এই বিধানের ফলে দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত কার্যক্রম কতটুকু বা কিভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে তার তথ্যভিত্তিক কোনো পর্যালোচনা হয়নি। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে সংশ্লিষ্ট আইনে এই বিধানের অপপ্রয়োগ যাতে না হয়, তার ব্যবস্থাও ছিল। যদি অনূর্ধ্ব ৬০ দিনের মধ্যে সরকার এ-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে অপারগ হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট আদালত মামলা আমলে নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবেন। এ-সংক্রান্ত বিষয়ে কতগুলো মামলা সংশ্লিষ্ট আদালত নিষ্পত্তি করেছেন, তার কোনো হিসাব কারো কাছে নেই। যদি এই হিসাব থাকত তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হতো।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টার উক্তিটির বিষয় বিশ্লেষণের প্রয়োজন। ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কার্যক্রম কমিশন জোরেশোরে শুরু করে। কিন্তু কমিশনের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, কারণ মূল চালকের আসনে ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ওই সময় বহুসংখ্যক রুই-কাতলা ধরা পড়েছিল। এদের কিছু রাজনীতিবিদ, কিছু ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ আমলা। তবে কিছুদিন পর জনমনের উল্লাস স্তিমিত হয়। কারণ মূলত দুটি। বেশির ভাগ মামলা আইনসিদ্ধ হয়নি। ফলে আসামিরা অব্যাহতি গ্রহণে সক্ষম হয়। কিছু মামলা এখনো বিচারাধীন। দ্বিতীয়, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে রুজু করা মামলায় জনমনে পাল্টা ধারণাও হয়। ধারণা করা হয় যে এসব কার্যক্রম অনেকটা প্রতিহিংসামূলক। এর মধ্যে আরো একটি সুপ্ত ধারণা ছিল। অনির্বাচিত সরকার গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ধারণা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্য কারণ ছিল দুটি বৃহৎ দলের প্রধানদের আটকাদেশ।
ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে সরকারের একজন মন্ত্রী দুর্নীতিসংক্রান্ত আলোচনায় বড় মাছ ও ছোট মাছের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সূত্র অনুযায়ী, তিনি আক্ষেপ করে বলেন যে বড় মাছ সুরক্ষিত থাকে অথচ ছোট মাছ দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের শিকার হয়। উল্লেখ্য, এই উক্তির পূর্বেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর পূর্বসূরির বিরুদ্ধে যে তদন্ত কমিশন করে, তাতে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাঁর পূর্বসূরির বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতি আন্তর্জাতিক ও দেশের অভ্যন্তরেও ছিল বহুল আলোচিত। প্রবল গণবিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত পূর্বসূরিকে মন্ত্রীর আসন থেকে পদত্যাগ করতে হয়। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে এই রীতি প্রচলিত। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও সংশ্লিষ্ট দলের ভাবমূর্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ক্ষমতাসীন সরকার পূর্বসূরিকে পুনরায় কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করবে কি না তা এখনই বলা যায় না। তবে আন্তর্জাতিক ধারণা হলো, তিনি এখনো সম্পূর্ণ দায়মুক্তি গ্রহণের উপযুক্ত নন। কারণ তাঁর বিরদ্ধে আনীত অভিযোগ কানাডার পুলিশ তদন্ত করছে।
এ কারণেই ওয়াশিংটনের একটি বৃহৎ অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতুর জন্য এখনো অর্থ অবমুক্ত করেনি। উল্লেখ্য, এ দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ওই প্রতিষ্ঠানকে তদন্তে সহায়তা বা সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল। এতে কোনো সাড়া মেলেনি। অর্থাৎ এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য তারা কমিশনকে পাঠায়নি। এই প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি বোধগম্য নয়। এই প্রতিষ্ঠানটিসহ অর্থ প্রদানকারী অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশি সাহায্যপুষ্ট সব প্রকল্পেই কয়েক বছর ধরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অথচ কী কারণে তারা কমিশনের অনুরোধে নীরব তা হয়তো কোনো দিন জানা যাবে না। অথচ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মন্ত্রে তারা সোচ্চার। ধারণা করা সম্ভব যে ওয়াশিংটনস্থ প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা ভিত্তিহীন সংবাদ গ্রহণ করেই অর্থায়ন বন্ধ করেছে।
বাংলাদেশের মিডিয়ার জন্য পূর্বসূরির বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ ছিল 'সুখবর', কারণ বিষয়টি পাঠকদের জন্য একটি মুখরোচক খবর হবে। বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর সব দেশের মিডিয়াই এ ধরনের খবর সানন্দে গ্রহণ করে। এর ভালো-মন্দ দুই দিকই রয়েছে। ভালো দিকটা হলো, এর ফলে উচ্চপর্যায়ের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা কোনো অভিযোগের বিষয়ে সচেতন থাকে। একই সঙ্গে এর জন্য তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথাসম্ভব ত্রুটি এড়ানোর চেষ্টা করে। মন্দ দিক হলো, শেষ পর্যন্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন অনিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পূর্বসূরির সুনামের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অন্য বিষয়টি এখনো অজানা। কমিশন কি কানাডীয় পুলিশকে সংশ্লিষ্ট অভিযোগের তথ্য দিতে অনুরোধ করেছিল? করলেও ওই দেশের পুলিশ তদন্ত সমাপ্তির পূর্বে বিষয়টি গোপন রাখার বিষয়ে যত্নবান ছিল। সব দেশের তদন্ত সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি একই ধরনের। তদন্তের স্বার্থে কোনো তথ্য আগাম প্রকাশ করা হয় না।
সরকারি সূত্র অনুযায়ী, সম্পূর্ণ অভিযোগের উৎপত্তি টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী কিছু প্রতিষ্ঠানের। এ কারণ গ্রহণযোগ্য। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান টেন্ডার লাভে সমর্থ হয় না, তারাই ক্রমাগত নালিশ রুজু করে। এই নালিশে অনিয়মের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়। সরকারি ও দাতা সংস্থার ক্রয়সংক্রান্ত আইন/রীতিমতে এ ধরনের নালিশ নিষ্পত্তির পদ্ধতিও বলা আছে। এ ক্ষেত্রে সে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল কি না তা স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করা যায়, নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। কারণ বিষয়টি বাধ্যতামূলক। এ বিষয়টি সরকারের তরফ থেকে স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। তাহলেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে।
ক্ষমতাসীন সরকারের যে মন্ত্রী বড় মাছ ধরা পড়ে না, ছোট মাছই ধরা পড়ে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন. তিনি দুর্নীতি দমন সার্থক করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনের বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া সব রাজনৈতিক দলের এ বিষয়ে একমত হওয়ার কথাও বলেছেন। তিনি ভালোই বলেছেন। তবে এর সঙ্গে যোগ করতে হবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়টি। এ অঙ্গীকার অবশ্য সব দলেরই নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়। কার্যত এর কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। অনেকের ধারণা যে অঙ্গীকারের ফলাফল দৃশ্যমান করলে প্রশাসনে দুর্নীতি অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
এ বিষয়ে বলা যায়, অন্তত একটি বিষয়ে ক্ষমতাসীন সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার স্বাক্ষর রেখেছে। সরকার সম্প্রতি গণকর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু সংক্রান্ত আইনি বিধান রদ করেছে। তবে নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি র্নিমূল করার বিষয়টি দৃশ্যমান নয়। এটা অবশ্য কোনো দিনই ছিল না। ভবিষ্যতে দেখা যাবে কি না তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছাসহ অঙ্গীকারও দৃশ্যমান করা।
রাজনৈতিক দলগুলো কি স্বনিয়ন্ত্রণের পথে এগোতে পারে না? যদি তারা এ বিষয় নিশ্চিত করে, তাহলে সব দলেরই সব স্তরে দুর্নীতির স্থান থাকবে না। এর ফলে প্রশাসনও সার্বিকভাবে দুর্নীতিমুক্ত হবে। দলগুলোর উচিত হবে এ বিষয়ে অধিকতর যত্নবান হওয়া। দলের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা যদি দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, তাহলেই জনস্বার্থ অধিকতর সুরক্ষিত হবে। উল্লেখ্য, এ প্রসঙ্গে সময় সময় উচ্চপর্যায়ের নেতারা অনেক কিছুই বলেন। তবে এর ব্যত্যয় হলো, কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। দলীয় টেন্ডারবাজির কথা কে না জানে! টেন্ডারবাজির দুটি দিক_ এক, অন্যদের দরপত্র পেশ করা বন্ধ করা, যা ত্রাসের সৃষ্টি করে করা হয়। দুই, আপস করে নিজেদের মধ্যে টেন্ডার ভাগাভাগি করা। দলের ছোট মাছই এ ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত বলে বহু অভিযোগ ইতিপূর্বে মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে।
ওয়াশিংটনের সেই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক সাহায্য প্রদানের কার্যক্রম তৃতীয় পক্ষ দিয়ে তত্ত্বাবধান করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ সরকারি নজরদারি ফলপ্রসূ নয়। সম্পদের অপব্যবহারসহ দুর্নীতির বিষয়টি সর্বজনবিদিত। সরকারি নজরদারি কেন ফলপ্রসূ হয়নি তার কারণও রাজনৈতিক। সে সমস্যা দূর করতে না পারলে তৃতীয় পক্ষের তত্ত্বাবধান কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments