সহজিয়া কড়চা-রাষ্ট্রনেতাদের শীর্ষ বৈঠক: জনগণের নিয়তি by সৈয়দ আবুল মকসুদ
এক ঘরোয়া কথাবার্তায় আমি বলেছিলাম, কন্যাকুমারী ভারত মহাসাগরের পানিতে দাঁড়িয়ে আমি ভাবাবেগে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এই আমাদের ভারতবর্ষ, যেখানে পাঁচ হাজার বছরে কত সভ্যতার জন্ম হয়েছে কথাটা শুনে আমার এক প্রগতিশীল মুসলমান বন্ধুর শুধু সন্দেহ নয়, বদ্ধমূল ধারণা হলো—লোকটা স্রেফ প্রো-ইন্ডিয়ান।
এবং শুধু ভারতপন্থী নয়, একজন মাঝারি গোছের ভারতের দালাল। ‘র’-এর লোকও হতে পারে। তিনি বললেন, কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরের পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আপনার আবেগ এল না, আবেগ দেখা গেল কন্যাকুমারীতে গিয়ে। আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের ‘ভারতবর্ষ’ শব্দ দুটি তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রমাণ হিসেবে সাহায্য করেছিল।
আরেক দিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, এই যে সারা দিন ভারতের চ্যানেলগুলোর হিন্দি সিরিয়াল দেখছে আমাদের ছেলেমেয়েরা, হিন্দি, ইংরেজি ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে সংলাপ শুনছে, ওসব নকল করে এককথায় বাংলা ভাষাটাকে বিকৃত করে ফেলবে। যার ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে হবে সুদূরপ্রসারী।
আমার এই স্বপ্রণোদিত মন্তব্যে আমার এক হিতাকাঙ্ক্ষী হিন্দু বন্ধু অপ্রসন্ন হলেন। তাঁর অপ্রসন্নতা গোপন রইল না। তাঁর অর্থবহ নীরবতামূলক আচরণে সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল, তিনি ধরে নিয়েছেন, ইনি তো দেখছি ভেতরে ভেতরে ভারতবিদ্বেষী। ভারতবান্ধব হলে হিন্দি ফিল্ম ও ভারতের চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে বলতেই পারেন না।
কন্যাকুমারীর কথায় মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন আমার ‘মুসলমান’ বন্ধু। ভারতীয় চ্যানেলের প্রসঙ্গে অসন্তুষ্ট যিনি হন তিনি ‘হিন্দু’। এই যে উপমহাদেশে ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পর থেকে দুটি শব্দ ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’ উচ্চারিত হচ্ছে তা আর স্রেফ দুটি শব্দ নয়; তা দুটি ধারণা, যার তাৎ পর্য বিরাট। এই দুটি শব্দ বহু কিছু ভাঙে ও বহু কিছু গড়ে এবং বিচিত্র বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এই দুটি শব্দ ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভাগ করে দুটি প্রদেশ করে, এই দুটি শব্দ ১৯১১ সালে সেই ‘বাংলা ভাগ’ বাতিল করে, এই দুটি শব্দ ১৯৪৭ সালে বাংলাকে দুটি বড় রাষ্ট্রের অংশ করে। যার এক অংশ ১৯৭১ সালে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যার আত্মপ্রকাশে আরেকটি অংশ যা ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্গত, অতুলনীয় সাহায্য করে। সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাষ্ট্রীয় সফরে আজ বাংলাদেশে আসছেন। তাঁকে জানাই স্বাগতম।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণ করার বছর খানেকের মধ্যে ভারত সফর করেন। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কিন্তু আজকের সফর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের ফিরতি সফর মনে করা ঠিক হবে না। এই সফরের গুরুত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি।
ড. মনমোহন সিং আওয়ামী লীগের আমন্ত্রণে আসেননি, বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত মুখপাত্র ও নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে এসেছেন। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের আমন্ত্রিত সবচেয়ে সম্মানিত অতিথি। তিনি আজ এসেছেন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস ও তার সহযোগী দলগুলোর পক্ষ থেকে নয়—ভারতের ১২০ কোটি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে। ১৬ কোটি মানুষের বাড়িতে মেহমান হয়ে এলেন ১২০ কোটি মানুষের প্রতিনিধি। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করা ১৬ কোটি মানুষের কর্তব্য। গরিবের পক্ষে ধনীকে যতটুকু সমাদর করা সম্ভব, আশা করি তা করতে আমাদের জনগণ কার্পণ্য করবে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে দুই দেশের পত্রপত্রিকায় গত দুই মাসে বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখকদের মধ্যে রয়েছেন অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি, যাঁদের রাজনীতি, কূটনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ওই সব গুরুতর বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা অতি সামান্য। কিন্তু অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয়, বিদগ্ধজনদের কোনো লেখাই আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ও মুখপাত্রদের কথাবার্তায়ও। বাংলাদেশের প্রত্যেক পাঠক-শ্রোতা ও নাগরিককে সন্তুষ্ট করতে তাঁরা বাধ্য নন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যাকে আমরা বলি ‘জনগণ’—তাকে সন্তুষ্ট করা না গেলে বুঝতে হবে, জনগণের মনের সঙ্গে সরকারের মনের কোথায় যেন অমিল রয়েছে। জনগণের মনস্তত্ত্ব বুঝতে যদি কোনো গণতান্ত্রিক সরকার অসমর্থ হয়, অথবা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে যদি উপেক্ষা করা হয়, তা সরকার ও দেশবাসী কারও জন্যই কল্যাণকর নয়।
যেসব রচনা গত কয়েক মাসে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নেই। যেসব বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কখনো কখনো শীতল হয়, তার কারণগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ নেই। সত্য অনুসন্ধানের চেয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা বেশি। কঠিন যুক্তির চেয়ে তরল আবেগের পরিমাণ অতি বেশি। কিছু কিছু লেখা পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, শুধু রচনা লিখেই দুই দেশের সম্পর্ক ভালো করা যাবে, আর কিছু করার দরকার নেই। লেখকেরা নিজে দুই দেশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক চান—এই শুভ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে লেখায়, তা অর্জন করতে গেলে ‘কঠিনেরে ভালোবাসিবার’ শক্তি দরকার, সে কথা নেই।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কোনো কথা বলতে গেলে বা লিখতে গেলে লেখক ও বক্তাকে প্রথমেই বিবেচনা করতে হবে দুই দেশের ইতিহাস, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের জন্মবৃত্তান্ত, দুই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মপরিচয়, দুই দেশের আনুপাতিক আকার, তাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান প্রভৃতি। সবচেয়ে বেশি জানতে হবে দুই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনের গড়নটি কী? দুই দেশের শরীর অর্থাৎ ‘বস্তু’ নিয়ে যত কথাই বলি না কেন—দুই দেশের ‘মন’টাই আসল। দুই দেশের মন মানে দুই দেশের মানুষের মন—শাসকদের মন নয়।
দুই দেশের শাসকদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা বন্ধুত্বের একটা মূল্য অবশ্যই রয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের নেতাদের সম্পর্ক চমৎ কার। ভারতের শাসকশ্রেণীও তাঁকে পছন্দ করে। তাঁর অসাম্প্রদায়িক নীতি ভারতে প্রশংসিত। তিনি আন্তরিকভাবেই চান ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক। শোনা যায়, তিনি গত বছর ভারত সফরে যাওয়ার সময় ‘দশ ট্রাক’ ইলিশ নিয়ে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে। সেখানে গিয়ে তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তাঁর গভীর ভারতপ্রীতির প্রকাশ ঘটে এবং ভারতীয় পত্রপত্রিকা তা ফলাও করে কয়েক দিনব্যাপী প্রচার করে। আবেগপ্রবণ ভারতীয় সাংবাদিকদের কোনো কোনো ছলো ছলো লেখা নিজের দেশে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রাখতে সহায়ক হয়নি।
ফিরতি সফরকালে এবার যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী কুড়ি ট্রাক ভর্তি বেনারসি শাড়ি ও গরম মসলা নিয়ে আসেন শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে—নিশ্চয়ই তারও একটি মূল্য আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি আদৌ আসেন এবং সঙ্গে আনেন কুড়ি ট্রাক আলু, তারও নিশ্চয়ই মূল্য থাকবে। কিন্তু দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পদ্মার ইলিশ, সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়ি, পশ্চিমবঙ্গের আলুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তা অনেক বিস্তৃত, অনেক জটিল। দুই দেশের মধ্যে বহু অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে। দুই দেশের সম্ভাবনার অফুরন্ত ক্ষেত্র রয়েছে। দুই দেশের জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার প্রাচীরও রয়েছে। দুই দেশের কাছেই দুই দেশের চাওয়া ও পাওয়ার আছে অনেক কিছু। ভারত কী পাচ্ছে তা বাংলাদেশের মানুষ সুস্পষ্টভাবে জেনে গেছে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, উপদেষ্টাদ্বয় ও কাগজের কল্যাণে। কিন্তু বাংলাদেশ কী পাবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্ররা বলছেন এই চুক্তি হবে, সেই চুক্তি হবে। খবরের কাগজ হইহই করে উঠছে। তখন তাঁরাই আবার বলছেন: আমাদের কথা ভেবে ৩৯ বছর আগেই আমাদের নেতারা চুক্তি করে গেছেন। ওতেই কাজ হবে। নতুন কিছু করার প্রয়োজন নেই। একই বিষয়ে একই ব্যক্তি আজ এক কথা, কাল এক কথা বলছেন। চুক্তি ও দেনা-পাওনা নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা নেই।
যে আমই চেনে না, সে যদি একটি ফজলি আমকে বলে আমড়া বা আতাফল, তাতে দোষ নেই। কিন্তু যে আলবত চেনে আম জিনিসটি কী, সে যদি সকালবেলা বলে এটা আতাফল, দুপুরে বলে নোনাফল, অপরাহ্নে বলে পেয়ারা, সায়াহ্নে বলে আপেল এবং সন্ধ্যার পর বলে, এটাকে আমও বলা যায়, আতাও বলা যায়; তখন শ্রোতাদের কাছে তিনি বিশ্বাসযোগ্যতা হারান। তারা মনে করে, হয় তিনি জানেন না ফজলি আম কী, অথবা তিনি মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছেন। তা ছাড়া আম থেকেই আমসত্ত্ব হয়। কিন্তু আম আর আমসত্ত্ব এক জিনিস নয়। দুটোর অবয়ব ও স্বাদ আলাদা। দুই উপদেষ্টা এখন তাঁদের কাজের দায়দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে খালাস। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার কার্যালয়ের মধ্যে দূরত্ব তিন মাইল। তাঁদের মধ্যেই যদি সৌহার্দ্য না থাকে, ঢাকা-দিল্লির মধ্যে দূরত্ব এক হাজার কিলোমিটার, তাঁদের মধ্যে সৌহার্দ্য কীভাবে হবে।
আমরা প্রতিবেশীর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চাই। অথচ নিজেদের মধ্যেই বন্ধুত্ব গড়তে পারি না। আমরা আমাদের নিজেদের দেশের ভেতরের সমস্যাই নিজেরা বসে মীমাংসা করতে পারি না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অমীমাংসিত সমস্যা রাতারাতি দূর করে ফেলব, তা ভাবা নির্বুদ্ধিতা।
নির্বাচিত হয়ে বিএনপি দুইবার ক্ষমতায় ছিল। খালেদা জিয়া ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রিত্ব করেন। তাঁর দলে বহু অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। কিন্তু সাবলীল বৈদেশিক নীতি বলতে তাঁদের কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। হতে পারে আমার অজ্ঞতা তার জন্য দায়ী। ভারতের পত্রপত্রিকা থেকে ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু জেনেছি, তাতে বুঝতে পেরেছি ২০০১ সালে বেগম জিয়ার সরকারের সঙ্গে ভারত সরকার সহযোগিতামূলক কাজ করতে আন্তরিকভাবে চেয়েছিল। বিএনপির ভারতবিরোধী গোষ্ঠী সে আহ্বানে সাড়া দেয় নাই। সাড়া না দিয়ে তাঁরা নিজেরা কতটা লাভবান হয়েছেন তা তাঁরা জানেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে বিরাট।
বৈশ্বিক পর্যায়ে ও আঞ্চলিক পর্যায়ে আমাদের একটি সর্বদলীয় পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। দেরিতে হলেও এখনো করা যায়। সে জন্য প্রধান দলগুলোকে এ ব্যাপারে পরস্পরের কাছে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতির যে বিশ্রী মেরুকরণ, তাতে নিকট ভবিষ্যতে কোনো ব্যাপারেই সর্বদলীয় সিদ্ধান্ত নিতে যে পারব, সে ভরসা নেই।
প্রকাণ্ড পণ্ডিত ও স্বনামধন্যদের দৃষ্টি বড় বড় ব্যাপারে—এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ, পাঁচতারা হোটেল, লোভনীয় অঙ্কের দৈনিক ডলারে ভাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখ ছোট ছোট জিনিসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেই ছেলেমেয়েরা নানা ব্যাপারে কথা বলে, ঘিরে ধরে। সেদিন কলাভবনের বারান্দায় এক ছেলে জিজ্ঞেস করল: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অফিশিয়াল সাক্ষাৎ করার সময় টাই পরে যাননি। এর তাৎ পর্য কী? পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁকে স্যুট পরা দেখা গেল।
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি আইনানুগ মর্যাদা আছে। কোনো রাষ্ট্রের খুব বড় একটি প্রদেশের চেয়ে স্বাধীন একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মর্যাদা বেশি। যেমন, ভারতের কোনো প্রদেশের যেকোনো মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মর্যাদা উচ্চতর।
একদিন আমরা পাকিস্তানের প্রদেশ ছিলাম। সেই পাকিস্তানে দুটি শীর্ষ বৈঠক ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের করা চুক্তি ছিল ঐতিহাসিক। একটি ১৯৫০ সালে লিয়াকত-নেহেরু চুক্তি, দুই দেশের উদ্বাস্তু বিষয়ে; আরেকটি আইয়ুব-নেহেরু চুক্তি। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের শৈলনিবাস মারীতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু করেন ‘ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি’—সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি। স্বাধীনতার পর ঐতিহাসিক শীর্ষ বৈঠক হয় বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে। এবার হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠককে সে রকম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে চাই।
সম্পূর্ণ সদিচ্ছা থেকে খুব ভালো কাজ করার পরও জনগণ যদি তা গ্রহণ না করে, জনমত থাকে বিপক্ষে, তাতে লাভ নেই। দুই দেশের সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধান এক শীর্ষ বৈঠকেও সম্ভব নয়। তবে হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠক সহযোগিতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বড় সুযোগ। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা উচিত বেগম জিয়ারও। সুযোগটি যদি হাতছাড়া হয়, তার অপব্যবহার হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যের। তা হোক, তা আমরা চাই না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আরেক দিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, এই যে সারা দিন ভারতের চ্যানেলগুলোর হিন্দি সিরিয়াল দেখছে আমাদের ছেলেমেয়েরা, হিন্দি, ইংরেজি ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে সংলাপ শুনছে, ওসব নকল করে এককথায় বাংলা ভাষাটাকে বিকৃত করে ফেলবে। যার ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে হবে সুদূরপ্রসারী।
আমার এই স্বপ্রণোদিত মন্তব্যে আমার এক হিতাকাঙ্ক্ষী হিন্দু বন্ধু অপ্রসন্ন হলেন। তাঁর অপ্রসন্নতা গোপন রইল না। তাঁর অর্থবহ নীরবতামূলক আচরণে সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল, তিনি ধরে নিয়েছেন, ইনি তো দেখছি ভেতরে ভেতরে ভারতবিদ্বেষী। ভারতবান্ধব হলে হিন্দি ফিল্ম ও ভারতের চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে বলতেই পারেন না।
কন্যাকুমারীর কথায় মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন আমার ‘মুসলমান’ বন্ধু। ভারতীয় চ্যানেলের প্রসঙ্গে অসন্তুষ্ট যিনি হন তিনি ‘হিন্দু’। এই যে উপমহাদেশে ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পর থেকে দুটি শব্দ ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’ উচ্চারিত হচ্ছে তা আর স্রেফ দুটি শব্দ নয়; তা দুটি ধারণা, যার তাৎ পর্য বিরাট। এই দুটি শব্দ বহু কিছু ভাঙে ও বহু কিছু গড়ে এবং বিচিত্র বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এই দুটি শব্দ ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভাগ করে দুটি প্রদেশ করে, এই দুটি শব্দ ১৯১১ সালে সেই ‘বাংলা ভাগ’ বাতিল করে, এই দুটি শব্দ ১৯৪৭ সালে বাংলাকে দুটি বড় রাষ্ট্রের অংশ করে। যার এক অংশ ১৯৭১ সালে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যার আত্মপ্রকাশে আরেকটি অংশ যা ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্গত, অতুলনীয় সাহায্য করে। সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাষ্ট্রীয় সফরে আজ বাংলাদেশে আসছেন। তাঁকে জানাই স্বাগতম।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণ করার বছর খানেকের মধ্যে ভারত সফর করেন। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কিন্তু আজকের সফর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের ফিরতি সফর মনে করা ঠিক হবে না। এই সফরের গুরুত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি।
ড. মনমোহন সিং আওয়ামী লীগের আমন্ত্রণে আসেননি, বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত মুখপাত্র ও নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে এসেছেন। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের আমন্ত্রিত সবচেয়ে সম্মানিত অতিথি। তিনি আজ এসেছেন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস ও তার সহযোগী দলগুলোর পক্ষ থেকে নয়—ভারতের ১২০ কোটি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে। ১৬ কোটি মানুষের বাড়িতে মেহমান হয়ে এলেন ১২০ কোটি মানুষের প্রতিনিধি। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করা ১৬ কোটি মানুষের কর্তব্য। গরিবের পক্ষে ধনীকে যতটুকু সমাদর করা সম্ভব, আশা করি তা করতে আমাদের জনগণ কার্পণ্য করবে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে দুই দেশের পত্রপত্রিকায় গত দুই মাসে বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখকদের মধ্যে রয়েছেন অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি, যাঁদের রাজনীতি, কূটনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ওই সব গুরুতর বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা অতি সামান্য। কিন্তু অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয়, বিদগ্ধজনদের কোনো লেখাই আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ও মুখপাত্রদের কথাবার্তায়ও। বাংলাদেশের প্রত্যেক পাঠক-শ্রোতা ও নাগরিককে সন্তুষ্ট করতে তাঁরা বাধ্য নন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যাকে আমরা বলি ‘জনগণ’—তাকে সন্তুষ্ট করা না গেলে বুঝতে হবে, জনগণের মনের সঙ্গে সরকারের মনের কোথায় যেন অমিল রয়েছে। জনগণের মনস্তত্ত্ব বুঝতে যদি কোনো গণতান্ত্রিক সরকার অসমর্থ হয়, অথবা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে যদি উপেক্ষা করা হয়, তা সরকার ও দেশবাসী কারও জন্যই কল্যাণকর নয়।
যেসব রচনা গত কয়েক মাসে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নেই। যেসব বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কখনো কখনো শীতল হয়, তার কারণগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ নেই। সত্য অনুসন্ধানের চেয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা বেশি। কঠিন যুক্তির চেয়ে তরল আবেগের পরিমাণ অতি বেশি। কিছু কিছু লেখা পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, শুধু রচনা লিখেই দুই দেশের সম্পর্ক ভালো করা যাবে, আর কিছু করার দরকার নেই। লেখকেরা নিজে দুই দেশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক চান—এই শুভ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে লেখায়, তা অর্জন করতে গেলে ‘কঠিনেরে ভালোবাসিবার’ শক্তি দরকার, সে কথা নেই।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কোনো কথা বলতে গেলে বা লিখতে গেলে লেখক ও বক্তাকে প্রথমেই বিবেচনা করতে হবে দুই দেশের ইতিহাস, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের জন্মবৃত্তান্ত, দুই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মপরিচয়, দুই দেশের আনুপাতিক আকার, তাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান প্রভৃতি। সবচেয়ে বেশি জানতে হবে দুই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনের গড়নটি কী? দুই দেশের শরীর অর্থাৎ ‘বস্তু’ নিয়ে যত কথাই বলি না কেন—দুই দেশের ‘মন’টাই আসল। দুই দেশের মন মানে দুই দেশের মানুষের মন—শাসকদের মন নয়।
দুই দেশের শাসকদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা বন্ধুত্বের একটা মূল্য অবশ্যই রয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের নেতাদের সম্পর্ক চমৎ কার। ভারতের শাসকশ্রেণীও তাঁকে পছন্দ করে। তাঁর অসাম্প্রদায়িক নীতি ভারতে প্রশংসিত। তিনি আন্তরিকভাবেই চান ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক। শোনা যায়, তিনি গত বছর ভারত সফরে যাওয়ার সময় ‘দশ ট্রাক’ ইলিশ নিয়ে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে। সেখানে গিয়ে তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তাঁর গভীর ভারতপ্রীতির প্রকাশ ঘটে এবং ভারতীয় পত্রপত্রিকা তা ফলাও করে কয়েক দিনব্যাপী প্রচার করে। আবেগপ্রবণ ভারতীয় সাংবাদিকদের কোনো কোনো ছলো ছলো লেখা নিজের দেশে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রাখতে সহায়ক হয়নি।
ফিরতি সফরকালে এবার যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী কুড়ি ট্রাক ভর্তি বেনারসি শাড়ি ও গরম মসলা নিয়ে আসেন শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে—নিশ্চয়ই তারও একটি মূল্য আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি আদৌ আসেন এবং সঙ্গে আনেন কুড়ি ট্রাক আলু, তারও নিশ্চয়ই মূল্য থাকবে। কিন্তু দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পদ্মার ইলিশ, সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়ি, পশ্চিমবঙ্গের আলুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তা অনেক বিস্তৃত, অনেক জটিল। দুই দেশের মধ্যে বহু অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে। দুই দেশের সম্ভাবনার অফুরন্ত ক্ষেত্র রয়েছে। দুই দেশের জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার প্রাচীরও রয়েছে। দুই দেশের কাছেই দুই দেশের চাওয়া ও পাওয়ার আছে অনেক কিছু। ভারত কী পাচ্ছে তা বাংলাদেশের মানুষ সুস্পষ্টভাবে জেনে গেছে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, উপদেষ্টাদ্বয় ও কাগজের কল্যাণে। কিন্তু বাংলাদেশ কী পাবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্ররা বলছেন এই চুক্তি হবে, সেই চুক্তি হবে। খবরের কাগজ হইহই করে উঠছে। তখন তাঁরাই আবার বলছেন: আমাদের কথা ভেবে ৩৯ বছর আগেই আমাদের নেতারা চুক্তি করে গেছেন। ওতেই কাজ হবে। নতুন কিছু করার প্রয়োজন নেই। একই বিষয়ে একই ব্যক্তি আজ এক কথা, কাল এক কথা বলছেন। চুক্তি ও দেনা-পাওনা নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা নেই।
যে আমই চেনে না, সে যদি একটি ফজলি আমকে বলে আমড়া বা আতাফল, তাতে দোষ নেই। কিন্তু যে আলবত চেনে আম জিনিসটি কী, সে যদি সকালবেলা বলে এটা আতাফল, দুপুরে বলে নোনাফল, অপরাহ্নে বলে পেয়ারা, সায়াহ্নে বলে আপেল এবং সন্ধ্যার পর বলে, এটাকে আমও বলা যায়, আতাও বলা যায়; তখন শ্রোতাদের কাছে তিনি বিশ্বাসযোগ্যতা হারান। তারা মনে করে, হয় তিনি জানেন না ফজলি আম কী, অথবা তিনি মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছেন। তা ছাড়া আম থেকেই আমসত্ত্ব হয়। কিন্তু আম আর আমসত্ত্ব এক জিনিস নয়। দুটোর অবয়ব ও স্বাদ আলাদা। দুই উপদেষ্টা এখন তাঁদের কাজের দায়দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে খালাস। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার কার্যালয়ের মধ্যে দূরত্ব তিন মাইল। তাঁদের মধ্যেই যদি সৌহার্দ্য না থাকে, ঢাকা-দিল্লির মধ্যে দূরত্ব এক হাজার কিলোমিটার, তাঁদের মধ্যে সৌহার্দ্য কীভাবে হবে।
আমরা প্রতিবেশীর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চাই। অথচ নিজেদের মধ্যেই বন্ধুত্ব গড়তে পারি না। আমরা আমাদের নিজেদের দেশের ভেতরের সমস্যাই নিজেরা বসে মীমাংসা করতে পারি না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অমীমাংসিত সমস্যা রাতারাতি দূর করে ফেলব, তা ভাবা নির্বুদ্ধিতা।
নির্বাচিত হয়ে বিএনপি দুইবার ক্ষমতায় ছিল। খালেদা জিয়া ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রিত্ব করেন। তাঁর দলে বহু অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। কিন্তু সাবলীল বৈদেশিক নীতি বলতে তাঁদের কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। হতে পারে আমার অজ্ঞতা তার জন্য দায়ী। ভারতের পত্রপত্রিকা থেকে ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু জেনেছি, তাতে বুঝতে পেরেছি ২০০১ সালে বেগম জিয়ার সরকারের সঙ্গে ভারত সরকার সহযোগিতামূলক কাজ করতে আন্তরিকভাবে চেয়েছিল। বিএনপির ভারতবিরোধী গোষ্ঠী সে আহ্বানে সাড়া দেয় নাই। সাড়া না দিয়ে তাঁরা নিজেরা কতটা লাভবান হয়েছেন তা তাঁরা জানেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে বিরাট।
বৈশ্বিক পর্যায়ে ও আঞ্চলিক পর্যায়ে আমাদের একটি সর্বদলীয় পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। দেরিতে হলেও এখনো করা যায়। সে জন্য প্রধান দলগুলোকে এ ব্যাপারে পরস্পরের কাছে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতির যে বিশ্রী মেরুকরণ, তাতে নিকট ভবিষ্যতে কোনো ব্যাপারেই সর্বদলীয় সিদ্ধান্ত নিতে যে পারব, সে ভরসা নেই।
প্রকাণ্ড পণ্ডিত ও স্বনামধন্যদের দৃষ্টি বড় বড় ব্যাপারে—এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ, পাঁচতারা হোটেল, লোভনীয় অঙ্কের দৈনিক ডলারে ভাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখ ছোট ছোট জিনিসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেই ছেলেমেয়েরা নানা ব্যাপারে কথা বলে, ঘিরে ধরে। সেদিন কলাভবনের বারান্দায় এক ছেলে জিজ্ঞেস করল: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অফিশিয়াল সাক্ষাৎ করার সময় টাই পরে যাননি। এর তাৎ পর্য কী? পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁকে স্যুট পরা দেখা গেল।
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি আইনানুগ মর্যাদা আছে। কোনো রাষ্ট্রের খুব বড় একটি প্রদেশের চেয়ে স্বাধীন একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মর্যাদা বেশি। যেমন, ভারতের কোনো প্রদেশের যেকোনো মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মর্যাদা উচ্চতর।
একদিন আমরা পাকিস্তানের প্রদেশ ছিলাম। সেই পাকিস্তানে দুটি শীর্ষ বৈঠক ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের করা চুক্তি ছিল ঐতিহাসিক। একটি ১৯৫০ সালে লিয়াকত-নেহেরু চুক্তি, দুই দেশের উদ্বাস্তু বিষয়ে; আরেকটি আইয়ুব-নেহেরু চুক্তি। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের শৈলনিবাস মারীতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু করেন ‘ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি’—সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি। স্বাধীনতার পর ঐতিহাসিক শীর্ষ বৈঠক হয় বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে। এবার হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠককে সে রকম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে চাই।
সম্পূর্ণ সদিচ্ছা থেকে খুব ভালো কাজ করার পরও জনগণ যদি তা গ্রহণ না করে, জনমত থাকে বিপক্ষে, তাতে লাভ নেই। দুই দেশের সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধান এক শীর্ষ বৈঠকেও সম্ভব নয়। তবে হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠক সহযোগিতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বড় সুযোগ। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা উচিত বেগম জিয়ারও। সুযোগটি যদি হাতছাড়া হয়, তার অপব্যবহার হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যের। তা হোক, তা আমরা চাই না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments