চরাচর-বইমেলা বন্দনা by মযহারুল ইসলাম বাবলা

ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমীর বইমেলা আমাদের নাগরিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বইমেলা মিলনমেলারও রূপ নিয়েছে। একই শহরে বসবাস করলেও সারা বছর অনেকের সঙ্গেই দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। বইমেলায় এলে তেমন অনেকেরই দেখা পাওয়া যায়।


প্রকাশনা সংস্থা পুঁথিঘর এবং মুক্তধারার কর্ণধার প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমীর চত্বরে প্রথম বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন। চট বিছিয়ে বই বিক্রির যে সূচনা তিনি করেছিলেন, কালক্রমে তা আজকের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মেলার পরিসর-পরিধি পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেলেও প্রকাশকদের চাহিদা পূরণ না হওয়ার নানা অভিযোগ তাঁরা করে থাকেন। অধিক স্টল বরাদ্দের কারণে স্টলের সাইজ ছোট হওয়ায় তাঁরা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। বইমেলায় স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থার পাশাপাশি সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ব্যাংক, এনজিওগুলোকে একাডেমীর ভেতরে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা বইমেলার মূল চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অপেক্ষাকৃত নবীন প্রকাশনা সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে একাডেমীর বাইরে রাস্তার দুই ধারে। সেখানে বারোয়ারি মেলার আমেজ লক্ষ করা যায়। দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি চত্বর পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারের নানা পসরার ছড়াছড়ি, মেলায় আগতদের বিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। টিএসসি বা দোয়েল চত্বর_যেদিক দিয়েই মেলায় আসতে হোক, এই পথটির মাত্রাতিরিক্ত ভিড় ঠেলে মেলায় ঢুকতে হয়। অন্যবারের তুলনায় এবারের মেলায় বই বিক্রি কম হচ্ছে বলে প্রকাশকরা জানিয়েছেন। মেলায় প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষের সমাগম হচ্ছে, তাতে প্রত্যেকে একটি বই কিনলেও মেলায় বই-সংকট দেখা দেবে। অথচ তা হচ্ছে না। আমাদের নিরানন্দ নাগরিক জীবনে অবসর বিনোদনে মেলাঙ্গন এক উপলক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবে বইমেলার চেতনা কতটুকু তাঁরা ধারণ করেন, সে বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ আছে। আমরা মুহূর্তে আবেগতাড়িত হয়ে যাই; কিন্তু এই বইমেলার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ভাবতে চাই না। প্রত্যাশা থাকবে, কিন্তু প্রাপ্তির হিসাবও কষতে হবে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার যে উন্মেষ ঘটেছিল, তারই চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর বইমেলার সূত্রপাত। বইমেলা উপলক্ষ মাত্র। মূল উদ্দেশ্য বইপড়ুয়া পাঠক সৃষ্টি। আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় পাঠক বাড়েনি। এ সত্যটি স্বীকার করতেই হবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠার তেমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বইমেলায় বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর তৎপরতা লক্ষণীয়। বইমেলা নিয়ে প্রতিটি টিভি চ্যানেল প্রতিদিন লাইভ অনুষ্ঠান করছে। তাদের ব্যস্ত ক্যামেরা যত্রতত্র ঘুরছে। লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের সাক্ষাৎকার-মন্তব্যসহ মেলায় আসা বইয়ের পরিচিতি তারা নিয়মিত সম্প্রচার করছে। এবারের বইমেলায় অনুপম প্রকাশনী থেকে আমার সম্পাদনায় শহীদ সাবের রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। এ জন্য আমাকে স্বল্প সময়ের জন্য কয়েকটি চ্যানেলে শহীদ সাবের সম্পর্কে বলতে হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, একজন উপস্থাপক ছাড়া বাকি কেউ আগে তাঁর নাম শুনেছেন বলেও মনে হয় না। একজন উপস্থাপক তো আগ বাড়িয়ে শহীদ সাবেরকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্বোধন পর্যন্ত করেছেন। অন্যদের বিষয় না-ই বা বললাম। যা হোক, আমরা চাই বইমেলার প্রচার ও প্রসার আরো বৃদ্ধি হোক_পাশাপাশি বৃদ্ধি হোক বইপড়ুয়া পাঠকও।
মযহারুল ইসলাম বাবলা

No comments

Powered by Blogger.