রঙ্গব্যঙ্গ-একটি মার্কিন হুকুমনামা by মোস্তফা কামাল

এক ভদ্রলোক একা ফুটপাত দিয়ে হাঁটছেন। তিনি মুচকি মুচকি হাসছেন আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। তাঁর হাসি দেখে একজন পথচারী এগিয়ে এসে বললেন, 'ভাই, কোনো সমস্যা?' ভদ্রলোকটি বিরক্তির সুরে বললেন, 'কেন?'


'না মানে, আপনি একা একা হাসছেন তো!'
'আর বলবেন না। দেশের অবস্থা দেখে হাসছি।'
পথচারী লোকটি তখন বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, 'দেশের অবস্থা দেখে আপনার হাসি পাচ্ছে!
হ্যাঁ ভাই, খুব হাসি পাচ্ছে।'
'কেন, হাসি পাওয়ার মতো কী হলো?'
'কেন, কিছু টের পাচ্ছেন না?'
'না তো!'
'আরে ভাই, আপনারা কি পত্রপত্রিকাও পড়েন না! আপনাদের অসচেতন মানুষের জন্যই এ সমস্যা, বুঝলেন!'
পথচারী বিব্রত। তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কিছুটা দম নিয়ে বললেন, 'সরি ভাই, আমি আপনার কথা ধরতে পারছি না। আমি সত্যিই সরি!'
'আরে ভাই, এই তো আবার একটা ফাউল করে ফেললেন। ভাষার মাসেও ইংরেজি শব্দ না বললে হয় না!'
'ওকে, দুঃখিত।'
'আবার সেই ইংরেজি শব্দ!'
'ঠিক আছে, দুঃখিত। এবার হলো? এবার বলেন দেশের কী হলো?'
'দেশের রাজনীতি ঠিক করতে মার্কিন মুল্লুক থেকে লোক এসেছেন। তাঁর নাম রবার্ট ব্লেক।'
'জানি তো!'
'আর কী জানেন?'
'উনি মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের প্রধান। যদিও আমরা তাঁকে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলি। কিন্তু বড় কেউ নন। বড় দেশের মানুষ ছোট দেশে এলে যা হয় আর কি! সবাই তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ভাবখানা এমন, যেন তিনিই আমাদের 'ভাগ্যনির্মাতা'। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলে যে কী হতো!'
'আরে, উনি এলে তো কিছু হবে! ওনার বাংলাদেশে আসার সময় আছে? উনি এখন ইরান, সিরিয়া নিয়ে ব্যস্ত। ওসব দেশে কিছু একটা ঘটাতে হবে না! আমাদের দেশে একজন ব্লেক এলেই তো হয়! উনি ইচ্ছা করলেই গাধা আর মহিষকে একঘাটে পানি খাওয়ানো যায়! হা হা হা!'
পথচারী হেসে দিয়ে বললেন, 'সত্যিই খুব ভালো বলেছেন।'
'তা তো বটেই, তা তো বটেই! এবার শুনুন আরো ভালো খবর! উনি দুই নেত্রীর (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করে কী বলেছেন জানেন?'
'না, জানি না। আজকে পত্রিকা পড়া হয়নি।'
'তা পড়বেন কেন? আচ্ছা শোনেন, উনি মানে ব্লেক এক ধরনের নির্দেশনা এবং হুমকি প্রদান করেছেন।'
পথচারী বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, 'কাকে!'
ভদ্রলোক খেপে গিয়ে বললেন, 'না, আপনার সঙ্গে কথা বলে কোনো মজা নেই। আপনি কোনো কথা ধরতে পারেন না।'
পথচারী লজ্জিত ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'দুঃখিত ভাই, দুঃখিত।'
'ব্লেক দুই নেত্রীকে বলেছেন, সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে রাজনীতি করুন। নইলে খবর আছে!'
'কী করবে ওরা!'
'আরে ভাই কথা শেষ করি! আপনি তো দেখছি একটা আজব লোক!'
লোকটা চুপ করে রইলেন। ভদ্রলোক আবার বলতে শুরু করলেন, 'উনি বলেছেন, রাজনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেললে কিন্তু রাজনীতি হাতছাড়া হয়ে যাবে! তখন কান্নাকাটি করেও আর রাজনীতিতে আসা যাবে না! ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, জেলের সেই দিনগুলোর কথা মনে নেই! এবার সেই অবস্থা হলে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যেমনিভাবে পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফকে পাঠানো হয়েছিল। এখনো পারভেজ মোশাররফ নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। আপনারা এসব কি ভুলে গেছেন!'
পথচারী বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, 'বলেন কী! এত কিছু বলেছে! আপনি এসব জানলেন কী করে!'
'আমি হলাম মিডিয়ার লোক। আমি সব জানি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, লিখতে পারি না বুঝলেন!'
'আর কী জানেন, ভাই? বলেন না শুনি!'
'উনি স্রেফ বলে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচন কিভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু এবং সব দলের অংশগ্রহণে উপযোগী হবে তার ফর্মুলা বের করতে হবে প্রধান দুই দলকে। অর্থাৎ দুই নেত্রীকে। এটা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলেই তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা হবে! এবার এলে দুই বছর নয়, টানা ১০ বছর!'
'বলেন কী! আবার তৃতীয় শক্তি!'
'অবাক হলেন বুঝি!'
'অবাক হওয়ার ব্যাপার না! রীতিমতো হুমকি দিয়ে গেলেন!'
'হুম! তা বলতে পারেন! মার্কিন হুকুম! দুই নেত্রী এবার যাবেন কোথায়! মার্কিন হুকুম বলে কথা! মানতেই হবে।'
'আমার মনে হয় না তাঁরা মানবেন। আপনি জানেন না, একজন আরেকজনের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ! তারা ফর্মুলা নিয়ে বৈঠক করবেন! কোনো দিনও না!'
'আরে ভাই, আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। মার্কিন হুকুম তো মানতেই হবে। না মানলে তার পরিণাম কী জানেন!'
'পরিণাম নিয়ে কি তাঁরা ভাবেন! ভাবলে তো তাঁরা ভালো কাজ করতেন!'
'এই তো কাজের কথায় এলেন! একজন বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসলেন। তারপর জনগণের কথা তাঁরা বেমালুম ভুলে গেলেন। বিরোধী দলও তাই। তারা সংসদে যায় না। জনগণের কথা বলে না। শুধু ক্ষমতা চায়। চেয়ার ছাড়া নাকি কিছুই করা যায় না। কিন্তু চেয়ারে বসলেই যে লাউ সেই কদু! হা হা হা!'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.