শহীদ ময়েজউদ্দিন by এনামুল হক
শহীদ ময়েজউদ্দিন বিশিষ্ট রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রথিতযশা আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজসেবক। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় কতিপয় চিহ্নিত সন্ত্রাসীর হাতে ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি শাহাদাতবরণ করেন।
শহীদ ময়েজউদ্দিন গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বড়হরা গ্রামে জন্মেছিলেন ১৯২৮ সালের ১৭ মার্চ। তার বাবার নাম মোঃ ছুরত আলী, মায়ের নাম শহরবানু।
১৯৪৮ সালে কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা, ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। ১৯৫৬ সালে সিএসএস (বর্তমানে বিসিএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও সরকারি চাকরি গ্রহণ করেননি। পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একজন খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায়ই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন দিয়েই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্যে আসেন এবং তার বিশ্বাসভাজন হন। এর আগে যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে, তখন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন আইনি লড়াই করতে এগিয়ে আসেন। 'ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' পরিচালনা করার দায়িত্ব নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত 'মুজিব তহবিলের' আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। একজন বিচক্ষণ আইনজীবী ও রাজনীতিক হিসেবে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শুধু পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধিকার আন্দোলন নয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মেঘালয় দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী নেতাদের সঙ্গে তিনি একযোগে কাজ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের পর বিভিন্ন পর্যায়ে দল ও সরকারকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য একজন সংসদ সদস্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কালীগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে যথাক্রমে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর দলের চরম সংকটময় দিনগুলোতে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার দুরূহ দায়িত্ব পালন করেন। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহূত সংসদ সদস্যদের সভায় সর্বপ্রথম তীব্র প্রতিবাদ করেন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। তার বলিষ্ঠ এবং প্রতিবাদী দুঃসাহসিক ভূমিকায় উপস্থিত সবাই সেদিন হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন উল্লেখযোগ্য সময় ধরে বৃহত্তর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে তিনি ঢাকা মহানগর এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন।
নেতৃস্থানীয় একজন রাজনীতিবিদের পাশাপাশি সমাজসেবক হিসেবেও তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রস (বর্তমানে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট) সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধাপে ধাপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রবল গণআন্দোলনে রূপ নেয়। মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন এ সময় অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে চলে যান। ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে ২২ দল আহূত হরতালের মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় থানার সামনেই তৎকালীন এরশাদ সরকারের লেলিয়ে দেওয়া কতিপয় সন্ত্রাসী তার ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। এই নির্মম হত্যাকণ্ডে পুরো জাতি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহীদ ময়েজউদ্দিনের আত্মদান ক্রমে ক্রমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছে দেয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলনে অবশেষে সামরিক শাসনের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের জয় হয়। শহীদ ময়েজউদ্দিন একজন দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সাধারণ জনকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ হিসেবে ইতিহাসে এবং মানুষের হৃদয়পটে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
enamulgpur@gmail.com
১৯৪৮ সালে কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা, ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। ১৯৫৬ সালে সিএসএস (বর্তমানে বিসিএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও সরকারি চাকরি গ্রহণ করেননি। পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একজন খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায়ই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন দিয়েই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্যে আসেন এবং তার বিশ্বাসভাজন হন। এর আগে যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে, তখন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন আইনি লড়াই করতে এগিয়ে আসেন। 'ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' পরিচালনা করার দায়িত্ব নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত 'মুজিব তহবিলের' আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। একজন বিচক্ষণ আইনজীবী ও রাজনীতিক হিসেবে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শুধু পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধিকার আন্দোলন নয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মেঘালয় দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী নেতাদের সঙ্গে তিনি একযোগে কাজ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের পর বিভিন্ন পর্যায়ে দল ও সরকারকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য একজন সংসদ সদস্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কালীগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে যথাক্রমে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর দলের চরম সংকটময় দিনগুলোতে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার দুরূহ দায়িত্ব পালন করেন। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহূত সংসদ সদস্যদের সভায় সর্বপ্রথম তীব্র প্রতিবাদ করেন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। তার বলিষ্ঠ এবং প্রতিবাদী দুঃসাহসিক ভূমিকায় উপস্থিত সবাই সেদিন হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন উল্লেখযোগ্য সময় ধরে বৃহত্তর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে তিনি ঢাকা মহানগর এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন।
নেতৃস্থানীয় একজন রাজনীতিবিদের পাশাপাশি সমাজসেবক হিসেবেও তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রস (বর্তমানে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট) সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধাপে ধাপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রবল গণআন্দোলনে রূপ নেয়। মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন এ সময় অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে চলে যান। ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে ২২ দল আহূত হরতালের মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় থানার সামনেই তৎকালীন এরশাদ সরকারের লেলিয়ে দেওয়া কতিপয় সন্ত্রাসী তার ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। এই নির্মম হত্যাকণ্ডে পুরো জাতি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহীদ ময়েজউদ্দিনের আত্মদান ক্রমে ক্রমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছে দেয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলনে অবশেষে সামরিক শাসনের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের জয় হয়। শহীদ ময়েজউদ্দিন একজন দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সাধারণ জনকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ হিসেবে ইতিহাসে এবং মানুষের হৃদয়পটে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
enamulgpur@gmail.com
No comments