রমেন কাকুর অটোভুলোগ্রাফি
আমিই রমেন কাকু। হায় হায়! নিজেকেই শেষ পর্যন্ত কাকু বলে ফেললাম (কাক্কু হলে তাও কোকিল হতে পারত)। আসলে চারপাশ থেকে কাকু ডাক শুনতে শুনতে... কী আর বলব। সেই কলেজ লাইফ থেকে। চেহারা? আয়না বেচারা তেমনটাই বলে। তা ছাড়া মাথায় শ্যাম্পু দেওয়ার স্পেস কমেছে আর বেড়েছে সাবান ব্যবহারের এরিয়া।
অবশ্য ডাকটা এখন ভালোই লাগে। কারণ, ২০ যে পার করে এসেছি ২০ বছর আগে।
ভুলোমনা রমেন কাকু (মানে মি. আমি), ভুল করা শুরু করেছি নাকি ভুল কী তা বোঝার অনেক আগেই। জন্মের সময় ডাক্তার বলেছিলেন, ‘বেবিটার মাথাটা অপেক্ষাকৃত মোটা, নরমাল ডেলিভারি সম্ভব নয়।’ কিন্তু আমি নাকি ভুল করে নরমালেই জন্মেছিলাম।
ছোট ওয়ান থেকে বড় ওয়ানে ওঠার সময় লিখিত নয়, ভাইভা হয়েছিল। স্যার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ঘোড়ার কয়টা শিং?’ আমি স্কুলে আসার সময় রাস্তার পাশে ঘোড়া বাঁধা দেখেছিলাম। তাই কনফিডেন্টের সঙ্গে বলেছিলাম। ‘দুটি।’ আমার রোল নম্বর ১-এর বদলে হলো ২১। ফেরার পথে ঘোড়ার কাছে গিয়ে দেখি, ও দুটো নড়ছে। শিং তো নড়ে না! ওটা কান।
আমার মাথাটা আইনস্টাইনের মতো না হলেও বেশ বড়। তাই গুরুজনেরা বলতেন, অঙ্ক পারব ভালো। কথাটা সত্যি। স্কুল-কলেজে সেকেন্ড হতে হয়নি কখনো। ক্লাস সিক্সে অঙ্কে অবশ্য ১০০ পাওয়ার কথা থাকলেও আমি আসলে কোনো নম্বরই পাইনি। শূন্যও না। আমি যে উত্তরপত্রে নিজের রোল নম্বরটাই লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম।
কলেজে কোনো ভুলের ঘটনা ঘটেছিল কি না তা ভুলে গেছি।
ভার্সিটিতে এসে মনে হলো প্রেম করব। প্রেম নাকি শরীর ও মন ভালো রাখে। প্রথম প্রেম এ রকম—পাত্রী ক্লাস টেনে পড়ুয়া আমার ছাত্রী। খুব ভালো লাগত তাই বলেছিলাম, ‘ভালোবাসি।’ সেও একই কথা বলেছিল। ভালোই তো হলো। ভালোবাসা ও অর্থোপার্জন। রথ দেখা আর কলা বেচার কথা বলে আমার প্রথম প্রেমটাকে ছোট করছি না। একদিন বিয়ের ইঙ্গিত দিলে সে আকাশ থেকে না হলেও অন্তত গাছ থেকে পড়ল। আমি বললাম, ‘তুমি আমায় ভালোবাস না?’ সে বলল, ‘অবশ্যই, আমি আপনাকে বাবার মতো ভালোবাসি।’ ভুল দিয়ে শেষ হলো প্রথম প্রেম। ভাবলাম, এবার ভার্সিটিতেই প্রেম করব। জুটেও গেল। সে দারুণ প্রেমালাপ করত আমার সঙ্গে। ছয় মাস পরে জানলাম, ওর প্রেম করতে ভীষণ ভালো লাগে। ওর প্রেমিক স্কলারশিপে দেশের বাইরে ছিল, তাই আমাকে ডামি (দামি নয়) বানিয়েছিল। দ্বিতীয় প্রেমও কেমন জানি ভুলের মধ্যে পড়ে গেল। তৃতীয় প্রেমটা ভার্সিটিতে নয়, অফিসে। পড়া শেষে চাকরি পেলাম। আমার নিচের পোস্টের এক রমণীর সঙ্গে সখ্য হলো। দারুণ চলছিল সব। প্রায় দুজনে ঘুরতাম। কখনো রিকশায়, কখনো পদব্রজে। একদিন রিকশায় ঘোরার সময় ও বলল, ‘আপনি কোন দিক দিয়ে যাবেন? আমি একটু স্কুল হয়ে যাব।’ কেন? ‘আজকে কাজের মেয়েটা আমার ছেলেটাকে নিতে আসবে না তো, তাই?’ শেষ হলো তৃতীয় প্রেম ভুলের হাত ধরে।
ভাবলাম, আর প্রেম নয়। ডাইরেক্ট বিয়ে। দ্বারস্থ হলাম ঘটক বাবুর। দীর্ঘকেশী কোনো এক বাঙালি সুন্দরী ললনা আমার চাই। ঘটক বাবু যাকে আমার সম্মুখে উপস্থিত করলেন, তিনি বড়ই রূপসী-কেশবতী। মনে মনে ভাবলাম, কেন ওই প্রেম-ট্রেম। যেকোনো একটি প্রেম টিকলে তো আর এমন রমণী বউ হিসেবে পেতুম না। কিন্তু এখানেও ভুলের অস্তিত্ব টের পেলাম। আমার বউটা রাতে ঘুমানোর আগে দীর্ঘ কেশরাশি খুলে রাখত যত্ন করে।
এখন তো পুরোপুরি সংসার। যতই আমি ভুলোমনা হই, ভুল করা একদম চলবে না। শুধু বাজারের ফর্দই নয়, দিনে-রাতে গিন্নির যেকোনো প্রয়োজন আমি স্বযত্নে নোটবুকে টুকে রাখি। বিপত্তি ঘটে যখন খোদ নোটবুকটাই কোথায় রেখেছি, তা ভুলে যাই। এগুলোর রিঅ্যাকশন তবু হজম করা যায়। কিন্তু প্রিয়তমা গিন্নি ও একমাত্র আদরের শ্যালিকার জন্মদিন ভুলে যাওয়ার রিঅ্যাকশন ভুলতে পারি না। যা একবার নয়, দুবার নয়, তিন-তিন বার ঘটেছে।
গত পৌষে পাশের পাড়ায় যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম। ভালো লাগছিল না যাত্রাপালাটি। বউকে বললাম, তুমি দেখলে দেখো, আমি ঘণ্টা খানেক পরে এসে তোমায় নিয়ে যাব। আমি বউটাকে আনতে ভুলে গিয়ে বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে অবশ্য বউকে বাড়িতেই আবিষ্কার করেছিলাম।
কোনো ভুল করলে বউ ঝগড়া করে, শাসন করে। বুড়ো হতে চলল তবু আক্কেল হলো না বলে কত জ্ঞান দেয়, যা শুনতে আমার ভালোই লাগে। আর উনি বেশ আমেজেই থাকেন তখন। গত দুই দিন বউটার না মন খুব খারাপ। ভেবে দেখলাম, এই দুই দিন ভুল করেও তেমন কোনো ভুল করা হয়নি আমার। বুঝলুম, কিছু ভুল হয়তো সংসারে ভালোবাসাকে আরও সমৃদ্ধ করে। বশীর আহমেদেই শেষ করি, ‘ভুল যদি হয় মধুর এমন হোক না ভুল...’।
দেবনাথ বিশ্বাস
মাগুরা হাট, অভয়নগর, যশোর।
ভুলোমনা রমেন কাকু (মানে মি. আমি), ভুল করা শুরু করেছি নাকি ভুল কী তা বোঝার অনেক আগেই। জন্মের সময় ডাক্তার বলেছিলেন, ‘বেবিটার মাথাটা অপেক্ষাকৃত মোটা, নরমাল ডেলিভারি সম্ভব নয়।’ কিন্তু আমি নাকি ভুল করে নরমালেই জন্মেছিলাম।
ছোট ওয়ান থেকে বড় ওয়ানে ওঠার সময় লিখিত নয়, ভাইভা হয়েছিল। স্যার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ঘোড়ার কয়টা শিং?’ আমি স্কুলে আসার সময় রাস্তার পাশে ঘোড়া বাঁধা দেখেছিলাম। তাই কনফিডেন্টের সঙ্গে বলেছিলাম। ‘দুটি।’ আমার রোল নম্বর ১-এর বদলে হলো ২১। ফেরার পথে ঘোড়ার কাছে গিয়ে দেখি, ও দুটো নড়ছে। শিং তো নড়ে না! ওটা কান।
আমার মাথাটা আইনস্টাইনের মতো না হলেও বেশ বড়। তাই গুরুজনেরা বলতেন, অঙ্ক পারব ভালো। কথাটা সত্যি। স্কুল-কলেজে সেকেন্ড হতে হয়নি কখনো। ক্লাস সিক্সে অঙ্কে অবশ্য ১০০ পাওয়ার কথা থাকলেও আমি আসলে কোনো নম্বরই পাইনি। শূন্যও না। আমি যে উত্তরপত্রে নিজের রোল নম্বরটাই লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম।
কলেজে কোনো ভুলের ঘটনা ঘটেছিল কি না তা ভুলে গেছি।
ভার্সিটিতে এসে মনে হলো প্রেম করব। প্রেম নাকি শরীর ও মন ভালো রাখে। প্রথম প্রেম এ রকম—পাত্রী ক্লাস টেনে পড়ুয়া আমার ছাত্রী। খুব ভালো লাগত তাই বলেছিলাম, ‘ভালোবাসি।’ সেও একই কথা বলেছিল। ভালোই তো হলো। ভালোবাসা ও অর্থোপার্জন। রথ দেখা আর কলা বেচার কথা বলে আমার প্রথম প্রেমটাকে ছোট করছি না। একদিন বিয়ের ইঙ্গিত দিলে সে আকাশ থেকে না হলেও অন্তত গাছ থেকে পড়ল। আমি বললাম, ‘তুমি আমায় ভালোবাস না?’ সে বলল, ‘অবশ্যই, আমি আপনাকে বাবার মতো ভালোবাসি।’ ভুল দিয়ে শেষ হলো প্রথম প্রেম। ভাবলাম, এবার ভার্সিটিতেই প্রেম করব। জুটেও গেল। সে দারুণ প্রেমালাপ করত আমার সঙ্গে। ছয় মাস পরে জানলাম, ওর প্রেম করতে ভীষণ ভালো লাগে। ওর প্রেমিক স্কলারশিপে দেশের বাইরে ছিল, তাই আমাকে ডামি (দামি নয়) বানিয়েছিল। দ্বিতীয় প্রেমও কেমন জানি ভুলের মধ্যে পড়ে গেল। তৃতীয় প্রেমটা ভার্সিটিতে নয়, অফিসে। পড়া শেষে চাকরি পেলাম। আমার নিচের পোস্টের এক রমণীর সঙ্গে সখ্য হলো। দারুণ চলছিল সব। প্রায় দুজনে ঘুরতাম। কখনো রিকশায়, কখনো পদব্রজে। একদিন রিকশায় ঘোরার সময় ও বলল, ‘আপনি কোন দিক দিয়ে যাবেন? আমি একটু স্কুল হয়ে যাব।’ কেন? ‘আজকে কাজের মেয়েটা আমার ছেলেটাকে নিতে আসবে না তো, তাই?’ শেষ হলো তৃতীয় প্রেম ভুলের হাত ধরে।
ভাবলাম, আর প্রেম নয়। ডাইরেক্ট বিয়ে। দ্বারস্থ হলাম ঘটক বাবুর। দীর্ঘকেশী কোনো এক বাঙালি সুন্দরী ললনা আমার চাই। ঘটক বাবু যাকে আমার সম্মুখে উপস্থিত করলেন, তিনি বড়ই রূপসী-কেশবতী। মনে মনে ভাবলাম, কেন ওই প্রেম-ট্রেম। যেকোনো একটি প্রেম টিকলে তো আর এমন রমণী বউ হিসেবে পেতুম না। কিন্তু এখানেও ভুলের অস্তিত্ব টের পেলাম। আমার বউটা রাতে ঘুমানোর আগে দীর্ঘ কেশরাশি খুলে রাখত যত্ন করে।
এখন তো পুরোপুরি সংসার। যতই আমি ভুলোমনা হই, ভুল করা একদম চলবে না। শুধু বাজারের ফর্দই নয়, দিনে-রাতে গিন্নির যেকোনো প্রয়োজন আমি স্বযত্নে নোটবুকে টুকে রাখি। বিপত্তি ঘটে যখন খোদ নোটবুকটাই কোথায় রেখেছি, তা ভুলে যাই। এগুলোর রিঅ্যাকশন তবু হজম করা যায়। কিন্তু প্রিয়তমা গিন্নি ও একমাত্র আদরের শ্যালিকার জন্মদিন ভুলে যাওয়ার রিঅ্যাকশন ভুলতে পারি না। যা একবার নয়, দুবার নয়, তিন-তিন বার ঘটেছে।
গত পৌষে পাশের পাড়ায় যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম। ভালো লাগছিল না যাত্রাপালাটি। বউকে বললাম, তুমি দেখলে দেখো, আমি ঘণ্টা খানেক পরে এসে তোমায় নিয়ে যাব। আমি বউটাকে আনতে ভুলে গিয়ে বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে অবশ্য বউকে বাড়িতেই আবিষ্কার করেছিলাম।
কোনো ভুল করলে বউ ঝগড়া করে, শাসন করে। বুড়ো হতে চলল তবু আক্কেল হলো না বলে কত জ্ঞান দেয়, যা শুনতে আমার ভালোই লাগে। আর উনি বেশ আমেজেই থাকেন তখন। গত দুই দিন বউটার না মন খুব খারাপ। ভেবে দেখলাম, এই দুই দিন ভুল করেও তেমন কোনো ভুল করা হয়নি আমার। বুঝলুম, কিছু ভুল হয়তো সংসারে ভালোবাসাকে আরও সমৃদ্ধ করে। বশীর আহমেদেই শেষ করি, ‘ভুল যদি হয় মধুর এমন হোক না ভুল...’।
দেবনাথ বিশ্বাস
মাগুরা হাট, অভয়নগর, যশোর।
No comments