মত ও মন্তব্য-বিদায় মকবুল ফিদা হুসেন by হারুন হাবীব
আমি ভারতের দুটি প্রধান ইংরেজি ও আঞ্চলিক ভাষার দৈনিক এবং ম্যাগাজিনে প্রায় নিয়মিত লিখি-দুই যুগের বেশি সময় ধরে। এসব লেখালেখিতে, যা মূলতই সাংবাদিকতা পেশার কাজ, নির্দ্বিধায় আমি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করি-বিশেষ করে আমার মতামত দেওয়ার সুযোগ যখন থাকে।
বলতে কী, যখনই আমার কোনো প্রবন্ধ বা নিবন্ধ ছাপা হয় তখনই ভারত কিংবা সে দেশের সীমান্তের ওপারের নানা জনপদ, নানা শ্রেণীপেশার বিদগ্ধ মানুষের অজস্র প্রতিক্রিয়া আসে। কেউ আমার মত ও মন্তব্যের বিরুদ্ধে তাঁদের বক্তব্য দেন, বেশির ভাগই আমার মতকে অকপট সমর্থন দিতেও কার্পণ্য করেন না। বলাবাহুল্য, লেখালেখির মানুষ হিসেবে এসব প্রতিক্রিয়া আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
অতিসমপ্রতি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যাপন নিয়ে আমি যে প্রবন্ধটি প্রভাবশালী 'দ্য হিন্দু' পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় লিখেছিলাম_তা নিয়েও বিস্তর চিঠিপত্র পেয়েছি, মূলত ই-মেইলে। এদেরই একজন, বাণীপ্রসন্ন, সিমলায় বসবাস করেন, যিনি আমার জানামতে একজন উঁচুমানের চিত্রশিল্পী, আমাকে একটি ছোট্ট ই-মেইল পাঠিয়েছেন। ই-মেইলটির ভাষা এ রকম : India's second Bahadurshah Zaffar breathed his last in exile exposing a big hole in our secularism and concern for art and artists....long live M.F. Hassan .
বাণীপ্রসন্নের প্রতিক্রিয়ার উত্তর আমি পাঠিয়েছি এবং মনে করি ওঁর মন্তব্য ভেবে দেখার বিষয়। পঁচানব্বই বছরের একজন মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন-এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মকবুল ফিদা হুসেনের বিদায়, আমার বিশ্বাস, তাঁর মৃত্যুর চেয়েও বড় শোকের কারণ হয়ে থাকবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক, আধুনিক চিন্তাচেতনা ও বিজ্ঞানের পীঠস্থান ভারতে। কাজেই শিল্পী বাণীপ্রসন্নের উদ্বেগের সঙ্গে অনেকটাই একমত হওয়ার সুযোগ আছে।
শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী, আপসহীন মানবতাবাদী মকবুল ফিদা হুসেন। তাঁর জীবনে বিস্তর আলোচিত-সমালোচিতও হয়েছেন তিনি। তাঁর জন্মভূমি ভারতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলে হয়তো আমাদের মতো মানুষের বা ভারতের শিল্পী ও স্বাধীনতাকামী সমাজের স্বাভাবিক শোক ছাড়া তেমন কিছু বলার থাকত না। কিন্তু প্রবাদপ্রতিম হুসেন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন লন্ডনের রয়েল ব্রোম্পটন হাসপাতালে। প্রায় দেড় মাস ধরে নানা শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে তাঁর দিন কাটছিল। ভারতের চিকিৎসাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত। এর পরও হুসেন চিকিৎসা করাতে ভারতে আসেননি। তাঁকে যেতে হয়েছে লন্ডনে, যেখান থেকে আর জন্মভূমিতে তাঁর ফেরা হলো না-ট্র্যাজেডিটা হয়তো সেখানেই বেশি।
শিল্পীর মৃত্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর মৃত্যুতে এক অপূরণীয় জাতীয় ক্ষতি হয়েছে ভারতবর্ষের। রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল আবেগময় শোকবাণী দিয়েছেন এই মহাবরেণ্য শিল্পীর মৃত্যুতে। ভারতের প্রতিটি স্বাধীন পত্রিকা, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম, বিশেষত যাঁরা শিল্পীর স্বাধীনতা ও ভারতের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচেতনা লালন করেন, শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তাঁরা শোক ও ক্রোধে নতুন করে প্রশ্ন রাখতে শুরু করেছেন-কেন ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ হুসেনের মতো বিশ্বখ্যাত শিল্পীকে ধরে রাখতে পারেনি। আত্মসমালোচনা শুরু হয়েছে দেশটির অজস্র মানবাধিকার কর্মী, বিপুল মুক্তমনা মানুষ ও লেখক-শিল্পী থেকে সব মহলে। সমালোচনাও কম হচ্ছে না ।
১৯১৫ সালে হুসেন মহারাষ্ট্রে জন্ম নেন। ১৯৪০ সালের শেষের দিকে শিল্পী হিসেবে ভারত ও বহির্বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন মকবুল ফিদা হুসেনকে 'ভারতের পিকাসো' নামে অভিহিত করে। খুবই সাধারণ একটি পরিবার থেকে ওঠে এসে নিজের অদম্য শিল্পপ্রতিভা ও চেষ্টায় শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুবিশাল ভারত, এমনকি বিশ্ব চিত্রশিল্পে অন্যতম প্রধান শিল্পীর আসন দখল করে নেন মকবুল ফিদা হুসেন। যে ভারত হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পারসিসহ নানা ধর্মাবলম্বীর দেশ-সে ভারতেরই অকৃত্রিম নাগরিক হুসেন। কিন্তু যে মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন, যে ভারতের পানি-মাটি-বায়ুতে তিনি বেড়ে উঠেছেন, যে মাটিতে তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন, যে ভারতকে তিনি ভালোবাসতেন-প্রিয় সে স্বদেশে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি শিল্পী। ২০০৬ সাল থেকেই দেশের বাইরে স্বেচ্ছানির্বাসন নিতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর কিছু চিত্রকর্মে হিন্দু দেব-দেবীর নগ্নমূর্তি ফুটে ওঠার অভিযোগ এনে ফুঁসে উঠেছে হিন্দু উগ্রবাদীরা। অসংখ্য মামলা করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। দেবীদের নিয়ে তাঁর আঁকা ছবি বিক্ষোভ ও তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, অনেকে এতে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেয়েছে। উগ্র হিন্দুরা তাঁর প্রাণনাশের হুমকি, এমনকি তাঁর চিত্রকর্ম ধ্বংস করলেও তিনি ভারত ছাড়ার চিন্তা করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন হুসেন।
আমার জানামতে, হুসেন যখন ভারত ত্যাগ করেন তখনো প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল ভারতীয় বিবেক, মুক্তমনা মানুষ। সরকার তাঁকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে চাইলেও তিনি তাতে আস্থা রাখতে পারেননি। একপর্যায়ে নিরাপত্তার বিষয়টি এতই প্রকট হয়ে ওঠে যে হুসেন দেশ ছেড়ে দুবাই গিয়ে আশ্রয় নেন। দুবাই ও দোহায় পালাক্রমে বসবাস করতে থাকেন। কিছুদিন পর কাতার সরকার শিল্পীকে নাগরিকত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। নিজ দেশের নাগরিকত্ব বিসর্জন দিয়ে হুসেনকে অন্য দেশের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে হয় ২০১০ সালে।
বিচিত্র, বর্ণাঢ্য জীবন মকবুল ফিদা হুসেনের। সমতলভূমি থেকে উঠেছেন হিমালয়ের শীর্ষ শৃঙ্গে। বেশ কিছু চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র 'থ্রু দ্য আই অব এ পেইন্টার' ১৯৬৭ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে 'গোল্ডেন বিয়ার' লাভ করে। সম্ভবত হুসেনের প্রতি আমি বেশি আকৃষ্ট হই যখন তিনি বলিউডের অনিন্দ্য সুন্দরী কিছু অভিনেত্রীর প্রেমে পড়েন, যখন তাঁর বয়স আশিরও বেশি! এসব রূপসী নায়িকাকে হুসেন দেবী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মাধুরী দীক্ষিতকে নায়িকা করে তিনি তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'গজগামিনী' নির্মাণ করেন, চিত্রনায়িকা টাবুকে নিয়ে 'মীনাক্ষী : এ টেল অব থ্রি সিটিজ' নামে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র।
মহাভারতের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করে খ্যাত হন তিনি। তাঁর মতো এত দামে আর কোনো চিত্রকর্ম বিক্রি হয়েছে কি না জানা নেই। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ উপাধিতে অভিষিক্ত করে।
কয়েক শতাব্দী আগে গ্যালিলিওকেও তাঁরই মতো প্রবল প্রতিরোধের মাথায় জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছিল। ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাঁর মতো একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীকেও দেশে থাকতে দেয়নি। মকবুল ফিদা হুসেন যখন দেশ ছাড়েন, তখন ২০০৬ সালে, তিনি বলেছিলেন, 'ভারতের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমি বিশ্বের নাগরিক। ৬০-৭০ বছর ধরে আমি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো ভারতীয় সভ্যতার প্রতি অনুগত থেকেছি। কারণ আমি ভারতকে ভালোবাসি'। দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত হুসেন দেশে থাকতে পারেননি।
শিল্পের কি কোনো জাত-ধর্ম বা সীমান্ত আছে? নেই। মকবুল ফিদা হুসেনেরও ছিল না। শিল্পী স্বাধীন, এ স্বাধীনতায় তিনি ভারতীয় ইতিহাস, ধর্ম ও ঐতিহ্যকে বাঙ্ময় করে তুলেছিলেন, এনে দিয়েছিলেন নতুন সৃষ্টি, যা ভারতকে নতুনভাবে বিশ্বনন্দিত করেছে। কিন্তু এ স্বাধীনতা তাঁকে এমনই বিতর্কিত করে তোলে যে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় পাসপোর্ট জমা দিয়ে তাঁকে কাতারের নাগরিকত্ব নিতে হয়! এরপর দোহা, দুবাই ও লন্ডনে বসে হুসেন সুপ্রাচীন আরবসভ্যতার চিত্রণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
গত বছরের মার্চ মাসে ভারতের শীর্ষ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ নাকচ করে দেন। কিন্তু এর পরও তিনি স্বদেশে ফিরতে পারেন না। এমনকি প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে মামলাসহ প্রকাশ্য দণ্ডের ঘোষণা আসে হুসেনের বিরুদ্ধে। এক হিসাবে দেখা যায়, হুসেনের বিরুদ্ধে ৯০০ মামলা করা হয়, এমনকি তাঁকে হত্যার জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলারের পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়! কিন্তু হুসেন ছিলেন নির্বিকার। তিনি বলেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি কোনো ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করতে চাননি কিংবা কোনো দেবীর শরীর ঘাঁটতে চাননি, চেয়েছেন কেবলই সৌন্দর্যের উপাসনা করতে। শিল্পীর মতে, উন্মুক্ততা বা পরিপূর্ণ প্রকাশ পবিত্রতার আরাধনা-যা একজন শিল্পীই কেবল করতে পারেন।
উলঙ্গতাই কি সৌন্দর্য নাকি অশ্লীলতা? ঢেকে রাখা তাহলে কী? এ প্রশ্নের পক্ষে-বিপক্ষে মত যতই থাক সব উলঙ্গতা সমর্থনযোগ্য হওয়ার সুযোগ রাখে না। এর পরও বলা যায়, উলঙ্গ মানেই অপমানিত করা নয়। যদি তাই হতো, তাহলে অজন্তা-ইলোরা, খাজোরাহো কিংবা কোনারাকের মন্দিরগুলোতে বিস্ময়কর নন্দিত বিশ্ব স্থাপত্যগুলো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়নি কেন?
অবশ্য এ বিতর্ক একেবারে থেমে গেছে বা কখনো যাবে ভাবার কারণ নেই। বিদেশের মাটিতে গিয়েও হুসেন বলেছেন, 'আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমি একজন ভারতীয় শিল্পী, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বিশ্বাস আমার থাকবে।' হুসেনের এ উচ্চারণ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারতকে নতুন আত্মজিজ্ঞাসায় দাঁড় করাবে বলে আমার ধারণা। একজন শিল্পী, লেখক, সৃজনশীল মানুষ যা বলবেন, যা করবেন-সেটিই সবাই মেনে নেবে না। দ্বিমত পোষণ করার অধিকার সবারই থাকা উচিত। কিন্তু তাঁর বক্তব্য পছন্দ হলো না বলে তাঁকে হত্যা করতে হবে, আক্রান্ত করতে হবে, দেশান্তরিত করতে হবে-এ কোন ধরনের বর্বরতা? এ বিকার সামাজিক ও মানবিক প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশের প্রবল বিতর্কিত লেখক তসলিমা নাসরিনের বহু মত ও বক্তব্যের সঙ্গে আমি শক্ত দ্বিমত পোষণ করি। এ নিয়ে দেশে ও বিদেশে লিখেছিও আমি। কিন্তু জন্মগতভাবে এ দেশের একজন নাগরিক হয়ে তসলিমা কেবল মত প্রকাশের কারণে নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে পারবেন না-এ যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রশক্তি যদি ধর্মীয় কিংবা উগ্রপন্থীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে, বুঝে কিংবা না-বুঝে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে সে সমাজের দুর্ভাগ্য বাড়ে। রাষ্ট্র ও সমাজকে ব্যক্তির বিশ্বাস প্রচার করার অধিকার না দিলে সে সমাজ গণতান্ত্রিক থাকে না, আবদ্ধ হয়, সভ্য থাকে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
e-mail: hh1971@gmail.com
অতিসমপ্রতি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যাপন নিয়ে আমি যে প্রবন্ধটি প্রভাবশালী 'দ্য হিন্দু' পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় লিখেছিলাম_তা নিয়েও বিস্তর চিঠিপত্র পেয়েছি, মূলত ই-মেইলে। এদেরই একজন, বাণীপ্রসন্ন, সিমলায় বসবাস করেন, যিনি আমার জানামতে একজন উঁচুমানের চিত্রশিল্পী, আমাকে একটি ছোট্ট ই-মেইল পাঠিয়েছেন। ই-মেইলটির ভাষা এ রকম : India's second Bahadurshah Zaffar breathed his last in exile exposing a big hole in our secularism and concern for art and artists....long live M.F. Hassan .
বাণীপ্রসন্নের প্রতিক্রিয়ার উত্তর আমি পাঠিয়েছি এবং মনে করি ওঁর মন্তব্য ভেবে দেখার বিষয়। পঁচানব্বই বছরের একজন মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন-এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মকবুল ফিদা হুসেনের বিদায়, আমার বিশ্বাস, তাঁর মৃত্যুর চেয়েও বড় শোকের কারণ হয়ে থাকবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক, আধুনিক চিন্তাচেতনা ও বিজ্ঞানের পীঠস্থান ভারতে। কাজেই শিল্পী বাণীপ্রসন্নের উদ্বেগের সঙ্গে অনেকটাই একমত হওয়ার সুযোগ আছে।
শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী, আপসহীন মানবতাবাদী মকবুল ফিদা হুসেন। তাঁর জীবনে বিস্তর আলোচিত-সমালোচিতও হয়েছেন তিনি। তাঁর জন্মভূমি ভারতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলে হয়তো আমাদের মতো মানুষের বা ভারতের শিল্পী ও স্বাধীনতাকামী সমাজের স্বাভাবিক শোক ছাড়া তেমন কিছু বলার থাকত না। কিন্তু প্রবাদপ্রতিম হুসেন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন লন্ডনের রয়েল ব্রোম্পটন হাসপাতালে। প্রায় দেড় মাস ধরে নানা শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে তাঁর দিন কাটছিল। ভারতের চিকিৎসাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত। এর পরও হুসেন চিকিৎসা করাতে ভারতে আসেননি। তাঁকে যেতে হয়েছে লন্ডনে, যেখান থেকে আর জন্মভূমিতে তাঁর ফেরা হলো না-ট্র্যাজেডিটা হয়তো সেখানেই বেশি।
শিল্পীর মৃত্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর মৃত্যুতে এক অপূরণীয় জাতীয় ক্ষতি হয়েছে ভারতবর্ষের। রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল আবেগময় শোকবাণী দিয়েছেন এই মহাবরেণ্য শিল্পীর মৃত্যুতে। ভারতের প্রতিটি স্বাধীন পত্রিকা, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম, বিশেষত যাঁরা শিল্পীর স্বাধীনতা ও ভারতের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচেতনা লালন করেন, শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তাঁরা শোক ও ক্রোধে নতুন করে প্রশ্ন রাখতে শুরু করেছেন-কেন ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ হুসেনের মতো বিশ্বখ্যাত শিল্পীকে ধরে রাখতে পারেনি। আত্মসমালোচনা শুরু হয়েছে দেশটির অজস্র মানবাধিকার কর্মী, বিপুল মুক্তমনা মানুষ ও লেখক-শিল্পী থেকে সব মহলে। সমালোচনাও কম হচ্ছে না ।
১৯১৫ সালে হুসেন মহারাষ্ট্রে জন্ম নেন। ১৯৪০ সালের শেষের দিকে শিল্পী হিসেবে ভারত ও বহির্বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন মকবুল ফিদা হুসেনকে 'ভারতের পিকাসো' নামে অভিহিত করে। খুবই সাধারণ একটি পরিবার থেকে ওঠে এসে নিজের অদম্য শিল্পপ্রতিভা ও চেষ্টায় শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুবিশাল ভারত, এমনকি বিশ্ব চিত্রশিল্পে অন্যতম প্রধান শিল্পীর আসন দখল করে নেন মকবুল ফিদা হুসেন। যে ভারত হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পারসিসহ নানা ধর্মাবলম্বীর দেশ-সে ভারতেরই অকৃত্রিম নাগরিক হুসেন। কিন্তু যে মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন, যে ভারতের পানি-মাটি-বায়ুতে তিনি বেড়ে উঠেছেন, যে মাটিতে তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন, যে ভারতকে তিনি ভালোবাসতেন-প্রিয় সে স্বদেশে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি শিল্পী। ২০০৬ সাল থেকেই দেশের বাইরে স্বেচ্ছানির্বাসন নিতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর কিছু চিত্রকর্মে হিন্দু দেব-দেবীর নগ্নমূর্তি ফুটে ওঠার অভিযোগ এনে ফুঁসে উঠেছে হিন্দু উগ্রবাদীরা। অসংখ্য মামলা করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। দেবীদের নিয়ে তাঁর আঁকা ছবি বিক্ষোভ ও তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, অনেকে এতে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেয়েছে। উগ্র হিন্দুরা তাঁর প্রাণনাশের হুমকি, এমনকি তাঁর চিত্রকর্ম ধ্বংস করলেও তিনি ভারত ছাড়ার চিন্তা করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন হুসেন।
আমার জানামতে, হুসেন যখন ভারত ত্যাগ করেন তখনো প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল ভারতীয় বিবেক, মুক্তমনা মানুষ। সরকার তাঁকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে চাইলেও তিনি তাতে আস্থা রাখতে পারেননি। একপর্যায়ে নিরাপত্তার বিষয়টি এতই প্রকট হয়ে ওঠে যে হুসেন দেশ ছেড়ে দুবাই গিয়ে আশ্রয় নেন। দুবাই ও দোহায় পালাক্রমে বসবাস করতে থাকেন। কিছুদিন পর কাতার সরকার শিল্পীকে নাগরিকত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। নিজ দেশের নাগরিকত্ব বিসর্জন দিয়ে হুসেনকে অন্য দেশের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে হয় ২০১০ সালে।
বিচিত্র, বর্ণাঢ্য জীবন মকবুল ফিদা হুসেনের। সমতলভূমি থেকে উঠেছেন হিমালয়ের শীর্ষ শৃঙ্গে। বেশ কিছু চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র 'থ্রু দ্য আই অব এ পেইন্টার' ১৯৬৭ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে 'গোল্ডেন বিয়ার' লাভ করে। সম্ভবত হুসেনের প্রতি আমি বেশি আকৃষ্ট হই যখন তিনি বলিউডের অনিন্দ্য সুন্দরী কিছু অভিনেত্রীর প্রেমে পড়েন, যখন তাঁর বয়স আশিরও বেশি! এসব রূপসী নায়িকাকে হুসেন দেবী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মাধুরী দীক্ষিতকে নায়িকা করে তিনি তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'গজগামিনী' নির্মাণ করেন, চিত্রনায়িকা টাবুকে নিয়ে 'মীনাক্ষী : এ টেল অব থ্রি সিটিজ' নামে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র।
মহাভারতের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করে খ্যাত হন তিনি। তাঁর মতো এত দামে আর কোনো চিত্রকর্ম বিক্রি হয়েছে কি না জানা নেই। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ উপাধিতে অভিষিক্ত করে।
কয়েক শতাব্দী আগে গ্যালিলিওকেও তাঁরই মতো প্রবল প্রতিরোধের মাথায় জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছিল। ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাঁর মতো একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীকেও দেশে থাকতে দেয়নি। মকবুল ফিদা হুসেন যখন দেশ ছাড়েন, তখন ২০০৬ সালে, তিনি বলেছিলেন, 'ভারতের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমি বিশ্বের নাগরিক। ৬০-৭০ বছর ধরে আমি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো ভারতীয় সভ্যতার প্রতি অনুগত থেকেছি। কারণ আমি ভারতকে ভালোবাসি'। দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত হুসেন দেশে থাকতে পারেননি।
শিল্পের কি কোনো জাত-ধর্ম বা সীমান্ত আছে? নেই। মকবুল ফিদা হুসেনেরও ছিল না। শিল্পী স্বাধীন, এ স্বাধীনতায় তিনি ভারতীয় ইতিহাস, ধর্ম ও ঐতিহ্যকে বাঙ্ময় করে তুলেছিলেন, এনে দিয়েছিলেন নতুন সৃষ্টি, যা ভারতকে নতুনভাবে বিশ্বনন্দিত করেছে। কিন্তু এ স্বাধীনতা তাঁকে এমনই বিতর্কিত করে তোলে যে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় পাসপোর্ট জমা দিয়ে তাঁকে কাতারের নাগরিকত্ব নিতে হয়! এরপর দোহা, দুবাই ও লন্ডনে বসে হুসেন সুপ্রাচীন আরবসভ্যতার চিত্রণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
গত বছরের মার্চ মাসে ভারতের শীর্ষ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ নাকচ করে দেন। কিন্তু এর পরও তিনি স্বদেশে ফিরতে পারেন না। এমনকি প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে মামলাসহ প্রকাশ্য দণ্ডের ঘোষণা আসে হুসেনের বিরুদ্ধে। এক হিসাবে দেখা যায়, হুসেনের বিরুদ্ধে ৯০০ মামলা করা হয়, এমনকি তাঁকে হত্যার জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলারের পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়! কিন্তু হুসেন ছিলেন নির্বিকার। তিনি বলেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি কোনো ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করতে চাননি কিংবা কোনো দেবীর শরীর ঘাঁটতে চাননি, চেয়েছেন কেবলই সৌন্দর্যের উপাসনা করতে। শিল্পীর মতে, উন্মুক্ততা বা পরিপূর্ণ প্রকাশ পবিত্রতার আরাধনা-যা একজন শিল্পীই কেবল করতে পারেন।
উলঙ্গতাই কি সৌন্দর্য নাকি অশ্লীলতা? ঢেকে রাখা তাহলে কী? এ প্রশ্নের পক্ষে-বিপক্ষে মত যতই থাক সব উলঙ্গতা সমর্থনযোগ্য হওয়ার সুযোগ রাখে না। এর পরও বলা যায়, উলঙ্গ মানেই অপমানিত করা নয়। যদি তাই হতো, তাহলে অজন্তা-ইলোরা, খাজোরাহো কিংবা কোনারাকের মন্দিরগুলোতে বিস্ময়কর নন্দিত বিশ্ব স্থাপত্যগুলো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়নি কেন?
অবশ্য এ বিতর্ক একেবারে থেমে গেছে বা কখনো যাবে ভাবার কারণ নেই। বিদেশের মাটিতে গিয়েও হুসেন বলেছেন, 'আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমি একজন ভারতীয় শিল্পী, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বিশ্বাস আমার থাকবে।' হুসেনের এ উচ্চারণ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারতকে নতুন আত্মজিজ্ঞাসায় দাঁড় করাবে বলে আমার ধারণা। একজন শিল্পী, লেখক, সৃজনশীল মানুষ যা বলবেন, যা করবেন-সেটিই সবাই মেনে নেবে না। দ্বিমত পোষণ করার অধিকার সবারই থাকা উচিত। কিন্তু তাঁর বক্তব্য পছন্দ হলো না বলে তাঁকে হত্যা করতে হবে, আক্রান্ত করতে হবে, দেশান্তরিত করতে হবে-এ কোন ধরনের বর্বরতা? এ বিকার সামাজিক ও মানবিক প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশের প্রবল বিতর্কিত লেখক তসলিমা নাসরিনের বহু মত ও বক্তব্যের সঙ্গে আমি শক্ত দ্বিমত পোষণ করি। এ নিয়ে দেশে ও বিদেশে লিখেছিও আমি। কিন্তু জন্মগতভাবে এ দেশের একজন নাগরিক হয়ে তসলিমা কেবল মত প্রকাশের কারণে নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে পারবেন না-এ যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রশক্তি যদি ধর্মীয় কিংবা উগ্রপন্থীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে, বুঝে কিংবা না-বুঝে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে সে সমাজের দুর্ভাগ্য বাড়ে। রাষ্ট্র ও সমাজকে ব্যক্তির বিশ্বাস প্রচার করার অধিকার না দিলে সে সমাজ গণতান্ত্রিক থাকে না, আবদ্ধ হয়, সভ্য থাকে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
e-mail: hh1971@gmail.com
No comments