গৃহশ্রম-আমাদের শহরে কতিপয় নূরজাহান by আলতাফ পারভেজ
গৃহশ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের নাগরিক পটভূমিতে একটি বাস্তবতা। বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, বড় বড় শহরে প্রায় ২০ লাখ গৃহশ্রমিক রয়েছে। কেবল ঢাকাতে ৪-৫ লাখ নারী ও শিশু বসতবাড়িতে কাজ করে। এদের কোনোভাবে দাস হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই এবং গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ১২ বছরের কম বয়সী কাউকে দিয়ে গৃহশ্রমিকের কাজ করানো নিষিদ্ধ
মুন্সীগঞ্জ শহরের পূর্ব দেওভোগ। শিশু ফরিদাকে দুটি শুকনো মরিচ তেলে ভাজতে বলা হয়। ভুল করে তিনটি মরিচ ভেজে ফেলে ফরিদা। বাড়ির মালিক বীথি খন্দকার ক্ষিপ্ত হন। কড়াইয়ের গরম তেল ঢেলে দেওয়া হয় ফরিদার দেহে। চোখ দুটি অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও ঝলসে যায় মুখমণ্ডল। বিষয়টি গোপন ছিল দু'দিন। পরে ফরিদার বড় বোন রেখা সদর থানায় জানায় বিষয়টি। বীথি খন্দকার গ্রেফতার হন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪(২)(খ) ধারায় মামলা হয়। আসামি গ্রেফতার থাকায় ১৫ কার্যদিবসে এ মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু ফাইনাল রিপোর্টে দেখা গেল, 'মামলায় তথ্যগত ভুল আছে।' ইতিমধ্যে আসামি ছাড়া পেলেন। বীথি খন্দকাররা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। দরিদ্র ফরিদারা কাজের সন্ধানে এসেছে লালমনিরহাটের আদিতমারী থেকে। শ্রেণী ভারসাম্যহীনতার সামাজিক এই বাস্তবতায় বিবাদিত বিষয়টি পাঁচ হাজার টাকায় 'আপস' হয়।
এর পরের ঘটনা ঢাকার ৯০/১ শংকরে। পাবনার মেয়ে আট বছরের শাপলা কাজ করে শাহ্নাজ সুলতানার ফ্ল্যাটে। গরম খুন্তি দিয়ে মেয়েটির সারা শরীরে ছেঁকা দিতেন গৃহকর্ত্রী। ২০০৯ সালের ১৪ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয় এ নিয়ে। বাদী সরকার। কিছু দিন পর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস্) অনুসন্ধানী দলের কাছে ধানমণ্ডি থানার সাব-ইন্সপেক্টর মন্তব্য করেন : 'পোড়ার যে আলামত, তা সামান্য। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত মীমাংসার দিকে যাবে।' তা-ই হয়। ৫০ হাজার টাকায় বিষয়টি 'মীমাংসা' হয়। 'পলাতক' আসামিকে আর গ্রেফতার হতে হয়নি।
এখানে মাত্র দুটি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হলেও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে ফৌজদারি বিষয়ে এ রকম আপসরফার কাহিনী জমে আছে বিস্তর। সব ঘটনায় যে আপস হয়েছে, তা কিন্তু নয়। অধিকাংশই কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে।
সেই কবে ২০০৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর নৌপরিবহনমন্ত্রী আকবর হোসেনের বাসায় গৃহশ্রমিক বিলকিস খুন হয়। ২০১১ সালের আগস্টে জানা গেল, এখনও মামলার তদন্ত চলছে। গত বছর জুলাইয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সোলায়মান মণ্ডলের শান্তিনগরের বাসায় গৃহকর্মী নূরজাহান মারা যায়। শরীরে ১৪টি আঘাতের চিহ্ন ছিল তার। ঘটনার পর থেকে পলাতক থাকা সচিব পরিবার কিছুদিন পর আদালতে উপস্থিত হওয়ামাত্র জামিন পেয়ে যায়। রংপুর সদরে থাকা নূরজাহানের পরিবারের পক্ষে ঢাকার এত শক্তিধর সচিবের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো সম্ভব নয়। তারা শুধু ধরে নিয়েছে 'শহরে আজরাইলরা থাকে।'
এসব আপস, বিস্মৃতি এবং নিয়তিবাদের নানা তাৎপর্য আছে। প্রথমত. গুরুতর নির্যাতন করেও রাষ্ট্রকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত. গৃহকর্মীদের প্রায় ৭০-৮০ ভাগই গ্রাম থেকে উঠে আসা দরিদ্র মানুষ। শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা মনে করে 'রাষ্ট্র'টি তার। গ্রামের মানুষ সেটা 'বিশ্বাস'ও করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র নিম্নবর্গের কাছে রাষ্ট্র কোনো বৈধতাই পাচ্ছে না আজও। তারা মনেই করে না, বর্তমান রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় অন্যায়ের বিচার পাওয়া সম্ভব। এমনও প্রমাণ মিলেছে, এনজিওগুলোর তরফ থেকে শক্ত আইনি সহায়তার পরও নির্যাতিত পরিবার 'আপস'-এ আগ্রহী। রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস এবং নিজেদের মধ্যে জেঁকে বসা এরূপ মনোজাগতিক হীনম্মন্যতাবোধও আমাদের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার আরেক বড় দুর্বলতা। গৃহকর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রকর্মের যোগাযোগ ঠিক এ জায়গাতেই। এখানেই গৃহশ্রমিকদের পেশাগত সুরক্ষা ও তার নিরাপত্তার প্রশ্নটি আমাদের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার জরুরি জিজ্ঞাসা হয়ে ওঠে।
গৃহশ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের নাগরিক পটভূমিতে একটি বাস্তবতা। বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, বড় বড় শহরে প্রায় ২০ লাখ গৃহশ্রমিক রয়েছে। কেবল ঢাকাতে ৪-৫ লাখ নারী ও শিশু বসতবাড়িতে কাজ করে। এদের কোনোভাবে দাস হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই এবং গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ১২ বছরের কম বয়সী কাউকে দিয়ে গৃহশ্রমিকের কাজ করানো নিষিদ্ধ। কিন্তু এটাই রূঢ় সত্য, ওই বয়সী লাখো গৃহশ্রমিক আছে এই রাজধানীতেই এবং তাদের অনেকখানি দাস হিসেবেই বিবেচনা করে শহুরে অভিজাতরা।
অভিজাতরা মোটেই বেকুব নয়। তারা দেখছে, গৃহশ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও কোনো ধরনের মজুরি কাঠামো ছাড়াই খাটানো যাচ্ছে। অধিকাংশ নিয়োগই 'পেটে-ভাতে'। মানবাধিকার সংগঠন নাগরিক উদ্যোগের জরিপে দেখা গেছে, ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে গৃহশ্রমিকরা টাকায় কোনো মজুরি পায় না। এদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই, মাসিক ছুটি নেই। বাড়িতে সবার আগে এরা ঘুম থেকে ওঠে এবং সবার পরে ঘুমাতে যায়। শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় না এমন গৃহশ্রমিক বিরল। অনেক বাসায় 'মালিক'দের জন্য এক রকমের রান্না হয়, 'কাজের লোকদের' জন্য আরেক চালে রান্না হয়। তার কাজের 'সুযোগ' ও তাকে 'বের করে দেওয়া' দুটোই 'মালিক'-এর ইচ্ছানির্ভর। মা হতে গেলে কাজটি হারাতে হয় অবধারিতভাবেই। যদিও যেসব বাসা থেকে তাদের বের করে দেওয়া হয় সেসব বাড়ির ক্ষমতায়িত কর্মজীবী নারীরা ঠিকই সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে 'মাতৃত্বকালীন ছুটি' ভোগ করে চলেছেন।
শ্রম আইনে বসতবাড়ির কাজের মানুষ 'শ্রমিক' নন বলেই এত আদিম বৈপরীত্য। নাগরিক অভিজাত যে এই বৈপরীত্য ধরে রাখতে চায়, তার কারণ এখানে পুঁজির সঞ্চয় ঘটছে আদিম ধাঁচে। তার জন্য দাস পাওয়া জরুরি। যদিও করপোরেট অধিপতিরা এই সভ্যতাকে আদুরে নাম দিয়েছেন 'মার্কেট ইকোনমি'। কিন্তু ঘরে ঘরে নিংড়ে নেওয়া দরিদ্র নিম্নবর্গের শ্রমকে মার্কেটের নিয়মে দাম দিতে তারা বড়ই নারাজ।
গৃহকর্মী নামক দাসরা সবাই যদি গড়ে প্রতিদিন ৪-৫ জন মানুষের সেবা করে থাকে তাহলে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবন এদের 'আত্মত্যাগ' ছাড়া অচল। এদের শ্রম শোষণ করেই নাগরিক স্মার্টনেস, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি হচ্ছে। কিন্তু এদের সেবায় প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠা শহুরে স্মার্ট ক্ষমতায়িত মানুষরা ঘরের অভিবাসী নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ?
২০০৫ সালে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত দুটি এলাকায় ২০০ গৃহশ্রমিকের সঙ্গে গবেষকরা কথা বলে দেখেছেন, চৌকি বা খাটসহ নির্দিষ্ট কোনো ঘুমানোর জায়গা নেই কোনো গৃহশ্রমিকের। ২০১০ সালে একই বাড়িগুলোতে পুনঃজরিপে দেখা গেছে, পরিস্থিতির হেরফের হয়নি খুব বেশি। অর্থাৎ অভিজাতরা ঘরে ঘরে দাসত্ব লালন করে যাচ্ছেন আদি ও অকৃত্রিম পদ্ধতিতেই। এমনকি সরকারি তরফ থেকে দেশজুড়ে এ পর্যন্ত চালু হওয়া ৮৪ রকমের 'সামাজিক নিরাপত্তা' কর্মসূচির একটিতেও গৃহকর্মীদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি। লাখ লাখ গৃহজীবী তারুণ্য ফুরালে কীভাবে বাঁচবে_ এ নিয়ে রাষ্ট্র কখনোই চিন্তিত নয়। সামাজিক নিরাপত্তা এই জনগোষ্ঠীর জন্যই সবচেয়ে জরুরি ছিল।
বিশ্বের অন্যত্রও এইরূপ অবস্থা কমবেশি আছে বৈকি। আইএলওর বিবেচনায় অন্তত পাঁচ কোটি গৃহশ্রমিক রয়েছে বিভিন্ন দেশে। এশিয়াতেই সংখ্যা অত্যধিক। এই পাঁচ কোটি গৃহকর্মীকে দাসত্ব থেকে শ্রমিক পরিচয়ে উত্তরণ ঘটাতে আইএলও গত জুনে তার শততম অধিবেশনে একটি কনভেনশন গ্রহণ করতে পেরেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে গৃহকর্মীরা 'শ্রমিক'-এর স্বীকৃতি পেল। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরাও এই দলিল গৃহীত হওয়ার সময় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। তবে কনভেনশনটি অনুসমর্থনের কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি এখনও।
বাংলাদেশ বহির্বিশ্বেও গৃহশ্রমিক পাঠায়। অন্তত দু' লাখ বাংলাদেশি নারী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। সুতরাং কেবল নিজে অনুসমর্থন নয়; অন্য দেশকেও এই কনভেনশন অনুসমর্থনে উদ্বুদ্ধ করা বাংলাদেশের দায়িত্ব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লক্ষণ ভালো নয়। গৃহশ্রমিকদের জন্য পৃথক আইন প্রণয়নের প্রস্তুতি হিসেবে দু'বছর আগে তৈরি হওয়া 'নীতিমালা'টি আজও আইন মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি। শ্রম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের বিশেষ আগ্রহ ও অঙ্গীকারও এ ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করতে পারছে না।
এ পরিস্থিতি অবশ্য অবোধগম্য নয়। গৃহশ্রমিকদের দাস হিসেবে রেখে দিতে পারা সরকারি-বেসরকারি নাগরিক অভিজাতদের প্রাত্যহিক মজার ক্ষেত্র। সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতনরা নিশ্চয়ই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকে সে সত্য জানেন।
কিন্তু কোনো নিপীড়ন চিরস্থায়ী নয়। এটা সত্য, দাস ব্যবস্থা সভ্যতার সমান বয়সী। অ্যারিস্টটল দাসপ্রথাকে সামাজিক প্রয়োজনে বৈধ বলেছিলেন, তবে গ্রিকদের দাসের ভূমিকায় অনুমোদন ছিল না তার। অসকার ওয়াইল্ডও মনে করতেন, 'সভ্যতা গড়ে তুলতে সব সময় দাস দরকার হয়েছে।' কিন্তু মানব-দাসের জায়গায় যন্ত্র-দাসের আবির্ভাব ঘটিয়েই মানব সভ্যতা 'সভ্য' হয়েছে এবং ১৮৯০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দাসত্ব অবসানের অঙ্গীকার করেছিল বিশ্ব সমাজ। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যে উপায়েই টিকে থাক, দাসত্ব নামক প্রতিষ্ঠানটিকে উপড়ে ফেলতে হবে বাংলাদেশেও। এটা 'সভ্যতা'র পথে আমাদের পুরনো দায়। তা ছাড়া নিপীড়নের ধারাবাহিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এমন একটি জ্ঞানতত্ত্বের জন্ম দেয়, যা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার জন্য বিরাট হুমকি।
আলতাফ পারভেজ :লেখক, গবেষক
altafparvez@yahoo.com
এর পরের ঘটনা ঢাকার ৯০/১ শংকরে। পাবনার মেয়ে আট বছরের শাপলা কাজ করে শাহ্নাজ সুলতানার ফ্ল্যাটে। গরম খুন্তি দিয়ে মেয়েটির সারা শরীরে ছেঁকা দিতেন গৃহকর্ত্রী। ২০০৯ সালের ১৪ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয় এ নিয়ে। বাদী সরকার। কিছু দিন পর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস্) অনুসন্ধানী দলের কাছে ধানমণ্ডি থানার সাব-ইন্সপেক্টর মন্তব্য করেন : 'পোড়ার যে আলামত, তা সামান্য। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত মীমাংসার দিকে যাবে।' তা-ই হয়। ৫০ হাজার টাকায় বিষয়টি 'মীমাংসা' হয়। 'পলাতক' আসামিকে আর গ্রেফতার হতে হয়নি।
এখানে মাত্র দুটি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হলেও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে ফৌজদারি বিষয়ে এ রকম আপসরফার কাহিনী জমে আছে বিস্তর। সব ঘটনায় যে আপস হয়েছে, তা কিন্তু নয়। অধিকাংশই কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে।
সেই কবে ২০০৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর নৌপরিবহনমন্ত্রী আকবর হোসেনের বাসায় গৃহশ্রমিক বিলকিস খুন হয়। ২০১১ সালের আগস্টে জানা গেল, এখনও মামলার তদন্ত চলছে। গত বছর জুলাইয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সোলায়মান মণ্ডলের শান্তিনগরের বাসায় গৃহকর্মী নূরজাহান মারা যায়। শরীরে ১৪টি আঘাতের চিহ্ন ছিল তার। ঘটনার পর থেকে পলাতক থাকা সচিব পরিবার কিছুদিন পর আদালতে উপস্থিত হওয়ামাত্র জামিন পেয়ে যায়। রংপুর সদরে থাকা নূরজাহানের পরিবারের পক্ষে ঢাকার এত শক্তিধর সচিবের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো সম্ভব নয়। তারা শুধু ধরে নিয়েছে 'শহরে আজরাইলরা থাকে।'
এসব আপস, বিস্মৃতি এবং নিয়তিবাদের নানা তাৎপর্য আছে। প্রথমত. গুরুতর নির্যাতন করেও রাষ্ট্রকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত. গৃহকর্মীদের প্রায় ৭০-৮০ ভাগই গ্রাম থেকে উঠে আসা দরিদ্র মানুষ। শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা মনে করে 'রাষ্ট্র'টি তার। গ্রামের মানুষ সেটা 'বিশ্বাস'ও করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র নিম্নবর্গের কাছে রাষ্ট্র কোনো বৈধতাই পাচ্ছে না আজও। তারা মনেই করে না, বর্তমান রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় অন্যায়ের বিচার পাওয়া সম্ভব। এমনও প্রমাণ মিলেছে, এনজিওগুলোর তরফ থেকে শক্ত আইনি সহায়তার পরও নির্যাতিত পরিবার 'আপস'-এ আগ্রহী। রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস এবং নিজেদের মধ্যে জেঁকে বসা এরূপ মনোজাগতিক হীনম্মন্যতাবোধও আমাদের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার আরেক বড় দুর্বলতা। গৃহকর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রকর্মের যোগাযোগ ঠিক এ জায়গাতেই। এখানেই গৃহশ্রমিকদের পেশাগত সুরক্ষা ও তার নিরাপত্তার প্রশ্নটি আমাদের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার জরুরি জিজ্ঞাসা হয়ে ওঠে।
গৃহশ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের নাগরিক পটভূমিতে একটি বাস্তবতা। বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, বড় বড় শহরে প্রায় ২০ লাখ গৃহশ্রমিক রয়েছে। কেবল ঢাকাতে ৪-৫ লাখ নারী ও শিশু বসতবাড়িতে কাজ করে। এদের কোনোভাবে দাস হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই এবং গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ১২ বছরের কম বয়সী কাউকে দিয়ে গৃহশ্রমিকের কাজ করানো নিষিদ্ধ। কিন্তু এটাই রূঢ় সত্য, ওই বয়সী লাখো গৃহশ্রমিক আছে এই রাজধানীতেই এবং তাদের অনেকখানি দাস হিসেবেই বিবেচনা করে শহুরে অভিজাতরা।
অভিজাতরা মোটেই বেকুব নয়। তারা দেখছে, গৃহশ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও কোনো ধরনের মজুরি কাঠামো ছাড়াই খাটানো যাচ্ছে। অধিকাংশ নিয়োগই 'পেটে-ভাতে'। মানবাধিকার সংগঠন নাগরিক উদ্যোগের জরিপে দেখা গেছে, ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে গৃহশ্রমিকরা টাকায় কোনো মজুরি পায় না। এদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই, মাসিক ছুটি নেই। বাড়িতে সবার আগে এরা ঘুম থেকে ওঠে এবং সবার পরে ঘুমাতে যায়। শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় না এমন গৃহশ্রমিক বিরল। অনেক বাসায় 'মালিক'দের জন্য এক রকমের রান্না হয়, 'কাজের লোকদের' জন্য আরেক চালে রান্না হয়। তার কাজের 'সুযোগ' ও তাকে 'বের করে দেওয়া' দুটোই 'মালিক'-এর ইচ্ছানির্ভর। মা হতে গেলে কাজটি হারাতে হয় অবধারিতভাবেই। যদিও যেসব বাসা থেকে তাদের বের করে দেওয়া হয় সেসব বাড়ির ক্ষমতায়িত কর্মজীবী নারীরা ঠিকই সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে 'মাতৃত্বকালীন ছুটি' ভোগ করে চলেছেন।
শ্রম আইনে বসতবাড়ির কাজের মানুষ 'শ্রমিক' নন বলেই এত আদিম বৈপরীত্য। নাগরিক অভিজাত যে এই বৈপরীত্য ধরে রাখতে চায়, তার কারণ এখানে পুঁজির সঞ্চয় ঘটছে আদিম ধাঁচে। তার জন্য দাস পাওয়া জরুরি। যদিও করপোরেট অধিপতিরা এই সভ্যতাকে আদুরে নাম দিয়েছেন 'মার্কেট ইকোনমি'। কিন্তু ঘরে ঘরে নিংড়ে নেওয়া দরিদ্র নিম্নবর্গের শ্রমকে মার্কেটের নিয়মে দাম দিতে তারা বড়ই নারাজ।
গৃহকর্মী নামক দাসরা সবাই যদি গড়ে প্রতিদিন ৪-৫ জন মানুষের সেবা করে থাকে তাহলে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবন এদের 'আত্মত্যাগ' ছাড়া অচল। এদের শ্রম শোষণ করেই নাগরিক স্মার্টনেস, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি হচ্ছে। কিন্তু এদের সেবায় প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠা শহুরে স্মার্ট ক্ষমতায়িত মানুষরা ঘরের অভিবাসী নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ?
২০০৫ সালে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত দুটি এলাকায় ২০০ গৃহশ্রমিকের সঙ্গে গবেষকরা কথা বলে দেখেছেন, চৌকি বা খাটসহ নির্দিষ্ট কোনো ঘুমানোর জায়গা নেই কোনো গৃহশ্রমিকের। ২০১০ সালে একই বাড়িগুলোতে পুনঃজরিপে দেখা গেছে, পরিস্থিতির হেরফের হয়নি খুব বেশি। অর্থাৎ অভিজাতরা ঘরে ঘরে দাসত্ব লালন করে যাচ্ছেন আদি ও অকৃত্রিম পদ্ধতিতেই। এমনকি সরকারি তরফ থেকে দেশজুড়ে এ পর্যন্ত চালু হওয়া ৮৪ রকমের 'সামাজিক নিরাপত্তা' কর্মসূচির একটিতেও গৃহকর্মীদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি। লাখ লাখ গৃহজীবী তারুণ্য ফুরালে কীভাবে বাঁচবে_ এ নিয়ে রাষ্ট্র কখনোই চিন্তিত নয়। সামাজিক নিরাপত্তা এই জনগোষ্ঠীর জন্যই সবচেয়ে জরুরি ছিল।
বিশ্বের অন্যত্রও এইরূপ অবস্থা কমবেশি আছে বৈকি। আইএলওর বিবেচনায় অন্তত পাঁচ কোটি গৃহশ্রমিক রয়েছে বিভিন্ন দেশে। এশিয়াতেই সংখ্যা অত্যধিক। এই পাঁচ কোটি গৃহকর্মীকে দাসত্ব থেকে শ্রমিক পরিচয়ে উত্তরণ ঘটাতে আইএলও গত জুনে তার শততম অধিবেশনে একটি কনভেনশন গ্রহণ করতে পেরেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে গৃহকর্মীরা 'শ্রমিক'-এর স্বীকৃতি পেল। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরাও এই দলিল গৃহীত হওয়ার সময় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। তবে কনভেনশনটি অনুসমর্থনের কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি এখনও।
বাংলাদেশ বহির্বিশ্বেও গৃহশ্রমিক পাঠায়। অন্তত দু' লাখ বাংলাদেশি নারী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। সুতরাং কেবল নিজে অনুসমর্থন নয়; অন্য দেশকেও এই কনভেনশন অনুসমর্থনে উদ্বুদ্ধ করা বাংলাদেশের দায়িত্ব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লক্ষণ ভালো নয়। গৃহশ্রমিকদের জন্য পৃথক আইন প্রণয়নের প্রস্তুতি হিসেবে দু'বছর আগে তৈরি হওয়া 'নীতিমালা'টি আজও আইন মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি। শ্রম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের বিশেষ আগ্রহ ও অঙ্গীকারও এ ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করতে পারছে না।
এ পরিস্থিতি অবশ্য অবোধগম্য নয়। গৃহশ্রমিকদের দাস হিসেবে রেখে দিতে পারা সরকারি-বেসরকারি নাগরিক অভিজাতদের প্রাত্যহিক মজার ক্ষেত্র। সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতনরা নিশ্চয়ই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকে সে সত্য জানেন।
কিন্তু কোনো নিপীড়ন চিরস্থায়ী নয়। এটা সত্য, দাস ব্যবস্থা সভ্যতার সমান বয়সী। অ্যারিস্টটল দাসপ্রথাকে সামাজিক প্রয়োজনে বৈধ বলেছিলেন, তবে গ্রিকদের দাসের ভূমিকায় অনুমোদন ছিল না তার। অসকার ওয়াইল্ডও মনে করতেন, 'সভ্যতা গড়ে তুলতে সব সময় দাস দরকার হয়েছে।' কিন্তু মানব-দাসের জায়গায় যন্ত্র-দাসের আবির্ভাব ঘটিয়েই মানব সভ্যতা 'সভ্য' হয়েছে এবং ১৮৯০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দাসত্ব অবসানের অঙ্গীকার করেছিল বিশ্ব সমাজ। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যে উপায়েই টিকে থাক, দাসত্ব নামক প্রতিষ্ঠানটিকে উপড়ে ফেলতে হবে বাংলাদেশেও। এটা 'সভ্যতা'র পথে আমাদের পুরনো দায়। তা ছাড়া নিপীড়নের ধারাবাহিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এমন একটি জ্ঞানতত্ত্বের জন্ম দেয়, যা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার জন্য বিরাট হুমকি।
আলতাফ পারভেজ :লেখক, গবেষক
altafparvez@yahoo.com
No comments