অরণ্যে রোদন-সুন্দর বাংলাদেশে স্বাগত, হে অতিথিগণ by আনিসুল হক

বাংলাদেশ আজ অতিথিবরণ নিয়ে ব্যস্ত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আসছেন, এসে গেছে আর্জেন্টিনা আর নাইজেরিয়ার ফুটবল দল। বাংলাদেশ অতিথিপরায়ণ দেশ, অতিথিবৎ সল হিসেবে এ দেশের মানুষের সুনাম রয়েছে বহু বছর ধরে।


বাংলাদেশের মানুষ এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অর্থাৎ কিনা বাঙালিদের মধ্যে একটা অভিন্ন লক্ষণ রয়েছে, তা হলো আর্জেন্টিনা-প্রীতি ও ব্রাজিল-প্রীতি। বিশ্বকাপ ফুটবলের মৌসুমে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মেতে ওঠে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল নিয়ে। আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিল নিয়ে যে মাতামাতিটা এই অঞ্চলে হয়ে থাকে, তার কোনো তুলনা বোধ হয় পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে না।
কত দূরের দেশ ব্রাজিল। কত দূরের দেশ আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের যে সমর্থকেরা আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পরে আত্মহত্যা করেন, যে সমর্থকেরা ব্রাজিলের হারের পর হূদ্যন্ত্র বন্ধ হয়ে মারা যান, তাঁদের অনেকেই জানেন না ব্রাজিল কোথায়, আর্জেন্টিনার রাজধানীর নাম কী! কিন্তু তাঁরা জানেন ম্যারাডোনার নাম, তাঁরা তর্ক করেন পেলে বড় না ম্যারাডোনা আর তাঁরা পাগল মেসির নামে।
আমরা বাঙালিরা কেবল অতিথিপরায়ণ তা-ই না, আমরা আন্তর্জাতিকও। আমরা সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো ভালোবেসে গ্রহণ করতে জানি। আমি যা কিছু মহান, বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, মেশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়। তাই তো আমরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে সংঘটিত ঘটনা-দুর্ঘটনায় আলোড়িত হই, যেকোনো প্রান্তের মানুষের সাফল্যে উদ্বোধিত হই, মেসি নামের এক দেবশিশু, যাঁর পায়ের সঙ্গে বলটা যেন জাদুমন্ত্রে বাঁধা, তাঁর জন্য ভালোবাসার অর্ঘ্য সাজিয়ে বসে থাকি। আমরা ডায়ানার জন্য কাঁদি, মাইকেল জ্যাকসনের জন্য আকুল হই, দেশে দেশে নির্যাতিত মানুষের জন্য সংহতি জানিয়ে মিছিল করি। আর অতিথি বরণ করার জন্য আমাদের শেষ সম্বলটুকু বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করি না। এমনও হয়েছে, নিজের পেটে ভাত নেই, অতিথি আপ্যায়নের জন্য নিজের শখের মোরগটাকে জবাই করেছে এ দেশের কোনো গরিব কিষানি।
আমাদের এই সারা পৃথিবীর মানুষকে বরণ করা ও ভালোবাসা দেখানোর ঐতিহ্য আজ একটা বিশেষ তাৎ পর্য অর্জন করছে। আজ আমরা একই সঙ্গে নাইজেরিয়া ও আর্জেন্টিনার ফুটবল দলকে বরণ করে নিচ্ছি, বরণ করে নিচ্ছি আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের ঐতিহ্যগত আতিথেয়তা দিয়ে এই অতিথিদের যথাযথ সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করব। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কূটনীতি, দেনা-পাওনার হিসাব, চুক্তি ও সম্মতিপত্রের খুঁটিনাটি, লাভালাভ, পদ্ধতিগত দিকগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কথা বলছেন, বলবেন। আমি এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই। কাজেই কূটনীতি পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে আমি কোনো কথাই বলব না। শুধু দুটো পর্যবেক্ষণের কথা আমি এখানে পাড়ব। এক. প্রথম আলো এই সরকারের ক্ষমতা আরোহণের শুরুতে ও এক বছর পরে দুটো জনমত জরিপের ফল প্রকাশ করেছিল। ওআরজি কোয়েস্ট নামের একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠান এ জরিপ পরিচালনা করেছিল। তাতে প্রতিফলিত হয়েছিল যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হোক, এটা দেখতে চায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভোটের রাজনীতিতে ভারত খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা স্পর্শকাতর বিষয় বলেই চিরকাল বিবেচিত হয়ে এসেছে। গত নির্বাচনের আগে প্রথম আলোর সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের একটি সাক্ষাৎ কার নিয়েছিলেন। তাতে অধ্যাপক তালুকদার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন, বাজি ধরেছিলেন যে যা-ই হোক না কেন, এ দেশের মানুষ মোটের ওপর ভারতবিদ্বেষী, তারা শেষ পর্যন্ত বিএনপিকেই পুনর্নির্বাচিত করবে। পরে আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন অর রশীদ সেই মত খণ্ডন করে বলেছিলেন, মানুষ বিএনপিকে পুনর্নির্বাচিত করবে না। শেষ পর্যন্ত ভোটের ফল কী হয়েছিল, আমরা জানি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তাঁর দ্বারা একটা ধারণায় আমরা উপনীত হতে পারি, আমাদের নতুন প্রজন্মের ভোটারদের মন সাদা কাগজের মতো পরিষ্কার, তারা ভারতপন্থী নয়, তারা ভারতবিরোধী নয়, তারা সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে, তুমি যদি সুশাসন দিতে পারো, তাহলে তোমার প্রতি আমার সমর্থন আছে, যদি না দিতে পারো, তাহলে সরে যাও। আরেকটা ধারণা এ দেশের কোনো কোনো রাজনীতিকের মনে আছে বলে মনে হয়। তাঁরা মনে করেন, এ দেশে কে ক্ষমতায় আসবে বা আসবে না, তা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ নির্ধারণ করে দেয়। এর চেয়ে ভুল কথা আর কিছুই হতে পারে না। এ দেশের মানুষের মতো দেশপ্রেমিক মানুষও কম আছে। তারাই ঠিক করে, এবার কে ক্ষমতায় আসবে, কে আসবে না। ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ভোটের ফল পাল্টাতে পারবে না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও পারেনি, নব্বইয়ের পরের প্রতিটি নির্বাচনেই মানুষের ইচ্ছারই জয় হয়েছে। মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন যদি কখনো না ঘটে, তার পরিণতিও ভালো হবে না। ইতিহাস তার সাক্ষী।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটা ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধুত্বের স্বর্ণদুয়ার দিয়ে আমরা সোনালি দিনে প্রবেশ করব, যার মধ্য দিয়ে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে, এটাই হোক দুই দেশের সম্পর্কের সূত্র। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালে যত দিন ভারতে ছিলেন, তত দিন তাঁর ঘড়ির সময় আধঘণ্টা এগিয়ে ভারতের সময় করেননি, সব সময় বাংলাদেশের সময়ই তিনি তাঁর কবজিতে ধারণ করেছিলেন। বিজয় অর্জিত হওয়ার পরে, বিমানে ওঠার আগে বলে এসেছিলেন, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ হবে, তবে অবশ্যই দুটো স্বাধীন দেশের মধ্যে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ভারতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় সেনা প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ ফয়সালা করে এসেছিলেন। আমরা অবশ্যই সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু দুই দেশের এত দিনের সম্পর্কের ভেতরে অনেক অকারণ বৈরিতা ছিল; ভোটের স্বার্থে কিংবা পুরোনো মানসিকতার ধারাবাহিকতায় বিরোধিতা, কখনো কখনো বৈরিতা জিইয়ে রাখা হয়েছিল। শত্রুতা কখনোই স্বাস্থ্যকর নয়। বন্ধুতাই শ্রেয়তর পথ। উভয় দেশের জনগণ আসলে বন্ধুত্বই প্রত্যাশা করে। কিন্তু কোনো দেশের মানুষই নিজের দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে দেখাটা পছন্দ করবে না। বাংলাদেশ যেহেতু আয়তনে ও জনসংখ্যায় ছোট দেশ, বৃহত্তর প্রতিবেশীর প্রতি তার সন্দেহ ও অভিমান বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। সারা পৃথিবীতেই শক্তিশালী ও বৃহৎ প্রতিবেশীর প্রতি ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশের মানুষের একই মনোভাব। কাজেই ছাড় যদি দিতে হয়, সেটা ভারতকেই বেশি দিতে হবে।
অন্যদিকে কেবল ভারতবিরোধিতাই যাঁদের রাজনীতির একমাত্র পুঁজি, তাঁরা নিজেদের মঙ্গল করবেন যদি রাজনীতিতে নেতিবাচকতা বাদ দিয়ে ইতিবাচকতা অন্বেষণ করেন। দেশের মানুষ আর কোনো জুজুর ভয়ে ভীত নয়। বাংলাদেশের স্বার্থ যদি ক্ষুণ্ন না হয়, বিভেদপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি কোনো সুবিধা করতে পারবে না। কিন্তু দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলে সর্বসাধারণই বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার ফুটবল দল এবং ভারতের নেতাদের বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের পক্ষ থেকে স্বাগত জানাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.