রঙ্গব্যঙ্গ-ফজলু মিয়ার বাজেট by মোস্তফা কামাল

দেশের হতদরিদ্র মানুষকে নিয়ে কেউ ভাবে না। সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। যেই লাউ সেই কদু! কথায় বলে না_যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ! বাংলাদেশের সরকারগুলোও তাই। ক্ষমতায় গেলে বড়লোকদের নিয়ে মাতামাতি করে। ভুলে যায় সাধারণ মানুষের কথা। কিন্তু এসব মানুষকে নিয়ে বড্ড বেশি ভাবেন ফজলু মিয়া। এবার ফজলু মিয়ার ভাবনার একটি বাজেট আমরা জনগণের সামনে উত্থাপন করছি।


আমার নাম ফজলু মিয়া। একসময় ধনী কৃষক ছিলাম। নদীভাঙনে সব শেষ হইয়া গেছে। এখন ঢাকা শহরে রিকশা চালাইয়া খাইয়া-পইরা বাঁইচা আছি। আমি যেই দিন রিকশা চালাই, সেই দিন আমার ছেলেমেয়েরা দুই-চারটা ভাত মুখে দিতে পারে। যেই দিন রিকশা চালাইতে পারি না, সেই দিন না খাইয়া থাকে। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে চাইয়া আমি প্রত্যেক দিন রিকশা চালাই। মানুষ টানার এই গাড়ি চালাইতে মাথার ঘাম পায়ে পড়ে, তবুও কেউ দুই-চাইর টাকা বেশি দেয় না। তারাই বা দিব কোথা থেকে? তাদেরও তো একই অবস্থা। আয় কম, ব্যয় বেশি। তারা যে দয়া কইরা রিকশায় চড়ে এইটাই তো বেশি! বড়লোকরা কি রিকশায় চড়ে! তারা চড়ে নামিদামি গাড়িতে।
রিকশা চালাই বইলা আমার সঙ্গে রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, মুটে-মজুর, ভিক্ষুক তথা রাস্তার মানুষের পরিচয় আছে। তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে কিছু ধারণা আছে। আমি তাদের কষ্ট দেখি। তাদের চোখে পানি দেইখা বুকে ব্যথা পাই। আমাদের মতো এই সব রাস্তার মানুষের চাহিদা খুবই অল্প। তারা চায় মোটা ভাত, মোটা কাপড় আর শান্তিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই। এই সব প্রান্তিক মানুষের জন্য চালের কেজি ১০ টাকা করা ছাড়া উপায় নাই। এই ১০ টাকা কেজি চালের দাম নিয়া কত রকম রাজনীতি হইছে। কোনকালে নাকি শেখ হাসিনা কইছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ১০ টাকা দর চাল খাওয়াইবেন। ক্ষমতায় যাওয়ার পর তিনি নাকি সব ভুইলা গেছেন। আমিও ভুইলা গেছি। গতর খাটলে কি আর মাথায় কিছু থাকে! মাথা জং ধইরা ভোঁতা হইয়া গেছে! আমারে মনে করাইয়া দিছে ওই রাজনীতির লোকরা। তারা বলে, '৪০ টাকা দর চাল খাচ্ছ, এখন কষ্ট লাগে না! এখন কিছু কও না কেন? কিছু একটা করো।'
আমি মনে মনে চিন্তা করি, শেখ হাসিনা তো আর ১০ টাকা দরে চাল খাওয়াতে পারবেন না! তাঁর কাছে দাবি তুইলা লাভ কী? তাই আমি নিজেই বাজেট দিছি। এর জন্য খাদ্যদ্রব্যে অনেক ভর্তুকি দিতে হইব। তাতে কী, প্রান্তিক মানুষদের বাঁচা-মরার ব্যাপার! তাদের তো আর না খাওয়াইয়া মারা যায় না! টিভিতে খবর দেখছি, সমস্ত পৃথিবীতে খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেক চড়া। কোনো দেশই ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াইতে পারবে না। আমি মনে করি, সমস্ত ঘাটতি খাদ্যদ্রব্যে দিতে হইব। এই দেশে একসময় গরিব মানুষ আটার রুটি খাইত। অথচ সেই আটার দাম শুনলে মাথা গরম হইয়া যায়। কোন দেশে আছি আমরা! এখন আটার রুটি খায় বড়লোকে। তাই চালের দামের চেয়ে আটার দাম বেশি। চালের কেজি যদি হয় ১০ টাকা, আটার কেজি হওয়া উচিত আট টাকা।
আমরা একসময় ছিলাম 'মাছে-ভাতে বাঙালি'। আমাদের দেশনেত্রী নতুন স্লোগান দিলেন, 'ডাল-ভাতে বাঙালি'। ক্ষমতায় গেলে তিনি নাকি 'ডাল-ভাত' খাওয়াইবেন। অথচ তিনিই ডালের দাম এমন বাড়ান বাড়াইলেন, ডালের আর নাগালই পাইলাম না! সেই ডালের কেজি এখন ৮০-৯০ টাকা। কী আশ্চর্য কাণ্ড! মাছের দেখা তো সপ্তাহে কোনো দিন পাই, কোনো দিন পাই না। এই দেশটারে বলা হয়, নদীনালার দেশ। সেই দেশে মাছ চোখে দেখব না, এইটা কি হইতে পারে! না না, মাছে-ভাতে বাঙালির প্রচলনটা নতুন কইরা শুরু করতে হইব। এই জন্য এইসব পণ্যে ভর্তুকি বাড়াইয়া দিতে হইব। শাকসবজি, তরিতরকারি রাস্তাঘাটে হয়। সেই তরিতরকারি আমরা চোখে দেখি না। এগুলা নাকি এখন বড়লোকের খাবার! এইটা কোনো কথা হইল! ফড়িয়া, অতি মুনাফাখোরদের মুখোশ উন্মোচন করতে হইব। তা না হইলে ওদের বাড়াবাড়ি বন্ধ হইব না।
শুধু কী ফড়িয়া, অতিমুনাফাখোরদের বাড়াবাড়ি! চোর-বাটপাড়, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী, দলীয় ক্যাডাররা রাতে ঘুমাইতে দেয় না। সারা দিন কাঠফাটা রউদের মধ্যে রিকশা চালাই। রাইতে বাড়িতে গিয়া যে শান্তিতে ঘুমাব, তার কোনো সুযোগ নাই। ফেরার সময় রাস্তায় আটকায় ছিনতাইকারী। সারা দিনের রোজগার তাদের হাতে তুইলা দিয়া বাড়ি ফিরতে হয়। কোনো কোনো দিন নিরাপদে বাড়ি ফিরলেও বস্তিতে রংবাজ লোকরা হামলা করে। নেতা-পাতি নেতারা চাঁদাবাজি করে। অথচ তারা আমাদের মাথা বিক্রি কইরা রাজনীতি করে। অনেকে করে মাদকের ব্যবসা। এই সব বন্ধ করার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হইব।
আরো বরাদ্দ বাড়াইতে হইব শিশুখাদ্যে। আমাদের বাচ্চারা পুষ্টির অভাবে মারা যায়। অনাহারী-অর্ধাহারী মা শিশুকে দুধ দিতে পারে না। বাজারেও শিশুখাদ্যের দাম চড়া। সঙ্গে আছে ভেজালের কারবার! এই অবস্থা হইলে আমরা কোথায় যাইব! এটা চলব না। শিশুখাদ্যের দাম কম রাখার জন্য বিশেষ ভর্তুকি দিতে হইব।
এর সঙ্গে রউদ, বৃষ্টিবাদল, ঝড়-বন্যা থেকে রক্ষার জন্য সবাইকে অন্তত একটি টিনের ঘর বানাইয়া দিতে হইব। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে একজন নেত্রী বলেছিলেন, সবাইকে একটি বাড়ি ও একটি খামার উপহার দিবেন। ক্ষমতায় যাওয়ার পর সব ভুইলা গেছেন। এখন নাকি দলীয় লোকদের পুনর্বাসনের কাজ চলতেছে। তাই আমাদের আম-পাবলিকের বারোটা বাইজা যাচ্ছে!
আমার বাজেট বক্তৃতা শেষ হইল। জয় আম-পাবলিকের জয়!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.