চরাচর-ধানের বিলুপ্তি ও সম্ভাবনা by সাইফুল ইসলাম খান
ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। ধান উৎপাদনের নিরিখে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম। চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পরই আমাদের অবস্থান। উর্বর মাটি ও ধানচাষের উপযোগী চমৎকার আবহাওয়ার কারণে এখানে প্রচুর ধান উৎপাদিত হয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অনুপাতে গত ৪০ বছরে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটি ৪০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর ইতিহাস ১০০ বছরের। ব্রিটিশ আমলে ১৯০৯ সালে ঢাকার তেজগাঁওয়ে কৃষি গবেষণা খামার প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পরের বছরই এখানে ধান নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ১৯৫৭ সালে ঢাকা ফার্মের জমি ডিআইটিকে দিয়ে দিলে ধানের ওপর গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। এর পাঁচ বছর পর রকফেলার ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন ঢাকায় আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রস্তাব করে। পাকিস্তান সরকার প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিলে এটি ফিলিপাইনে স্থাপিত হয়। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭০ সালে গাজীপুরে ধান গবেষণা কেন্দ্র ও ১৯৭২ সালে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে 'ইরি'র প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এ ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত চারটি হাইব্রিডসহ ৫৭টি ধান উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ব্রি ধান-৪০, ব্রি ধান-৪১, ব্রি ধান-৪৭, ব্রি ধান-৫১, ব্রি ধান-৫৩, ব্রি ধান-৫৪, বিনা-৭ ও স্বর্ণা উল্লেখযোগ্য। উপকূলীয় এলাকার জন্য লবণসহিষ্ণু, নিম্নাঞ্চলের জন্য জলমগ্নতা সহনশীল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভিটামিনসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন ব্রির সবচেয়ে বড় সাফল্য। এ ছাড়া খরা সহনশীল ধানের জাত শিগগিরই উদ্ভাবন হচ্ছে। উন্নত প্রজাতির ধান উদ্ভাবন ছাড়াও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট তাদের উদ্ভাবিত ধানের চাষ সম্পর্কে কৃষকদের সরাসরি প্রশিক্ষণ প্রদান, ২২টি কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন, ধানের ৩১টি রোগ ও ১৭৫টি ক্ষতিকর পোকামাকড় শনাক্ত করা এ প্রতিষ্ঠানের সাফল্য। জিন ব্যাংকে আট হাজার ধানের জাত ৫০ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। একই সঙ্গে সনাতন পদ্ধতির ধানের জাত সংগ্রহের মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে এ প্রতিষ্ঠান। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভারে নুয়েপড়া খাদ্যঘাটতির এ দেশে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা দিতে ৩০০ কৃষি বিজ্ঞানীসহ এক হাজারের বেশি কর্মী নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে আমাদের অনেক ধানের জাত। এ দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ৫০ জাতের পরিবেশবান্ধব ধান। এসব ধানের চাল দিয়ে রান্না ভাত খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এসব চাল দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস, চিঁড়া-মুড়ি-খৈয়ের জুড়ি মেলা ভার। শুধু সুনামগঞ্জের হাওর-বাঁওড়ে একসময় ২২৮ প্রজাতির বোরো ধানের চাষ হতো। ঝরাবাদল, বাঁশফুল, বরনাঝিরা, তুলসীমালা, গাজী, মধুমাধব, খাসিয়াবিনি্ন, হলিদামেথি ইত্যাদি কাব্যিক নামের সুস্বাদু ও সুগন্ধিযুক্ত ধান স্থানীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি আমাদের দেশীয় ধানের চাষাবাদ উন্নত প্রযুক্তির আওতায় আনতে পারলেই টিকে যাবে আমাদের দেশীয় ধান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
সাইফুল ইসলাম খান
সাইফুল ইসলাম খান
No comments