উন্নয়নকর্মীদের মিলনমেলায় মুহাম্মদ ইউনূস-এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের রাজনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা দানা বাঁধছে। সাধারণ মানুষ যা চাইছে, রাজনীতিবিদেরা তা ধারণ করে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিতে পারছেন না। রাজনৈতিক নেতাদের ওপর মানুষ সন্তুষ্ট নয়। তাই নতুনভাবে রাজনীতি করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বিকল্প রাজনৈতিক ধারা।


গতকাল শনিবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আয়োজিত উন্নয়নকর্মীদের মিলনমেলায় ড. ইউনূস এ কথা বলেছেন। অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আগামী দিনে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ ইউনূসেরও দায়িত্ব আছে। শুধু নতুনদের বললে হবে না, ইউনূসকেও নেতৃত্ব দিতে হবে। সেই পরিবর্তনে আমিও তাঁর পাশে থাকব।’
স্বাধীনতার ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ ভবন মিলনায়তনে এই মিলনমেলার আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে সঞ্চালক হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তরুণদের রাজনৈতিক প্রতিযোগী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। তবে বর্তমান রাজনীতিবিদেরাও থাকবেন, তাঁরা চলে যাবেন না।
মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও বর্তমান পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘একাত্তরের আগে আমাদের সব সম্ভাবনা একটি আবরণে আটকে ছিল। একাত্তরে তা অবমুক্ত হয়। এটা কারও নির্দেশে হয়নি। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে এসে মনে হচ্ছে, তেমনি কিছু আবরণ এসে সামনের দিনের সম্ভাবনাগুলোকে আটকে দিয়েছে। তরুণদের সেই আবরণ সরিয়ে ফেলে দেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।’
মুক্ত আলোচনা পর্বে উন্নয়নকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘দেশের রাজনীতির বর্তমান ধারা আগামী ২০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আমি বলে দিচ্ছি, আপনারা সাক্ষী, লিখে রাখেন। তরুণেরা নিজেদের ভেতরকার শক্তি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালে দেশটা এমনিতেই বদলে যাবে। তরুণদের নতুন ধারার নেতৃত্ব দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আগামী দুই বছর আপনি সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নিন। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে আসুন। দেশের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করুন। দুই বছরের মধ্যে আপনি নোবেল পুরস্কার পাবেন।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের গতকাল ছিল প্রথম দিন। ৪০টি বেসরকারি সংস্থার সহ-আয়োজনে এই উত্সবে দেশের ৪০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
‘স্বাধীনতার ৪০ বছরের অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অসুস্থতার কারণে তিনি যাননি।
আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘স্বাধীনতার পর গত ৪০ বছরে আমাদের অনেক অর্জন থাকলেও অনেক কিছুই অর্জিত হয়নি। যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম, তা আজ অনেকটাই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।’ আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে গ্রাম সরকার গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারকে একটা তামাশার বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে ১০-২০ বছরে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে যাবে।
অধ্যাপক ইউনূস প্রশাসনিক কাঠামোকে গাড়ির সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা হুকুম দেবেন। প্রশাসন সে অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু এখন প্রশাসনের ভেতরে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। ফলে প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। রাজনীতি দুর্বল থাকায় আমরা সবকিছুতে আটকে যাচ্ছি, বাধা পাচ্ছি।’
আলোচনার শুরুতে হোসেন জিল্লুর রহমান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অর্জন ব্যক্তিত্বের বিপ্লব। বাংলাদেশে যে স্বাধীনতার বিপ্লব হয়েছে, তার পেছনে অনেক চালক কাজ করেছেন। তাঁদের অন্যতম চালক হচ্ছেন মুহাম্মদ ইউনূস, ফজলে হাসান আবেদ, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মানুষেরা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জনের খাতায় অনেক যোগ থাকলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে।’
স্বাধীনতার ৪০ বছরে জাতির জীবনে প্রথম রাউন্ড শেষ হলো। আগামী ১০ বছর আমাদের দ্বিতীয় রাউন্ড চলবে উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘অনেকে হয়তো ভেবেছিলেন, এখান থেকেই আমরা কিছু একটা বলি। কিন্তু আজকে আর সেটা হচ্ছে না। তবে আজকে মুহাম্মদ ইউনূসের কথায় তার কিছুটা ইঙ্গিত পেলেন।’
অনুষ্ঠানে যাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন: বিশিষ্ট আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, শমসের মবিন চৌধুরী, শহিদুল্লাহ খান, কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, কাজী কামারুজ্জামান, শেফালি ভৌমিক, মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহম্মদ চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) মাইনউদ্দিন প্রমুখ।
মিলনমেলার মুক্ত আলোচনায় আজ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাসদ, বিকল্পধারা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের অংশ নেওয়ার কথা। কাল বীরাঙ্গনাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এদিন মুক্ত আলোচনা করবেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।

No comments

Powered by Blogger.