প্রস্তাবিত বাজেট ও বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসন প্রসঙ্গে by ডা. এম এ করীম
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ ধরা হয়েছে আট হাজার ২৬৭ কোটি টাকা, যা মোট উন্নয়ন বাজেটের ১৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে শুধু বিদ্যুৎ খাতেই উন্নয়ন বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে সাত হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা, যা সংশোধিত আকারে পাঁচ হাজার ৯৮২ কোটি
টাকা। বিদ্যুতের উন্নয়নে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে। বিদ্যুৎ সমস্যা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে এবং এ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে উৎপাদন না বাড়িয়ে সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নেই। কারণ চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।
এ দেশের সর্বত্রই শোনা যায়_নেই আর নেই। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, সার নেই, বিনিয়োগ নেই_তাই নেই কর্মসংস্থান। এই 'নেই' সমস্যা দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যার কারণে বর্তমানে নতুন কলকারখানা স্থাপন তো হচ্ছেই না, পুরনোগুলো চালু রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকটে অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন, কারখানাগুলো বন্ধ হতে চলেছে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারায়। ইতিমধ্যে দেশের প্রধান তিনটি সার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুতের অভাবে। অন্যান্য শিল্প-কারখানায়ও উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। চলমান এ বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিভিন্ন পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকে না। এখন গরমের মৌসুম। সারা দেশে ব্যাপক লোডশেডিং। দিনে লোডশেডিং তো আছেই, এমনকি রাতেও লোডশেডিং হচ্ছে। নানা কারণে গত কয়েক দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট কমেছে। বিদ্যুতের চাহিদা নিয়ে সরকারও সার্বিক পরিসংখ্যান দিচ্ছে না। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে মিলছে না প্রকৃত বিদ্যুৎ-চাহিদা। দেশে বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা হচ্ছে চার হাজার ৭০০ থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট (এটা পিডিবির পরিসংখ্যান) এবং দৈনিক লোডশেডিং হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট। কিন্তু বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানিগুলোর পরিসংখ্যান হচ্ছে দৈনিক চাহিদা প্রায় সাত হাজার ও লোডশেডিং প্রায় দুই হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। সে মোতাবেক চাহিদা ও লোডশেডিংয়ের ফারাক থাকছে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট। এ বিষয়ে বিতরণ কম্পানিগুলো বলছে, পিডিবির ফোর্স লোডশেডিং, হলিডে স্টেগারিং, দোকান বন্ধের কর্মসূচির মতো বিষয়গুলোকে হিসাবে না এনে চাহিদা কম দেখাচ্ছে। তাতে বিদ্যুতের সঠিক চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে না। শুভংকরের ফাঁকি চলছে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেচ ব্যবস্থাপনা ও শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সরকার যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলছে, তা যদি আমরা আমলে নিই তাহলে দেখা যায়, সরকার দাবি করেছে এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। গত বছরের এপ্রিলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন চার হাজার ১৩৯ মেগাওয়াট। আর এক বছরে যদি উৎপাদন হয় চার হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, তাহলে নতুন যোগ হওয়া এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের হিসাব মেলাতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। সরকার যে একবারে চেষ্টা করছে না তা-ও বলা যাবে না। দুই সপ্তাহ আগে কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর ফলে যে পরিমাণ উৎপাদন বেড়েছে, তার চেয়েও বেশি উৎপাদন কমেছে বেশ কিছু কেন্দ্রের (পুরনো মেশিনগুলোর) রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যবস্থাপনার কারণে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কাপ্তাই ও রাউজানে চারটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত করার পেছনে সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও এর সুফল পাচ্ছে না জনগণ। অনেকে অভিযোগ করেন, মেরামত কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় ও ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় মেরামত করতে সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। সরকার গত এপ্রিলে এক হিসাবে দেখায় যে শুধু গ্যাসের অপ্রতুলতার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৪৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। উল্লেখ্য, দিন দিন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। গ্রীষ্মের কারণে তো বটেই। এপ্রিল মাসের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ১০ দিন আগে যে ঘাটতি ছিল ১০ দিন পর তা বেড়েছে প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট। সেচব্যবস্থার কারণেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। কৃষকরা সেচের জন্য বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের দাবিতে কৃষকরা আন্দোলনে নেমেছেন। বিদ্যুতের বর্তমান সংকট উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হলেও এর মূলে রয়েছে সরকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অচলাবস্থা। উচ্চমূল্যের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত দুই বছরে যতটা বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি উৎপাদন কমেছে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। এর কারণ হিসেবে গ্যাসস্বল্পতার কারণের কথা সরকার বলেছে। শুধু গ্যাস ও মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মোট এক হাজার ৭১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে নতুন নতুন রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমরা কী দেখছি? সেগুলো উৎপাদনে যেতে পারছে না। পত্রিকায় দেখলাম, ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ছয়টি নতুন ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল তথা কুইক রেন্টালভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। শোনা যায়, সরকার সামিট গ্রুপকে শুধু এক হাজার ৬৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাতটি পাওয়ার প্লান্টের কাজ দিয়েছে। অর্থাৎ কিনা উৎপাদনের ৫৭ শতাংশ ছেড়ে দেওয়ায় বিদ্যুৎ খাত হোঁচটই খাচ্ছে না, রীতিমতো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। কবে এ বিপর্যয় থেকে সরকার উদ্ধার পাবে, তা ভবিতব্য। আগেই বলেছি, চলমান বিদ্যুৎ সংকটের জন্য সেচব্যবস্থা, শিল্প-কারখানার উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। যদিও সমস্যার অগ্রাধিকারে (সরকারের) বিদ্যুৎ শীর্ষে আছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সরকারের কোনো উদ্যোগ কাজে আসছে বলে মনে হয় না। সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।
গত দুই বছরে এর কতটুকু সফল হলো আর কতটুকু বিফলে গেল, তা ভেবে দেখতে হবে। কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সে মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের অর্থনীতি বর্তমানে প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে এবং ক্রমেই আমদানির পরিমাণ বাড়ছে। দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা অন্যতম একটি প্রধান অন্তরায়। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের শিল্প-কারখানাসহ উৎপাদনসংশ্লিষ্ট সব খাতেই পড়ছে বিরূপ প্রভাব। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হচ্ছে বাধা। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি করা যাচ্ছে না। শুধু উৎপাদন কেন, যেকোনো খাতে অগ্রগতির ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় জ্বালানি বড় ধরনের সহায়ক শক্তি। কিন্তু এ খাত গতিশীল হচ্ছে না। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা শোনা যায়, তার সবই উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার কিংবা ফাঁকা প্রতিশ্রুতি। বর্তমান সরকার এ সংকট কাটিয়ে ওঠার গুরুত্ব অনুধাবন করে এ পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে আমি (দৈনিক কালের কণ্ঠে) এর আগে লিখেছিলাম। সে লেখার পুনরাবৃত্তি হয়তো হবে। তবুও আবার লিখছি। লিখছি, জ্বালানি জাতীয় কমিটির উদ্দেশে। বিজ্ঞ 'জাতীয় কমিটি' আমার বক্তব্য আমলে নিতেও পারে, নাও পারে। ২০১২ সালে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট। এ কথা মাথায় রেখে আমাদের 'স্বল্পমেয়াদি', 'মধ্যমেয়াদি' ও 'দীর্ঘমেয়াদি' পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ দেশে অনেক এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ ও গ্যাস মানুষের কাছে পেঁৗছায়নি।
বর্তমানে বিদ্যুতের যে সংকট, তাতে পেঁৗছাবে কি না সন্দেহ। অনেক পাহাড়ি দুর্গম এলাকা ও চরাঞ্চল রয়েছে, সেখানে বিদ্যুতের সংযোগ হয়নি। আর এসব অঞ্চলে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের বেশির ভাগই খেটেখাওয়া ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। তবে তাঁদের আবার সবারই দুই-চারটি গরু-ছাগল আছে বা পালনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। এ দিয়ে বায়োগ্যাস প্লান্ট চালু করা সম্ভব। বায়োগ্যাস বিশেষজ্ঞদের মতে, চারটি গরুর গোবর দিয়ে একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট চালু করা সম্ভব। গ্যাসসংযোগ বাড়লে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার কমবে। ফলে বৃক্ষনিধন বন্ধ হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে। পৃথিবীতে যেসব জ্বালানির উৎস আছে সেগুলোর মধ্যে কয়লা, পরমাণু বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, গ্যাস, বাতাস, সৌর বিদ্যুৎ, তেল ও বায়োগ্যাস অন্যতম। বায়োগ্যাসের সম্ভাবনা প্রচুর না হলেও কিছুটা আছে। সৌর বিদ্যুতের খরচ অনেক। তেল আমাদের নেই। কয়লা আমাদের আছে। কিন্তু এর উত্তোলন-পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক বেশ। তা ছাড়া স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর জন মেকারথি গবেষণা করে মতামত দিয়েছেন, কয়লা, তেল ও গ্যাস_এ বিকল্প পদ্ধতিগুলোর ওপর কিছু সময়ের জন্য নির্ভর করা যেতে পারে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের জন্য নয়। কারণ হিসেবে এর স্বল্পতা, জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া, কৃষিতে ভয়াবহ খারাপ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। আগেই বলেছি, গ্যাসভাণ্ডার দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী সাত বছরের মধ্যে বিশ্বের জ্বালানি তেলের মজুদ প্রায় ফুরিয়ে যাবে। এর বিপরীতে পরমাণু বিদ্যুতের খরচ, এর নিরাপত্তা, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষ জনশক্তি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন। ইদানীং জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু বিস্ফোরণে অনেকে ভীত হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, পরমাণু বিদ্যুতের খরচ কম, সঠিকভাবে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন সম্ভব। যে কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটেছে সে কারণ বাংলাদেশে প্রায়ই অনুপস্থিত।
নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে সে ত্রুটি দূর করা সম্ভব। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পরমাণু বিদ্যুতের ব্যাপারে বলিষ্ঠ মনোভাবের কথা এখানে পুনরায় ব্যক্ত করে আমার লেখার ইতি টানব। তিনি সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত পাঁচ জাতির বাণিজ্যিক সম্মেলন শেষে দেশে ফিরে বলেছেন, 'জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু স্থাপনার বিস্ফোরণে ভীত নয় ভারত।' তিনি আরো বলেন, 'জাপানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এখন সবার মধ্যেই আতঙ্ক কাজ করছে। তবে যদি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা হয় এবং বিদ্যুৎ খাতে কয়লা বা অন্য কোনো উপকরণ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, পরমাণু জ্বালানির বিকল্প নেই।' আমরাও বলতে চাই, বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য পরমাণু বিদ্যুতের বিকল্প চিন্তা করা শুধু সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও
বীর মুক্তিযোদ্ধা
এ দেশের সর্বত্রই শোনা যায়_নেই আর নেই। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, সার নেই, বিনিয়োগ নেই_তাই নেই কর্মসংস্থান। এই 'নেই' সমস্যা দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যার কারণে বর্তমানে নতুন কলকারখানা স্থাপন তো হচ্ছেই না, পুরনোগুলো চালু রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকটে অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন, কারখানাগুলো বন্ধ হতে চলেছে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারায়। ইতিমধ্যে দেশের প্রধান তিনটি সার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুতের অভাবে। অন্যান্য শিল্প-কারখানায়ও উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। চলমান এ বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিভিন্ন পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকে না। এখন গরমের মৌসুম। সারা দেশে ব্যাপক লোডশেডিং। দিনে লোডশেডিং তো আছেই, এমনকি রাতেও লোডশেডিং হচ্ছে। নানা কারণে গত কয়েক দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট কমেছে। বিদ্যুতের চাহিদা নিয়ে সরকারও সার্বিক পরিসংখ্যান দিচ্ছে না। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে মিলছে না প্রকৃত বিদ্যুৎ-চাহিদা। দেশে বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা হচ্ছে চার হাজার ৭০০ থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট (এটা পিডিবির পরিসংখ্যান) এবং দৈনিক লোডশেডিং হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট। কিন্তু বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানিগুলোর পরিসংখ্যান হচ্ছে দৈনিক চাহিদা প্রায় সাত হাজার ও লোডশেডিং প্রায় দুই হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। সে মোতাবেক চাহিদা ও লোডশেডিংয়ের ফারাক থাকছে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট। এ বিষয়ে বিতরণ কম্পানিগুলো বলছে, পিডিবির ফোর্স লোডশেডিং, হলিডে স্টেগারিং, দোকান বন্ধের কর্মসূচির মতো বিষয়গুলোকে হিসাবে না এনে চাহিদা কম দেখাচ্ছে। তাতে বিদ্যুতের সঠিক চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে না। শুভংকরের ফাঁকি চলছে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেচ ব্যবস্থাপনা ও শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সরকার যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলছে, তা যদি আমরা আমলে নিই তাহলে দেখা যায়, সরকার দাবি করেছে এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। গত বছরের এপ্রিলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন চার হাজার ১৩৯ মেগাওয়াট। আর এক বছরে যদি উৎপাদন হয় চার হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, তাহলে নতুন যোগ হওয়া এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের হিসাব মেলাতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। সরকার যে একবারে চেষ্টা করছে না তা-ও বলা যাবে না। দুই সপ্তাহ আগে কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর ফলে যে পরিমাণ উৎপাদন বেড়েছে, তার চেয়েও বেশি উৎপাদন কমেছে বেশ কিছু কেন্দ্রের (পুরনো মেশিনগুলোর) রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যবস্থাপনার কারণে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কাপ্তাই ও রাউজানে চারটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত করার পেছনে সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও এর সুফল পাচ্ছে না জনগণ। অনেকে অভিযোগ করেন, মেরামত কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় ও ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় মেরামত করতে সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। সরকার গত এপ্রিলে এক হিসাবে দেখায় যে শুধু গ্যাসের অপ্রতুলতার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৪৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। উল্লেখ্য, দিন দিন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। গ্রীষ্মের কারণে তো বটেই। এপ্রিল মাসের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ১০ দিন আগে যে ঘাটতি ছিল ১০ দিন পর তা বেড়েছে প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট। সেচব্যবস্থার কারণেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। কৃষকরা সেচের জন্য বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের দাবিতে কৃষকরা আন্দোলনে নেমেছেন। বিদ্যুতের বর্তমান সংকট উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হলেও এর মূলে রয়েছে সরকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অচলাবস্থা। উচ্চমূল্যের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত দুই বছরে যতটা বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি উৎপাদন কমেছে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। এর কারণ হিসেবে গ্যাসস্বল্পতার কারণের কথা সরকার বলেছে। শুধু গ্যাস ও মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মোট এক হাজার ৭১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে নতুন নতুন রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমরা কী দেখছি? সেগুলো উৎপাদনে যেতে পারছে না। পত্রিকায় দেখলাম, ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ছয়টি নতুন ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল তথা কুইক রেন্টালভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। শোনা যায়, সরকার সামিট গ্রুপকে শুধু এক হাজার ৬৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাতটি পাওয়ার প্লান্টের কাজ দিয়েছে। অর্থাৎ কিনা উৎপাদনের ৫৭ শতাংশ ছেড়ে দেওয়ায় বিদ্যুৎ খাত হোঁচটই খাচ্ছে না, রীতিমতো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। কবে এ বিপর্যয় থেকে সরকার উদ্ধার পাবে, তা ভবিতব্য। আগেই বলেছি, চলমান বিদ্যুৎ সংকটের জন্য সেচব্যবস্থা, শিল্প-কারখানার উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। যদিও সমস্যার অগ্রাধিকারে (সরকারের) বিদ্যুৎ শীর্ষে আছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সরকারের কোনো উদ্যোগ কাজে আসছে বলে মনে হয় না। সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।
গত দুই বছরে এর কতটুকু সফল হলো আর কতটুকু বিফলে গেল, তা ভেবে দেখতে হবে। কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সে মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের অর্থনীতি বর্তমানে প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে এবং ক্রমেই আমদানির পরিমাণ বাড়ছে। দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা অন্যতম একটি প্রধান অন্তরায়। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের শিল্প-কারখানাসহ উৎপাদনসংশ্লিষ্ট সব খাতেই পড়ছে বিরূপ প্রভাব। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হচ্ছে বাধা। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি করা যাচ্ছে না। শুধু উৎপাদন কেন, যেকোনো খাতে অগ্রগতির ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় জ্বালানি বড় ধরনের সহায়ক শক্তি। কিন্তু এ খাত গতিশীল হচ্ছে না। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা শোনা যায়, তার সবই উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার কিংবা ফাঁকা প্রতিশ্রুতি। বর্তমান সরকার এ সংকট কাটিয়ে ওঠার গুরুত্ব অনুধাবন করে এ পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে আমি (দৈনিক কালের কণ্ঠে) এর আগে লিখেছিলাম। সে লেখার পুনরাবৃত্তি হয়তো হবে। তবুও আবার লিখছি। লিখছি, জ্বালানি জাতীয় কমিটির উদ্দেশে। বিজ্ঞ 'জাতীয় কমিটি' আমার বক্তব্য আমলে নিতেও পারে, নাও পারে। ২০১২ সালে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট। এ কথা মাথায় রেখে আমাদের 'স্বল্পমেয়াদি', 'মধ্যমেয়াদি' ও 'দীর্ঘমেয়াদি' পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ দেশে অনেক এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ ও গ্যাস মানুষের কাছে পেঁৗছায়নি।
বর্তমানে বিদ্যুতের যে সংকট, তাতে পেঁৗছাবে কি না সন্দেহ। অনেক পাহাড়ি দুর্গম এলাকা ও চরাঞ্চল রয়েছে, সেখানে বিদ্যুতের সংযোগ হয়নি। আর এসব অঞ্চলে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের বেশির ভাগই খেটেখাওয়া ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। তবে তাঁদের আবার সবারই দুই-চারটি গরু-ছাগল আছে বা পালনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। এ দিয়ে বায়োগ্যাস প্লান্ট চালু করা সম্ভব। বায়োগ্যাস বিশেষজ্ঞদের মতে, চারটি গরুর গোবর দিয়ে একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট চালু করা সম্ভব। গ্যাসসংযোগ বাড়লে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার কমবে। ফলে বৃক্ষনিধন বন্ধ হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে। পৃথিবীতে যেসব জ্বালানির উৎস আছে সেগুলোর মধ্যে কয়লা, পরমাণু বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, গ্যাস, বাতাস, সৌর বিদ্যুৎ, তেল ও বায়োগ্যাস অন্যতম। বায়োগ্যাসের সম্ভাবনা প্রচুর না হলেও কিছুটা আছে। সৌর বিদ্যুতের খরচ অনেক। তেল আমাদের নেই। কয়লা আমাদের আছে। কিন্তু এর উত্তোলন-পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক বেশ। তা ছাড়া স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর জন মেকারথি গবেষণা করে মতামত দিয়েছেন, কয়লা, তেল ও গ্যাস_এ বিকল্প পদ্ধতিগুলোর ওপর কিছু সময়ের জন্য নির্ভর করা যেতে পারে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের জন্য নয়। কারণ হিসেবে এর স্বল্পতা, জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া, কৃষিতে ভয়াবহ খারাপ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। আগেই বলেছি, গ্যাসভাণ্ডার দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী সাত বছরের মধ্যে বিশ্বের জ্বালানি তেলের মজুদ প্রায় ফুরিয়ে যাবে। এর বিপরীতে পরমাণু বিদ্যুতের খরচ, এর নিরাপত্তা, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষ জনশক্তি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন। ইদানীং জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু বিস্ফোরণে অনেকে ভীত হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, পরমাণু বিদ্যুতের খরচ কম, সঠিকভাবে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন সম্ভব। যে কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটেছে সে কারণ বাংলাদেশে প্রায়ই অনুপস্থিত।
নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে সে ত্রুটি দূর করা সম্ভব। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পরমাণু বিদ্যুতের ব্যাপারে বলিষ্ঠ মনোভাবের কথা এখানে পুনরায় ব্যক্ত করে আমার লেখার ইতি টানব। তিনি সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত পাঁচ জাতির বাণিজ্যিক সম্মেলন শেষে দেশে ফিরে বলেছেন, 'জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু স্থাপনার বিস্ফোরণে ভীত নয় ভারত।' তিনি আরো বলেন, 'জাপানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এখন সবার মধ্যেই আতঙ্ক কাজ করছে। তবে যদি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা হয় এবং বিদ্যুৎ খাতে কয়লা বা অন্য কোনো উপকরণ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, পরমাণু জ্বালানির বিকল্প নেই।' আমরাও বলতে চাই, বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য পরমাণু বিদ্যুতের বিকল্প চিন্তা করা শুধু সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও
বীর মুক্তিযোদ্ধা
No comments