বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩১৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ দেলোয়ার হোসেন, বীর বিক্রম ঘরের বাঁধন ছিন্ন করে যুদ্ধে যান তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেলোয়ার হোসেন নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। তাঁর অস্ত্র চালনার এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে। ভাবলেন দেশের বিপদে এটা কাজে লাগাতে হবে।


অল্প কিছুদিন হয় বিয়ে করেছেন। স্ত্রীকে বললেন, দেশের এই দুঃসময়ে তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেন না। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। তারপর একদিন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মায়ের কাছে বিদায় চাইতে গেলেন। কিন্তু মা তাঁকে বিদায় দিলেন না।
দেলোয়ার হোসেন মাকে বোঝালেন, ‘ভিনদেশিরা আমাদের দেশে আক্রমণ করেছে। নির্বিচারে মানুষ মারছে। তারা অনেক মায়ের বুক খালি করেছে। দেশের দুঃসময়ে আমি বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। এখন আমার মতো প্রশিক্ষিত মানুষের বেশি দেশের প্রয়োজন।’
এর পরও মা তাঁকে বিদায় দেন না। সেদিন আর তাঁর বাড়ি থেকে যাওয়া হলো না। কয়েক দিন পর (এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে) মায়ের কাছ থেকে প্রায় জোর করেই বিদায় নিয়ে চলে যান ভারতে।
ভারতে গিয়ে দেলোয়ার হোসেন দেখা করেন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে কয়েক দিন থাকেন। পরে ১৮ জনের একটি দল গঠন করে সেই দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয় তাঁর ওপর। তাঁদের দেশের ভেতরে পাঠানো হয় হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে গেরিলাযুদ্ধ করার জন্য।
দেলোয়ার হোসেন তাঁর দল নিয়ে প্রথমে কিছুদিন কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো কয়েকটি গেরিলা অপারেশন করেন। এরপর কুমিল্লা অঞ্চলে অবস্থান করা তাঁদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়লে তাঁরা চলে যান নোয়াখালীর মুক্ত এলাকায়। মুক্ত এলাকায় অবস্থান করে তাঁরা মাঝেমধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালাতে থাকেন। আক্রমণ চালিয়েই তাঁরা নিরাপদ স্থানে সরে যেতেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের খুঁজে পেত না। তাঁদের এসব আক্রমণে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পরে সেক্টর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে জুলাই মাসে দেলোয়ার হোসেন তাঁর দল নিয়ে চলে আসেন চাঁদপুর জেলার মতলবে। সেখানে অবস্থানকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের গতিবিধি টের পেয়ে যায়। ১৭ জুলাই পাকিস্তানি সেনাদের একটি বড় দল তাঁদের আক্রমণ করে। দেলোয়ার হোসেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ মোকাবিলা করছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁর বুকে গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। সহযোদ্ধারা পরে তাঁর মরদেহ নৌকাযোগে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
দেলোয়ার হোসেন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে। কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান)। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য দেলোয়ার হোসেনকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৬৮।
শহীদ দেলোয়ার হোসেনের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দড়িভেলানগর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম জায়েদ আলী মুন্সি, মা মাছুমা খাতুন, স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। তাঁর কোনো ছেলেমেয়ে নেই। শহীদ দেলোয়ার হোসেনের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলোর বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি এম মনিরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.