শ্রদ্ধাঞ্জলি-যেভাবে তিনি মাদার তেরেসা
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যুগোস্লাভিয়ার মিশনারিরা ধর্ম প্রচার ও সেবাধর্মের ব্রত নিয়ে কলকাতায় আসেন। তাঁদের মিশনের নাম ছিল ‘বেঙ্গল মিশন ফিল্ড’। ১৯২৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর একজন জেসুইট বা মিশনারি নেতা বেঙ্গল মিশন ফিল্ড সম্পর্কে যুগোস্লাভিয়ায় একটি উৎসাহভরা চিঠি লেখেন।
স্কুলের যেসব ছাত্রছাত্রী ধর্মীয় ও সেবা সংগঠন সোভালিটির সদস্য, চিঠিটি তাদের পড়ে শোনানো হয়। সেখানে লেখা থাকত কেমন করে মিশনারিরা পৃথিবীর দারিদ্র্যপীড়িত বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুধার্ত ও অসুস্থ মাুনষের সেবা করছেন। কীভাবে তাঁরা হাসি ফোটাচ্ছেন দুঃখী মানুষের মুখে। আর্তমানবতার সেবায় মিশনারিরা কীভাবে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন ইত্যাদি। এসব বিবরণ শুনে শুনে ১৫ বছরের কিশোরী অ্যাগনেস ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হন এবং তিনি বেঙ্গল মিশনের সদস্য হয়ে ভারতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তারপর একদিন সত্যি সত্যি তাঁর স্বপ্ন সফল হলো। ১৯২৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে অ্যাগনেস শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় আসেন। তাঁর পুরো নাম অ্যাগনেস গোনঝে বাইয়াঝিউ। জন্ম ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট, দক্ষিণ যুগোস্লাভিয়ার স্কপিয়েত শহরে। তাঁর বাবা ছিলেন বহু ভাষাবিদ নিকোলাস বাইয়াঝিউ, মায়ের নাম ড্রানা বাইয়াঝিউ।
অ্যাগনেস ভারতে রওনা দেওয়ার সময় শুধু সুখময় জীবনই ফেলে এলেন না, নিজের পৈতৃক নামটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে এলেন। মিশনারি জীবন শুরু করার সময় মহামান্য পোপের অনুমতিক্রমে তিনি নতুন নাম গ্রহণ করেন ‘তেরেসা’, পরে যা সবার মুখে মুখে হয়েছে ‘মাদার তেরেসা’। তেরেসা প্রথমে শিক্ষকতা শুরু করেন এন্টালি সেন্ট মেরি স্কুলে। এই স্কুলে ১৮ বছর শিক্ষকতার পর তিনি বদলি হয়ে আসেন লরেটো স্কুলে। এখানে আসার পর তাঁর জীবনে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। লরেটো স্কুলের পাশেই ছিল মতিঝিল বস্তি, যেখানে কয়েক হাজার ছিন্নমূল ও ক্ষুধার্ত মানুষ বসবাস করত। স্কুল ছুটির পর কিংবা টিফিনের ফাঁকে কলা, রুটি, বিস্কুট হাতে তিনি প্রায়ই ছুটে আসতেন এই বস্তিতে। তিনি এসব খাবার বস্তির কঙ্কালসার ও উলঙ্গ ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিতেন। খাবার পেয়ে তারা ভীষণ খুশি হতো। তেরেসাকে দেখেই তারা দৌড়ে এসে ঘিরে ধরত, তাঁকে মা মা বলে ডাকত। এভাবেই তিনি একদিন হয়ে গেলেন সবার মা।
মতিঝিল বস্তির দুস্থ মানুষকে সাহায্য করার কাজটি যেন তাঁর কাছে নেশার মতো হয়ে গেল। আর্তমানবতার সেবা করার জন্যই যেন তাঁর জন্ম হয়েছে। আজীবন এটাই তিনি করতে চান। এরপর সত্যি সত্যি তিনি সম্পূর্ণভাবে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করার সংকল্পে লরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন।
তিনি যখন লরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন, তখন তাঁর হাতে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। এ রকম নিঃস্ব অবস্থাতেই তিনি স্কুলের সাজানো ফুলের বাগান, স্নিগ্ধ পরিবেশ, সুখময় নিশ্চিন্ত জীবন ফেলে এসে আশ্রয় নিলেন শিয়ালদহ রেলস্টেশন-সংলগ্ন এক পুরোনো ভাঙাবাড়িতে। শিয়ালদহের এই ভাঙাবাড়িতেই তিনি কয়েকটি অনাথ শিশুকে নিয়ে শুরু করলেন তাঁর সেবাকর্ম। পরে শিয়ালদহের পার্শ্ববর্তী বস্তিতে একটি স্কুল খুললেন। মুমূর্ষুদের সেবা করার জন্য ১৯৫০ সালে কালীঘাটের মন্দিরের পাশে প্রতিষ্ঠা করলেন সেবাশ্রম ‘নির্মল হূদয়’। তিনি ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করেন।
তেরেসা আগেই নার্সের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এবার সেই শিক্ষাই কাজে লাগালেন সেবাশ্রমে। এভাবেই ১৯৫০ সালে শুরু হয় তাঁর ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’র কাজ। ধীরে ধীরে তাঁর কার্যক্রম বাড়তে লাগল। কলকাতা শহরেই প্রতিষ্ঠিত হলো আরও বেশ কয়েকটি সেবাশ্রম। জগদীশচন্দ্র বসু রোডে স্থাপিত হলো অনাথ শিশুদের জন্য সেবাশ্রম ‘নির্মলা শিশুভবন’। কলকাতার এই জগদীশচন্দ্র বসু রোডেই অবস্থিত তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রধান কার্যালয়।
সারা ভারতে অগণিত কুষ্ঠরোগী দেখে তেরেসার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ভাবেন, এদের জন্যও কিছু করা দরকার। অবশেষে ১৯৫৮ সালে টিটাগড় রেললাইনের ধারে প্রতিষ্ঠা করেন কুষ্ঠ আশ্রম ‘গান্ধীজী প্রেমনিবাস’। এ ছাড়া ‘পোপ জন শান্তি পুরস্কার’স্বরূপ তিনি যে টাকা পেয়েছিলেন, তা দিয়ে আসানসোলের কাছে প্রতিষ্ঠা করেন কুষ্ঠরোগীদের জন্য একটি শহর ‘শান্তিনগর’।
শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত নয়, তেরেসার সেবাকর্ম ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর সব মহাদেশে। লরেটো স্কুল ছেড়ে আসার সময় যাঁর হাতে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা, সেই তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রতিদিনই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সেবাকাজের জন্য খরচ করে ১২ লাখ টাকা। লঙ্গরখানাগুলোতে প্রতিদিন আহার করে ৬০ হাজার নিরন্ন মানুষ। ১৯৯৬ সালের এক হিসাবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এ পর্যন্ত আশ্রয় পেয়েছে চৌদ্দ হাজার ছিন্নমূল মানুষ। চার হাজার শিশুর জন্য রয়েছে সত্তরটি অনাথ আশ্রম। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে ১৫০টি বিদ্যালয়। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় ৭০০ ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র।
বিশ্বব্যাপী সেবামূলক কাজের জন্য মাদার তেরেসা বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৭৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ভারত সরকার কর্তৃক ভারতরত্ব, দেশিকোত্তমসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। মানবসেবার দৃঢ় মানসিকতা ও অদম্য মনোবল থাকলে রিক্ত হস্তেও যে বিশ্ব জয় করা যায়, মাদার তেরেসা তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের প্রতিও মাদার তেরেসার ছিল ভীষণ টান। তিনি তাঁর সেবাধর্ম পালন করতে বাংলাদেশে মোট দুবার এসেছিলেন।
আজ ৫ সেপ্টেম্বর মাদার তেরেসার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের আজকের এই দিনে বিশ্ববাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চিরবিদায়ের পথে যাত্রা করেন। মৃত্যুবার্ষিকীর এই দিনে তাঁর প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সুরঞ্জিত বৈদ্য
No comments