সদরে অন্দরে-সার্টিফিকেটই যদি হয় লেখাপড়ার উদ্দেশ্য by মোস্তফা হোসেইন

স্কুল, কলেজ, এমনি করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ডিঙিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মা-বাবা তৃপ্তি বোধ করছেন সন্তানের ফল দেখে। স্বপ্নগুলোও বাড়তে থাকে সন্তানের ক্লাস ডিঙিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। শুরু থেকে স্কুলে ভর্তির ঝক্কি, ভর্তির পর প্রাইভেট টিউটর, কোচিং, মায়ের দৌড়াদৌড়ির মতো অসংখ্য পরিশ্রম নিমেষেই ভুলে যান সন্তানের ভালো ফল দেখে।


প্রিয় সন্তান তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করেছে_এই ভেবে তাঁদের তৃপ্তি পাওয়াটা একান্তই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে_ভালো ফল লাভকারী সেই সন্তানটি প্রকৃত শিক্ষা পেয়েছে কতটুকু? মুখস্থবিদ্যা উগরে দিয়ে পরীক্ষার খাতায় ভালো নম্বর লেখানোর সুযোগ লাভ আর লেখাপড়া শিখে প্রকৃত মানুষ হওয়ার মধ্যে যে বড় তফাৎ রয়েছে। আর এ কারণেই একসময় কোনো কোনো অভিভাবক টের পেতে থাকেন, তাঁর সন্তানটি পরিপূর্ণ শিক্ষিত হতে পারেনি।
এমন যেসব ছেলেমেয়ে, তাদের অভিভাবক ও নিকটজনের কাছে তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে_আসলে শিক্ষা যদি প্রকৃতই শিক্ষা হতো, যদি সার্টিফিকেটই একমাত্র শিক্ষার উদ্দেশ্য না হতো তাহলে হয়তো তাদের সন্তানটিও ভালো মানুষ হওয়ার সুযোগ পেত। তাঁদেরও নিরাপদ বার্ধক্য কেটে যেত।
তাত্তি্বক বিশ্লেষণ হতে পারে অনেক। তার মধ্যে শিক্ষা পরিবেশ আসতে পারে সবার আগে। অন্তত আমার দৃষ্টিতে তাই মনে হয়। যে পরিবেশে শিশুর বেড়ে ওঠা সেই পরিবেশের শিক্ষা কোনো শিশুর ওপর প্রভাবিত হবে_এটা বাস্তব সত্য। সেই সত্যটাই আমাদের চোখে পড়ে আইডিয়াল স্কুলের এক শিক্ষার্থীর প্রতি চোখ ফেরালে। একটি শিশুকে একজন শিক্ষক শারীরিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পঙ্গু হাসপাতালে শিক্ষাসচিবকে মনের তাগাদায় যেতে হয়েছে। নির্দেশ দিতে হয়েছে শিশুটির সব চিকিৎসাব্যয় যাতে স্কুল থেকে বহন করা হয়। এটা গত সপ্তাহের কথা। রাজধানী ঢাকার নামি স্কুলগুলোর মধ্যে অবশ্যই প্রথম দিকের স্কুল এটি। সেখানে বাচ্চা ভর্তি করানোর জন্য যে কী ভয়াবহ প্রতিযোগিতা তা সব মা-বাবাই জানেন। অন্তত যে মা-বাবাকে সন্তানের ভর্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে হয়েছে, সেই মা-বাবা হাড়ে হাড়ে টের পান কতটা ধকল সইতে হয়েছে তাঁদের সন্তানের আর কতটাই বা তাঁদের নিজেদের। সেখানে লাখ টাকা ডোনেশন দিয়ে ভর্তি হতে পারাটাও ভাগ্যের বলে মনে করেন কোনো কোনো অভিভাবক। এমন একটি প্রতিষ্ঠানে যদি শিক্ষার পরিবেশ বলতে এমন থাকে তাহলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের স্কুলগুলোর অবস্থা যে কী তা সহজেই অনুমান করা যায়।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন, দেশের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো অন্তত এমন দুর্নাম থেকে রেহাই পেয়েছে। কিন্তু কিছু স্কুল আছে, যেখানে শিক্ষা পরিবেশ শুধু বিঘি্নতই নয়, রীতিমতো দুর্বিষহ।
একটি অভিজাত এলাকার বিখ্যাত একটি স্কুলের শিক্ষককে শাস্তি পেতে হয়েছে সম্প্রতি। অনেক বিদেশি শিক্ষার্থীও সেখানে ভর্তি হয় লেখাপড়া করার জন্য। সেই স্কুলেই একজন শিক্ষিকাকে শাস্তিস্বরূপ শিক্ষার্থীদের সামনে খালি পায়ে সারা স্কুল প্রদক্ষিণ করতে হয়েছে সম্প্রতি। এই শাস্তি দিয়েছেন ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক নিজে। ওই শিক্ষকের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। প্রথম পথ হচ্ছে_তাৎক্ষণিক সেই স্কুল থেকে বিদায় নেওয়া; দ্বিতীয় পথ হচ্ছে_মালিক মহিলার নির্দেশ অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করা। সেই স্কুলে শিক্ষকের সঙ্গে মালিকের বাজে আচরণের মাত্রা কখনো কখনো অভিভাবক পর্যায়েও চলে যায়। যার পরিণতিতে ওই স্কুলের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, যে শিক্ষার্থীটি দেখল তাদের শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকাকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে ন্যক্কারজনকভাবে, তখন সেই শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে তা কি কেউ চিন্তা করেছেন?
একজন পরিশ্রমী মানুষকে শিক্ষাদানে নিয়োজিত হওয়া দরকার। যাঁর মধ্যে শিক্ষা বিষয়ে অনুসন্ধানী মন আছে, তিনিই আসলে শিক্ষক হিসেবে ভালো করতে পারেন। তিনি যে শিক্ষা দেবেন তা হতে পারে লক্ষণীয় এবং অনুকরণীয়। এ মুহূর্তে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা মনে আসছে। কথাটা শোনা শ্রদ্ধেয় সম্পাদক আবেদ খানের মুখ থেকে। শিক্ষক হিসেবে অধ্যবসায়ী এবং একাগ্রতার প্রসংগ আনতে গিয়ে তিনি বলেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা। বলেন হৈমন্তী পড়াতে পড়াতে তিনি তরুণদের পাঠস্পৃহাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে চেয়েছেন। একজন শিক্ষক যখন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হন, যখন তাঁর মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকে, তখন তিনি তাঁর শিক্ষার্থীকে নিজ অঙ্গন থেকে বিশ্ব অঙ্গনে প্রবেশ করাতে পারেন। সে রকম শিক্ষক যদি আমাদের স্কুল ও কলেজগুলোতে পাওয়া যেত তাহলে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা আমাদের এখানে অনেক বেড়ে যেত।
একজন শিক্ষার্থীকে জীবন গড়ার দীক্ষা নিতে হবে শৈশব থেকে। এখন যেন সেই শৈশবই বিদায় নিয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। ভালো গ্রেড-ফল পাওয়াই যেন মূল উদ্দেশ্য। মা-বাবা ওঠেপড়ে লাগেন, তাঁর সন্তানকে অবশ্যই গোল্ডেন এ প্লাস পেতে হবে। ক্লাসে প্রথম হতে হবে। ফলে শিক্ষার্থী হয়ে পড়ে মেশিনের মতো।
নীতি-নিয়ম, প্রচলিত আইনও শিক্ষা পরিবেশ সংরক্ষণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব চিন্তাচেতনার মাধ্যমে শিক্ষা পরিবেশ রচনার কাজ করতে পারে। সেখানে মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকার মতো কোনো কাজ যদি হয় তাহলে শিক্ষা পরিবেশ বিঘি্নত হতে পারে। শিক্ষার্থীর জীবনে তার কুপ্রভাবও পড়তে পারে।
এই লেখার আগে কুমিল্লা শশিদল আবু তাহের কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল কাইউম আলাপকালে জানালেন অভিভাবকদের মানসিকতা সম্পর্কে। বললেন তাঁর কলেজ, বুড়িচং উপজেলার সোনার বাংলা কলেজ এবং কুমিল্লার কমার্স কলেজের নামে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা শিক্ষা বোর্ড কুমিল্লায় অভিযোগের সুরে একটি আবেদন করেছেন। সেই কর্মকর্তা কলেজ তিনটির তীব্র সমালোচনা করেছেন তাদের একটি নীতিমালার কারণে। তিনটি কলেজই কোনো বিবাহিত শিক্ষার্থীকে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ দেয় না। উচ্চপদস্থ ওই সরকারি কর্মকর্তার শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগের মূল কথা হচ্ছে এটা গর্হিত কাজ। সংবাদ আকারে প্রকাশের পর দেখা গেল একটি দৈনিক পত্রিকায় আফিয়া বিনতে মরিয়ম নামে একজন পাঠক কলেজগুলোর বিরুদ্ধে তাঁর অভিমত জানিয়েছেন। তাঁর মতে, ওই কলেজগুলো মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার কাজটি করেছে। পত্রিকার চিঠি লেখক আফিয়া বিনতে মরিয়ম ভুল করেছেন কি না সেই বিচারে না গিয়েও বলা যায়, একজন শিক্ষার্থীকে আইন মেনে চলার শিক্ষা দিতে হলে, এ ধরনের নির্দেশ দেওয়াই যেতে পারে। সরকারও বাল্য বিবাহকে নিরুৎসাহী করার জন্য বিবাহিত ছাত্রীকে উপবৃত্তি প্রদান থেকে বিরত থাকে। আর এ অবস্থার জন্য নিশ্চয়ই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা নয়। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীন এই তিনটি কলেজ শীর্ষ দশে থাকার গৌরব অর্জনকারী। তারা নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে। সোনার বাংলা ও আবু তাহের কলেজে প্রতি বৃহস্পতিবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বই পড়ার প্রতিযোগিতাও হয় সেসব কলেজে। ক্রীড়াক্ষেত্রেও তাদের অবস্থান বোর্ডের মধ্যে উদাহরণযোগ্য। বোধ করি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করে তারা। প্রশ্ন হচ্ছে_প্রকৃত শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনেও এমন অভিযোগকারী পাওয়া যায়, যাঁরা শিক্ষা পরিবেশকে প্রকারান্তরে বিঘি্নত করতে চান। প্রকৃত শিক্ষা লাভে শিক্ষা পরিবেশ অপরিহার্য একটি বিষয়। তা নিশ্চিত করতে না পারলে সার্টিফিকেট অর্জন হলেও প্রকৃত শিক্ষার অভাব ওই শিক্ষার্থীর জীবনকে অপূর্ণ রাখতে পারে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.