শ্রদ্ধাঞ্জলি-চরিত্র চিত্রণে নিবিষ্ট যে জন by মুস্তাফিজুর রহমান
এই গুণী শিল্পী তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় একুশে পদকসহ কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি। আগামীতে হুমায়ুন ফরীদি হয়তো মরণোত্তর একুশে পদক পেতে পারেন। তিনি যদি তার বেঁচে থাকাকালে কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতেন তাহলে তিনি কর্মের মূল্যায়নের আনন্দ উপভোগ করে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন ধ্যানধারণায় তুলে ধরার প্রেরণা লাভ করতেন এই তো মাত্র অল্প কিছুদিন আগে হুমায়ুন ফরীদি এসেছিলেন গাজী টেলিভিশনের অফিসে।
এসেই তার স্বভাবসুলভ বাচনভঙ্গি এবং উদ্ভাসিত হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন, 'মুস্তাফিজ ভাই, আপনার কথা মনে হলো তাই চলে এলাম।' সেদিন ফরীদির প্রাণবন্ত উপস্থিতি, নাটক সংক্রান্ত আলাপচারিতার সঙ্গে ওর প্রাণখোলা হাসি দেখে ভেবেছিলাম, হুমায়ুন ফরীদি আরও বহুদিন আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আমাদের নাট্য অঙ্গনকে তার অনুকরণীয় অভিনয়শৈলী প্রকরণ দিয়ে উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে পেঁৗছে দিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় আগামী প্রজন্মের জন্য খ্যাতির স্বর্ণশিখরে ওঠার উৎসাহ-উদ্দীপনার সোপান তৈরি করে দিয়ে যাবেন। সেদিন কথায় কথায় ফরীদি তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনের পথপরিক্রমায় মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র_ এই তিনটি ভিন্ন মাধ্যমের, যে মাধ্যমগুলো সরাসরি দর্শক চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে সেই মাধ্যমগুলো সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বহু ধরনের মতামত জ্ঞাপন করেছিলেন এবং বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নাটকের ইতিবাচক, নেতিবাচক দিক তুলে ধরে সামগ্রিক অর্থে নাটকের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন।
হুমায়ুন ফরীদিকে আশির দশকের শুরুতে প্রাজ্ঞ নাট্যকার প্রয়াত সেলিম আল দীনের 'ওহ্ দেবদূত' নাটকটি প্রযোজনার সুবাদে ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাই। ওই নাটকটিতে হুমায়ুন ফরীদি ব্যতিক্রমধর্মী খলনায়কের ভূমিকায় অন্যমাত্রার অভিনয় করে সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ছাপিয়ে দর্শকদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন। তার পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা, সেই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেকে উপস্থাপন করার প্রয়াস আমার দৃষ্টি কেড়েছিল। মঞ্চ থেকে টেলিভিশন নাটকে আসার সুবাদে হুমায়ুন ফরীদির মঞ্চের অভিজ্ঞতা তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে দর্শক-দৃষ্টি কাড়ার উদ্যম সৃষ্টি করেছে। ফরীদির অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে বড় গুণ ছিল নাটকের পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়ামাত্র সমগ্র নাটক সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে অবহিত হওয়া এবং তার করণীয় নাট্যাংশের সংলাপ দাঁড়ি-কমাসহ হুবহু মুখস্থ করা। যার ফলে অভিনয়কালে তাকে পরবর্তী সংলাপ কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি বরং পরবর্তী সংলাপ প্রক্ষেপণের সময় তার যথাযথ মৌখিক বা শারীরিক অভিব্যক্তি কী রকম হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে দেখেছি। সেই সময়ে যারা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন অত্যন্ত সৌন্দর্য সচেতন। কাকে ক্যামেরার কোন দিক থেকে আকর্ষণীয় দেখাবে_ এসব ভাবনায় মাঝেমধ্যে হয়তো অভিনয়ে কোনো ফাঁক থেকে যেত। কিন্তু হুমায়ুন ফরীদিকে আমি দেখেছি, নিজের চেহারার চিন্তা বাদ দিয়ে তার চরিত্র চিত্রণ নিয়ে নিবিষ্ট মনে চিন্তাভাবনা করছেন। এ কারণেই ফরীদি যে চরিত্রে অভিনয় করতেন সে চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যেতেন যে, টেলিভিশন দর্শকরা সেই চরিত্রের প্রশংসায় হয়ে উঠতেন পঞ্চমুখ।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, হুমায়ুন ফরীদি আশির দশকে আমার প্রযোজিত কয়েকটি ঈদের নাটক করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে একটি নাটকে তিনি গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। গৃহশিক্ষক তার পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু ছাত্রকে হাতেকলমে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন। একদিন গৃহশিক্ষক সেই শিশুটিকে মিরপুর চিড়িয়াখানায় ফেলে রেখে তাকে বাড়ি ফেরার প্রশিক্ষণ দিয়ে বাড়ি ফেরেন। এর পর সেই গৃহশিক্ষককে নিয়ে বিশাল হৈচৈ এবং ঝামেলা শেষে দেখা যায় শিশুটি গৃহশিক্ষকের প্রশিক্ষণ মতো বাড়ি ফিরেছে। সেই নাটকে গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে ফরীদি নিজের চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চুলে জবজবে করে নারিকেল তেল মেখে চুল পেছনে চ্যাপ্টা করে আঁচড়ে যে অদ্ভুত চুলের স্টাইল এবং পোশাক পরিকল্পনা করেছিলেন তা তার অভিনীত চরিত্রে একটি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল।
পরবর্তী ঈদের নাটকে গৃহশিক্ষক হুমায়ুন ফরীদি তার ছোট্ট শিশু ছাত্রটিকে প্রশিক্ষণ দেন বাড়িতে আগুন লাগলে কোন্ নম্বরে কীভাবে ফায়ার ব্রিগেডকে খবর দিতে হবে। সে অনুযায়ী ছোট্ট শিশুটি বিছানায় তেল ফেলে বাড়ির লেপ-তোশকে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং আগুনের ধোঁয়ায় বাড়িতে হুলস্থুল শুরু হলে শিশুটি গৃহশিক্ষকের দেওয়া ফোন নম্বর অনুযায়ী ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেয়। এই নাটকে বাড়ির ক্ষয়ক্ষতির চিন্তা বাদ দিয়ে, নিজের ছাত্রের ফায়ার ব্রিগেডের অফিসে ফোন করার সাফল্য দেখে গৃহশিক্ষক হুমায়ুন ফরীদির যে আনন্দের অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, তা প্রতিটি দর্শক মহানন্দে উপভোগ করেছিলেন।
হুমায়ুন ফরীদির টেলিভিশনে উত্তরণ মূলত বাংলাদেশ টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্রভিত্তিক সময়ে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকাই ছিল দর্শকদের নাটক প্রদর্শনের একমাত্র কেন্দ্র। সেই সময় সাপ্তাহিক নাটক মাসে চারটি এবং 'এ মাসের নাটক' হিসেবে প্রায় দু'ঘণ্টা ব্যাপ্তিকালীন একটি নাটক হতো। হুমায়ুন ফরীদিকে নিয়ে আমি যেসব নাটক করেছি তার বেশিরভাগই ছিল বিশাল ব্যাপ্তির এ মাসের নাটক।
এই মুহূর্তে ঈদের নাটক 'একদিন হঠাৎ', 'যার যা পছন্দ'সহ কয়েকটি নাটক যেমন_ 'ওহ্ দেবদূত', 'একটি সেতুর গল্প', 'সাত আসমানের সিঁড়ি' এবং রহস্যমানব মোবাশ্বের আলী সিরিজের তিনটি চমৎকার নাটকে হুমায়ুন ফরীদির অসাধারণ সুন্দর অভিনয়ের কথা মনে পড়ছে। আমার পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'শঙ্খনীল কারাগার'-এর ডাবিং সেটে একটি ছোট্ট ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটি দৃশ্যে রিকশাওয়ালার হাসি ছিল। ডাবিং সেটে উপস্থিত হুমায়ুন ফরীদি বললেন, রিকশাওয়ালার ওই হাসিটা আমি করব। ফরীদি একরকম জোর করেই ওই অংশটুকু কৌতুক করে হেঃ হেঃ হাসি দিয়ে ডাব করলেন। উল্লেখ্য, এই চলচ্চিত্রটিতে হুমায়ুন ফরীদি কোনো চরিত্রেই অভিনয় করেননি। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর দেখলাম রিকশাওয়ালার ওই হাসিটুকু দর্শকরা অত্যন্ত উপভোগ করেছেন। সেই সময়ে অর্থাৎ সত্তর-আশির দশকে মঞ্চ নাটকের জগৎ থেকে একঝাঁক নতুন সম্ভাবনাময় তরুণ মঞ্চশিল্পী এসে প্রবেশ করেছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকার সুনির্দিষ্ট চত্বরে নিজেদের মঞ্চের স্বল্প পরিসর থেকে সারাদেশের টিভি দর্শকের সামনে সম্পূূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপন করার জন্য। তখন নবীন- প্রবীণ সব ধরনের শিল্পীর যে পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের মেধা ও মননকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস ছিল, সে প্রয়াস সফল হতো শিল্পী, কলাকুশলী ও কারিগরি কুশলতার যৌথ উদ্যোগে। মঞ্চের সীমিত প্রেক্ষাপটের গণ্ডি থেকে কীভাবে নিজেকে দিনের পর দিন কঠোর সাধনার মাধ্যমে বাইরের উজ্জ্বল আলোর প্রভায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, হুমায়ুন ফরীদি আজীবন সে সাধনাই করেছেন। হুমায়ুন ফরীদি মনের মতো চরিত্র পেলে যথাসাধ্য মনোযোগের সঙ্গে চরিত্র চিত্রণ করতেন। তাকে যেমন নাট্যকার-অভিনেতা মামুনুর রশীদ রচিত 'একটি সেতুর গল্প' নাটকে কাপালিকের ভূমিকায় ত্রিশূল হাতে হুঙ্কার দিয়ে 'কাত্যায়নী বধ কর' বলে চিৎকার করতে শুনেছি, তেমনি লেখক-নাট্যকার কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত 'সাত আসমানের সিঁড়ি' নাটকে পিঠে গুলিবিদ্ধ আহত মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করতে দেখেছি। হৃদয়ছোঁয়া সেই নাটকে স্বজন হারানো একজন মুক্তিযোদ্ধা তার স্বজন হারানোর বেদনায়, আহত গুলিবিদ্ধ পঙ্গু অবস্থায় প্রতিবাদ জানানোর জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। প্রতিবাদ জানিয়ে স্বপ্ন দেখে সাত আসমানের সিঁড়ি বেয়ে দেশের আপামর মানুষের শান্তির জন্য সে ধাপে ধাপে চলে যাবে সেই অনাবিল আনন্দের, অনেক আশার, বহু প্রত্যাশার এক স্বপি্নল সুন্দর শান্তির দেশে। সেই স্বপ্ন নিয়ে আজ মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন ফরীদি যেন পেঁৗছে গেছেন আর কখনও না ফেরার দেশে। আমি আশা করি, হুমায়ুন ফরীদির মতো গুণী নাট্যব্যক্তিত্ব যেন এদেশে অগণিত নতুন প্রজন্মের প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকেন চিরভাস্বর হয়ে।
এই গুণী শিল্পী তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় একুশে পদকসহ কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি। আগামীতে হুমায়ুন ফরীদি হয়তো মরণোত্তর একুশে পদক পেতে পারেন। তিনি যদি তার বেঁচে থাকাকালে কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতেন তাহলে তিনি কর্মের মূল্যায়নের আনন্দ উপভোগ করে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন ধ্যানধারণায় তুলে ধরার প্রেরণা লাভ করতেন। আমরা জানি, মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না। যথার্থ সিদ্ধান্ত। কারণ এ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার পর তাকে যতই পদক-পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হোক, এই পৃথিবীকে তার আর কিছুই দেওয়ার থাকে না। তাই আমি আশা করি, একজন যথার্থ গুণী শিল্পী যেন তার কর্মের স্বীকৃতি তার জীবদ্দশায় পেয়ে যেতে পারেন। স্বীকৃতির আনন্দ নিয়ে যেন এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে পারেন।
মুস্তাফিজুর রহমান : টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব
হুমায়ুন ফরীদিকে আশির দশকের শুরুতে প্রাজ্ঞ নাট্যকার প্রয়াত সেলিম আল দীনের 'ওহ্ দেবদূত' নাটকটি প্রযোজনার সুবাদে ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাই। ওই নাটকটিতে হুমায়ুন ফরীদি ব্যতিক্রমধর্মী খলনায়কের ভূমিকায় অন্যমাত্রার অভিনয় করে সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ছাপিয়ে দর্শকদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন। তার পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা, সেই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেকে উপস্থাপন করার প্রয়াস আমার দৃষ্টি কেড়েছিল। মঞ্চ থেকে টেলিভিশন নাটকে আসার সুবাদে হুমায়ুন ফরীদির মঞ্চের অভিজ্ঞতা তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে দর্শক-দৃষ্টি কাড়ার উদ্যম সৃষ্টি করেছে। ফরীদির অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে বড় গুণ ছিল নাটকের পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়ামাত্র সমগ্র নাটক সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে অবহিত হওয়া এবং তার করণীয় নাট্যাংশের সংলাপ দাঁড়ি-কমাসহ হুবহু মুখস্থ করা। যার ফলে অভিনয়কালে তাকে পরবর্তী সংলাপ কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি বরং পরবর্তী সংলাপ প্রক্ষেপণের সময় তার যথাযথ মৌখিক বা শারীরিক অভিব্যক্তি কী রকম হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে দেখেছি। সেই সময়ে যারা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন অত্যন্ত সৌন্দর্য সচেতন। কাকে ক্যামেরার কোন দিক থেকে আকর্ষণীয় দেখাবে_ এসব ভাবনায় মাঝেমধ্যে হয়তো অভিনয়ে কোনো ফাঁক থেকে যেত। কিন্তু হুমায়ুন ফরীদিকে আমি দেখেছি, নিজের চেহারার চিন্তা বাদ দিয়ে তার চরিত্র চিত্রণ নিয়ে নিবিষ্ট মনে চিন্তাভাবনা করছেন। এ কারণেই ফরীদি যে চরিত্রে অভিনয় করতেন সে চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যেতেন যে, টেলিভিশন দর্শকরা সেই চরিত্রের প্রশংসায় হয়ে উঠতেন পঞ্চমুখ।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, হুমায়ুন ফরীদি আশির দশকে আমার প্রযোজিত কয়েকটি ঈদের নাটক করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে একটি নাটকে তিনি গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। গৃহশিক্ষক তার পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু ছাত্রকে হাতেকলমে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন। একদিন গৃহশিক্ষক সেই শিশুটিকে মিরপুর চিড়িয়াখানায় ফেলে রেখে তাকে বাড়ি ফেরার প্রশিক্ষণ দিয়ে বাড়ি ফেরেন। এর পর সেই গৃহশিক্ষককে নিয়ে বিশাল হৈচৈ এবং ঝামেলা শেষে দেখা যায় শিশুটি গৃহশিক্ষকের প্রশিক্ষণ মতো বাড়ি ফিরেছে। সেই নাটকে গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে ফরীদি নিজের চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চুলে জবজবে করে নারিকেল তেল মেখে চুল পেছনে চ্যাপ্টা করে আঁচড়ে যে অদ্ভুত চুলের স্টাইল এবং পোশাক পরিকল্পনা করেছিলেন তা তার অভিনীত চরিত্রে একটি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল।
পরবর্তী ঈদের নাটকে গৃহশিক্ষক হুমায়ুন ফরীদি তার ছোট্ট শিশু ছাত্রটিকে প্রশিক্ষণ দেন বাড়িতে আগুন লাগলে কোন্ নম্বরে কীভাবে ফায়ার ব্রিগেডকে খবর দিতে হবে। সে অনুযায়ী ছোট্ট শিশুটি বিছানায় তেল ফেলে বাড়ির লেপ-তোশকে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং আগুনের ধোঁয়ায় বাড়িতে হুলস্থুল শুরু হলে শিশুটি গৃহশিক্ষকের দেওয়া ফোন নম্বর অনুযায়ী ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেয়। এই নাটকে বাড়ির ক্ষয়ক্ষতির চিন্তা বাদ দিয়ে, নিজের ছাত্রের ফায়ার ব্রিগেডের অফিসে ফোন করার সাফল্য দেখে গৃহশিক্ষক হুমায়ুন ফরীদির যে আনন্দের অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, তা প্রতিটি দর্শক মহানন্দে উপভোগ করেছিলেন।
হুমায়ুন ফরীদির টেলিভিশনে উত্তরণ মূলত বাংলাদেশ টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্রভিত্তিক সময়ে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকাই ছিল দর্শকদের নাটক প্রদর্শনের একমাত্র কেন্দ্র। সেই সময় সাপ্তাহিক নাটক মাসে চারটি এবং 'এ মাসের নাটক' হিসেবে প্রায় দু'ঘণ্টা ব্যাপ্তিকালীন একটি নাটক হতো। হুমায়ুন ফরীদিকে নিয়ে আমি যেসব নাটক করেছি তার বেশিরভাগই ছিল বিশাল ব্যাপ্তির এ মাসের নাটক।
এই মুহূর্তে ঈদের নাটক 'একদিন হঠাৎ', 'যার যা পছন্দ'সহ কয়েকটি নাটক যেমন_ 'ওহ্ দেবদূত', 'একটি সেতুর গল্প', 'সাত আসমানের সিঁড়ি' এবং রহস্যমানব মোবাশ্বের আলী সিরিজের তিনটি চমৎকার নাটকে হুমায়ুন ফরীদির অসাধারণ সুন্দর অভিনয়ের কথা মনে পড়ছে। আমার পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'শঙ্খনীল কারাগার'-এর ডাবিং সেটে একটি ছোট্ট ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটি দৃশ্যে রিকশাওয়ালার হাসি ছিল। ডাবিং সেটে উপস্থিত হুমায়ুন ফরীদি বললেন, রিকশাওয়ালার ওই হাসিটা আমি করব। ফরীদি একরকম জোর করেই ওই অংশটুকু কৌতুক করে হেঃ হেঃ হাসি দিয়ে ডাব করলেন। উল্লেখ্য, এই চলচ্চিত্রটিতে হুমায়ুন ফরীদি কোনো চরিত্রেই অভিনয় করেননি। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর দেখলাম রিকশাওয়ালার ওই হাসিটুকু দর্শকরা অত্যন্ত উপভোগ করেছেন। সেই সময়ে অর্থাৎ সত্তর-আশির দশকে মঞ্চ নাটকের জগৎ থেকে একঝাঁক নতুন সম্ভাবনাময় তরুণ মঞ্চশিল্পী এসে প্রবেশ করেছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকার সুনির্দিষ্ট চত্বরে নিজেদের মঞ্চের স্বল্প পরিসর থেকে সারাদেশের টিভি দর্শকের সামনে সম্পূূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপন করার জন্য। তখন নবীন- প্রবীণ সব ধরনের শিল্পীর যে পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের মেধা ও মননকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস ছিল, সে প্রয়াস সফল হতো শিল্পী, কলাকুশলী ও কারিগরি কুশলতার যৌথ উদ্যোগে। মঞ্চের সীমিত প্রেক্ষাপটের গণ্ডি থেকে কীভাবে নিজেকে দিনের পর দিন কঠোর সাধনার মাধ্যমে বাইরের উজ্জ্বল আলোর প্রভায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, হুমায়ুন ফরীদি আজীবন সে সাধনাই করেছেন। হুমায়ুন ফরীদি মনের মতো চরিত্র পেলে যথাসাধ্য মনোযোগের সঙ্গে চরিত্র চিত্রণ করতেন। তাকে যেমন নাট্যকার-অভিনেতা মামুনুর রশীদ রচিত 'একটি সেতুর গল্প' নাটকে কাপালিকের ভূমিকায় ত্রিশূল হাতে হুঙ্কার দিয়ে 'কাত্যায়নী বধ কর' বলে চিৎকার করতে শুনেছি, তেমনি লেখক-নাট্যকার কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত 'সাত আসমানের সিঁড়ি' নাটকে পিঠে গুলিবিদ্ধ আহত মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করতে দেখেছি। হৃদয়ছোঁয়া সেই নাটকে স্বজন হারানো একজন মুক্তিযোদ্ধা তার স্বজন হারানোর বেদনায়, আহত গুলিবিদ্ধ পঙ্গু অবস্থায় প্রতিবাদ জানানোর জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। প্রতিবাদ জানিয়ে স্বপ্ন দেখে সাত আসমানের সিঁড়ি বেয়ে দেশের আপামর মানুষের শান্তির জন্য সে ধাপে ধাপে চলে যাবে সেই অনাবিল আনন্দের, অনেক আশার, বহু প্রত্যাশার এক স্বপি্নল সুন্দর শান্তির দেশে। সেই স্বপ্ন নিয়ে আজ মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন ফরীদি যেন পেঁৗছে গেছেন আর কখনও না ফেরার দেশে। আমি আশা করি, হুমায়ুন ফরীদির মতো গুণী নাট্যব্যক্তিত্ব যেন এদেশে অগণিত নতুন প্রজন্মের প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকেন চিরভাস্বর হয়ে।
এই গুণী শিল্পী তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় একুশে পদকসহ কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি। আগামীতে হুমায়ুন ফরীদি হয়তো মরণোত্তর একুশে পদক পেতে পারেন। তিনি যদি তার বেঁচে থাকাকালে কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতেন তাহলে তিনি কর্মের মূল্যায়নের আনন্দ উপভোগ করে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন ধ্যানধারণায় তুলে ধরার প্রেরণা লাভ করতেন। আমরা জানি, মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না। যথার্থ সিদ্ধান্ত। কারণ এ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার পর তাকে যতই পদক-পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হোক, এই পৃথিবীকে তার আর কিছুই দেওয়ার থাকে না। তাই আমি আশা করি, একজন যথার্থ গুণী শিল্পী যেন তার কর্মের স্বীকৃতি তার জীবদ্দশায় পেয়ে যেতে পারেন। স্বীকৃতির আনন্দ নিয়ে যেন এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে পারেন।
মুস্তাফিজুর রহমান : টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব
No comments