এক যুগ পরে-আনন্দবাজার পত্রিকা

( ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরে প্রতিশ্রুত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় কেবল বাংলাদেশে নয়, ভারতের গণমাধ্যমও ব্যাপক সমালোচনা করেছে। এখানে ভারতের ইংরেজি ও বাংলা ভাষার কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যের সারাংশ তুলে ধরা হলো )


দীর্ঘ বারো বছর পর ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে গেলেন। ইহা বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। এই দীর্ঘ সময়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীরা অন্য অনেক দূরবর্তী রাষ্ট্রও সফর করিয়াছেন। এমনকী পশ্চিম সীমান্তের অপর পারে অবস্থিত পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানেও একাধিক বার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পদধূলি পড়িয়াছে। পশ্চিমের সিংহদুয়ার দিয়া কূটনৈতিক অভিযানে বাহির হইলেও পূর্বের খিড়কি-দরজার চৌকাঠ ডিঙাইবার তাগিদ কিন্তু তাঁহারা সহসা অনুভব করেন নাই। দূরকে নিকট কিংবা পরকে আপন করার তাগিদ ভারতীয় শাসকদের যতটা তাড়িত করিয়াছে, আপনকে পর ও নিকটকে দূর করার তাগিদও কি ততটাই? অন্তত পুবের প্রতিবেশীদের প্রতি তেমন মনোভাবই কি প্রচ্ছন্ন থাকে নাই? অন্তত পুবের প্রতিবেশীদের প্রতি তেমন মনোভাবই কি প্রচ্ছন্ন থাকে নাই? তাই নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ কিংবা মায়ানমারের সহিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিবিড় করার কথা বিবেচিত হয় নাই। অগ্রাধিকার পাইয়াছে কেবল পাকিস্তান আর আফগানিস্তান। এবং অবশ্যই চিন। ভারতীয় বিদেশ নীতির অভিমুখ রচনায় এই ভারসাম্যহীন একদেশদর্শিতা রীতিমত নজরে পড়ে। বাংলাদেশ কিন্তু ছোট ভাইয়ের মতো বড় দাদা ভারতের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়াছে। নদীর জল বণ্টন হইতে শুরু করিয়া ছিটমহলের পারস্পরিক হস্তান্তর, সীমান্ত-বিরোধের মীমাংসা, বিদ্যুত্, রাস্তাঘাট, বন্দর ও শিল্পের পরিকাঠামো নির্মাণে প্রতিবেশী ভারতের সহায়তার জন্য উন্মুখ থাকিয়াছে। নয়াদিল্লির কর্তারা ফিরিয়াও চাহেন নাই। তাঁহারা তখন ‘নয়াদিল্লিতে প্রাতরাশ করিয়া মধ্যাহ্নভোজটা লাহৌর বা করাচিতে সারিয়া কাবুলে নৈশভোজ’ করার খোয়াবে মত্ত।
ঢাকা-ইয়াঙ্গন-থিম্পু তাঁহাদের অগ্রাধিকার তালিকায় নাই। অথচ বাংলাদেশের সহিত নিবিড় সখ্য স্থাপিত হইলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির উন্নয়নের সমস্যা মিটিত, সেখানে বাংলাদেশের মধ্য দিয়া যাতায়াত, পণ্য-পরিবহণ নিয়মিত হইলে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের সহিত ওই প্রান্তীয় রাজ্যগুলির মানসিক-সাংস্কৃতিক দূরত্বও ঘুচিত। বাংলাদেশ হইতে পাট ও বস্ত্র, মায়ানমার হইতে কাঠ ও পেট্রোলিয়াম সহজে, কম খরচে, সোজা পথে ভারতে প্রবেশ করিত। কিন্তু পূর্ব সীমান্তের এই সম্ভাবনাময় দিগন্তগুলির উন্মোচন অনারব্ধই থাকিয়া গিয়াছে। নয়াদিল্লির শাসকদের উদাসীনতা ও উন্নাসিকতাই তাহার জন্য দায়ী।
অথচ নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের কাল হইতেই ‘পুবের দিকে তাকাইবার’ নীতিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদেশ মন্ত্রকের অগ্রাধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই ‘পুব’ বলিতে তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিল্পোন্নত দেশগুলিকেই বুঝাইয়াছিল, এশিয়ার নবোদিত শার্দূল হিসাবে যাহাদের পরিচয় পাশ্চাত্য অর্থনীতিরও নজর কাড়িয়াছিল। কিন্তু ওই দূর প্রাচ্যে পৌঁছাইতে হইলে যে আগে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মতো নিকট প্রাচ্যের দরজা উন্মুক্ত করা চাই, রাওয়ের উত্তরসূরিরা তাহাও উপলব্ধি করিয়াছিলেন। কিন্তু সেই উপলব্ধি বিদেশ নীতির অভিমুখ পরিবর্তনে সফল হয় নাই। পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সহিত সম্পর্ক লইয়া নয়াদিল্লি যত বিড়ম্বিত থাকিয়াছে, ঢাকা-থিম্পু-ইয়াঙ্গনকে কাছে টানার কিংবা ওই সব রাজধানী শহরগুলি পরিক্রমা করার আগ্রহ তত দেখায় নাই। আজ অনেক বিলম্বে হয়তো মনমোহন সিংহ পুবের দরজায় কড়া নাড়িতে শুরু করিয়াছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে বেজিংও তাহার জয়পতাকা লইয়া অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটাইয়া দিয়াছে। কলম্বো ও কাঠমন্ডুতে ইতিমধ্যেই সেই পতাকা উড্ডীন, মায়ানমার, ঢাকা ও থিম্পু তাহার পরবর্তী স্টেশন।

No comments

Powered by Blogger.