দুই দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান by ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

নির্বাচন কমিশন নিয়ে এখন সরকারি দল ও বিরোধী দল পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। বিরোধী দল বলছে, এই নির্বাচন কমিশন আমরা মানি না। এটি সংবিধানসম্মতভাবেও গঠিত হয়নি। আবার সরকারি দল বলছে, রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটি গঠিত হয়েছে। কাজেই এটি সংবিধানসম্মত এবং বিএনপিকে এটি মেনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে।


এই যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান, এর দুটি দিক আছে। এক. বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ধারা অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। সেটি হলো, ক্ষমতাসীন দল যাই করবে বা বলবে, বিরোধী দল সব সময়ই তার বিরোধিতা করবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে পরস্পরের অবস্থান সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই একটি ধারা। দুই. বর্তমান বিরোধের মূল কারণ কিন্তু নির্বাচন কমিশন নয়। বিরোধী দলের মূল কথা হচ্ছে, তারা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না। এ জন্য তারা নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছিল। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি যে সংলাপ আহ্বান করেছিলেন, সেখানেও অনেক রাজনৈতিক দল আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিল। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ, সমাজের বিশিষ্টজনরাও প্রকারান্তরে তত্ত্বাবধায়ক হোক, অন্তর্বর্তী সরকার হোক কিংবা অন্য কোনো ধরনের একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে মতামত রেখেছেন। কাজেই এ বিষয়টির যতক্ষণ মীমাংসা না হবে, ততক্ষণ নির্বাচন কমিশন হোক বা অন্য কোনো উদ্যোগই হোক, তা নিয়ে এ রকম বিরোধপূর্ণ অবস্থা থাকবেই।
আর সরকারি দল হোক কিংবা বিরোধী দলই হোক, তারা সব সময় কিছু রাজনৈতিক চাল বা কৌশলের আশ্রয় নেয়। বিরোধী দল হয়তো এখনই চাইবে না, এ বিষয়টির মীমাংসা হয়ে যাক। বরং তারা চাইবে, সরকারের শেষ সময়ে গিয়ে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা হোক। সেটিকে তখন তাদের রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে। বলতে পারবে, সরকার বাধ্য হয়েছে তাদের আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করতে। তখন সেই সরকার যে নির্বাচন কমিশন করবে, সেটিই বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। তার আগে বর্তমান নির্বাচন কমিশন হয়তো উপনির্বাচন কিংবা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে। অন্যদিকে সরকারি দলেরও এ ক্ষেত্রে কিছু রাজনৈতিক চাল বা কৌশল থাকতে পারে। আমরা জানি না, তারা কী চাইছে? তবে তারা তো বলছে, বিরোধী দল সংসদে এসে নির্দলীয় সরকারের ফর্মুলা উপস্থাপন করুক। যুক্তিসংগত হলে তা মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু রাজপথ তো এর সমাধান করতে পারবে না, করতে হবে সংসদকে। অর্থাৎ আমরা দেখছি, তারা বিরোধী দলের সংসদে না আসাকে দোষারোপ করে জনমত অর্জনের চেষ্টা করছে। হয় তো শেষ মুহূর্তে দুই দলই এ ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসতে পারে। আর সেটি যদি সরকারি দল এখনই করে ফেলে, তাহলে সেখানে তেমন পরাজয়ের গ্লানি থাকবে না। কিন্তু যদি শেষ মুহূর্তে গিয়ে তারা সেটি করে, তাহলে তাদের পরাজয়ের গ্লানি অনেকটাই মেনে নিতে হতে পারে। আর শেষ মুহূর্তেও যদি এ ব্যাপারে কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধানে না আসা যায়, তাহলে রাজনীতি অবশ্যই সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু তৃতীয় শক্তির উত্থানের আশঙ্কা থেকে যায় এবং সেই পরিস্থিতিতে জনগণও তাকে স্বাগত জানাবে, যেমন জানিয়েছিল এক-এগারোর সেনাসমর্থিত দুই বছরমেয়াদী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার সময়। তবে আমার মনে হয় না, আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তেমন ভুল পথে এগোবে। কারণ সাধারণ মানুষ সংঘাত চায় না। তারা চায়, দুই দল মিলে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান আসুক। এখানে আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণেই ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছিল। এই দাবি কখনো ক্ষমতাসীন দলের মনের দাবি ছিল না। বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপরও দলীয় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা হয়েছে। যা হোক, সংসদে এই প্রস্তাব উত্থাপনের দায়িত্ব কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দাবি জানালেও ক্ষমতাসীন বিএনপিই সংসদে এ প্রস্তাব উত্থাপন ও পাস করিয়েছিল। এবারও সরকারি দলকেই মূলত সেই ভূমিকা পালন করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.