চারদিক-ভাদ্রের বিকেলে, আড়িয়ল বিলে
আড়িয়ল বিলে যখন পৌঁছালাম, বিকেল চারটা বাজতে তখনো কিছু বাকি। সূর্য যদিও পশ্চিম আকাশে, তেজ তার কমেনি একটুও। এত প্রখর রোদ যে, বিলের দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না। একটু ছায়া খুঁজছিলাম, যেখানে দুদণ্ড দাঁড়ানো যায়। বিলের পাশ দিয়ে নবাবগঞ্জ-চুরাইন নামে যে সড়কটি গেছে, তার বাঁ পাশে বেশ গাছপালা-বাড়িঘর; কিন্তু ডান দিকে বিলের কোল ঘেঁষে বড়-মাঝারি কোনো বৃক্ষরাজি চোখে পড়ল না।
তাই শ্রান্তিহারক ছায়াও আর মিলল না। এখন অপেক্ষা বিকেলের জন্য, অপেক্ষা গোধূলির জন্য।
২১ ভাদ্রের ওই দুপুরের সোনালি রোদের মধ্যেও থেমে থেমে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। আড়িয়ল বিলের বাতাস। আমি বিলের দিকে চোখ রাখলাম। এই সেই বিল, যা দেখব দেখব ভাবছি অনেক দিন। এই সেই বিল, যা দেখার জন্য ঢাকা থেকে এসেছি। আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করলাম। দূরের কিছুই প্রায় দেখা যায় না। দূরে কেবলই শরতের নীল আকাশ, শিমুল তুলার মতো সাদা মেঘ। আড়িয়ল বিলের পানিতে সেই মেঘের প্রতিচ্ছবি।
তীরে কিছু বেদে নৌকার সারি। জলের এই মানুষেরা লাল আর হলুদ পতাকা বসিয়ে সেখানে নোঙর ফেলেছেন। নৌকার গলুইয়ে বসে পান চিবোচ্ছেন বেদে কন্যারা। আড়িয়ল বিলে কতশত ধরনের উদ্ভিদ, লতাপাতা। সব উদ্ভিদের নাম তো জানা নেই। কোনো কোনো জায়গা ভরে আছে কলমিলতায়। কত নিশ্চিন্তে, কী অসীম স্বাধীনতায় কলমিলতাগুলো ডগা উঁচিয়ে আছে, আর ঠান্ডা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। দূরে দেখা গেল রঙিন শাপলার হাসি, যেন বিলের মধ্যে একখণ্ড পুষ্পের বাগান। কোথাও হেলেঞ্চা, কোথাও কচুরিপানা।
দূরে একদল কিশোরকে নৌকা নিয়ে শামুক কুড়াতে দেখা গেল। এই শামুক ওরা ঝুড়ি ভরে বিক্রি করবে। বিলে এখন আমন হয়েছে। আছে পাট, ধইঞ্চা। আর শীতকালে পেঁয়াজ, রসুন, মুলা সবই হবে। সুস্বাদু, বড় বড় কচি লাউ হবে এই বিলে। বৈশাখ মাসে হবে ইরি। বড় বড় কইসহ দেশি সব মাছের আধার এই বিল। কত পাখির খাবার এই বিলে। পৌষ-মাঘে কত বিদেশি পাখি আসবে এই বিলে।
খুব সকালে এই বিলের কাছে মাছের হাট বসে। বিলের তাজা মাছ বেশ সস্তায় এখানে মেলে। তা কিনতে পেরে ধন্য হন দূরের মানুষেরাও।
বিলের কয়েকটি ছবি নিলাম। কয়েকটি ভালো হলো, কয়েকটি ভালো হলো না। অনুমতি নিয়ে বেদে কন্যাদের ছবি নিলাম। ‘একটু ভালো করে তুইলেন, আর আসেন আমাগো চা খেয়ে যান’—এ কথা বলে খলখল করে হাসতে হাসতে দুটো মেয়ে ছইয়ের মধ্যে লুকাল। এমন সময় তিনটি ছেলের দেখা মিলল। ওরা এ গ্রামেরই সন্তান। গ্রামের নাম মুন্সিনগর, ইউনিয়ন চুরাইন, উপজেলা নবাবগঞ্জ, জেলা ঢাকা। এ বিলে বিমানবন্দর না করার জন্য যে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, ওরাও সে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। কেবল ওরাই নয়, ওদের মায়েরা, ওদের বোনেরাও তাদের মতো করে অংশ নিয়েছিল সে গণপ্রতিরোধে। এ বিল তো ওদের অস্তিত্ব, ওদের জীবন, ওদের বেঁচে থাকার আরেক নাম, ওদের ভাত-কাপড়ের নিশ্চিত ঠিকানা।
ওরা ওদের কুটিরে নিয়ে গেল। টিনের ছাউনি দেওয়া চারটি ঘর, একটি ঘর পাকা। মাঝখানে উঠান। আমগাছের শাখায় ঢাকা উঠানে বসলাম মাদুর পেতে। ওই বাড়ির সবচেয়ে প্রৌঢ় নারী যিনি, তিনি খুলে দিলেন কথার ঝাঁপি। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রসঙ্গ আড়িয়ল বিল। ঢাকার দুটি উপজেলা নবাবগঞ্জ ও দোহার আর মুন্সিগঞ্জের দুটি উপজেলা শ্রীনগর ও সিরাজদিখান—এই চার উপজেলাজুড়ে আড়িয়ল বিল। বিলের মোট জমি ৬৬ হাজার একর। এর মধ্যে খাসজমি আছে, অর্পিত সম্পত্তি আছে, আছে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। মূলত এই চার উপজেলার প্রায় ১৪ লাখ লোক এই বিলের ওপর নির্ভরশীল। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের আড়াই দিনের খাবার হয় এই বিলে।
প্রবীণা বলেন, এই বিল না থাকলে এই অঞ্চলের মানুষ ‘ভাতে মরত’। ‘ভাতে মরত’ শব্দদ্বয় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। বারবার ফিরে ফিরে আসে। বিল না থাকলে কোনো উপায় থাকত না মানুষের, বলেন অন্য নারীরা। তখন গোধূলি লগ্ন। এবার ওঠার পালা। ‘আপনারা একটু মাঝেমধ্যে আইসেন। আমাগো দিকে একটু খেয়াল রাইখেন।’ পেছনে ফিরে দেখি, প্রবীণার চোখে-মুখে ঘোর আঁধার।
পথ চলতে চলতে ওই তরুণেরা জানালেন, আড়িয়লপারের গ্রামবাসীর মধ্যে উদ্বেগ এখনো কাটেনি। এখানে বিমানবন্দর হবে না—এ কথায় পুরোপুরি আস্থা তাঁরা রাখতে পারছেন না। অনেকেই সস্তায় জমি বেচে দিচ্ছে, আর এসব জমি কিনে নিচ্ছেন বড় বড় শিল্পপতিরা, যাঁরা সরকারের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আমার অটোরিকশাটি দাঁড়ানো ছিল মুন্সিনগর মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের মাঠের এক কোনায়। চেয়েছিলাম মাঠে একটু বসতে, সন্ধ্যার বাতাসে একটু জিরিয়ে নিতে, আড়িয়ল বিল নিয়ে একটু ভাবতে। মধ্যবয়সী অটোরিকশাচালক তাড়া দিলেন, ‘না না ভাই, এখানে বইসেন না। সমস্যা আছে। মানুষজন বলতাছে এরা কারা? তুমি কাগো লইয়া আইছ। আমি কইলাম, আপনারা যা ভাবতেছেন, তা না, এরা বেড়াইতে আইছে।’
অটোরিকশা চলল নবাবগঞ্জের দিকে। আমার মাথায় আড়িয়ল বিল, কলমিলতা, ঘাসফুল, বেদে নৌকা। আড়িয়ল বিলের কলমিলতা বেঁচে থাকুক। বেঁচে থাকুক বিলের ঘাসফুল।
একটি কবিতা পড়েছিলাম—তার কোনো তলোয়ার নেই/ বন্দুকও না/ চোখে বিদ্যুৎ রেখেছিল সে/ আমি জানি না আলোর সাংকেতিক ভাষা/ তবু টের পাই পৃথিবীজুড়ে ভোর হচ্ছে...
কাজী আলিম-উজ-জামান
alim_zaman@yahoo.com
২১ ভাদ্রের ওই দুপুরের সোনালি রোদের মধ্যেও থেমে থেমে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। আড়িয়ল বিলের বাতাস। আমি বিলের দিকে চোখ রাখলাম। এই সেই বিল, যা দেখব দেখব ভাবছি অনেক দিন। এই সেই বিল, যা দেখার জন্য ঢাকা থেকে এসেছি। আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করলাম। দূরের কিছুই প্রায় দেখা যায় না। দূরে কেবলই শরতের নীল আকাশ, শিমুল তুলার মতো সাদা মেঘ। আড়িয়ল বিলের পানিতে সেই মেঘের প্রতিচ্ছবি।
তীরে কিছু বেদে নৌকার সারি। জলের এই মানুষেরা লাল আর হলুদ পতাকা বসিয়ে সেখানে নোঙর ফেলেছেন। নৌকার গলুইয়ে বসে পান চিবোচ্ছেন বেদে কন্যারা। আড়িয়ল বিলে কতশত ধরনের উদ্ভিদ, লতাপাতা। সব উদ্ভিদের নাম তো জানা নেই। কোনো কোনো জায়গা ভরে আছে কলমিলতায়। কত নিশ্চিন্তে, কী অসীম স্বাধীনতায় কলমিলতাগুলো ডগা উঁচিয়ে আছে, আর ঠান্ডা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। দূরে দেখা গেল রঙিন শাপলার হাসি, যেন বিলের মধ্যে একখণ্ড পুষ্পের বাগান। কোথাও হেলেঞ্চা, কোথাও কচুরিপানা।
দূরে একদল কিশোরকে নৌকা নিয়ে শামুক কুড়াতে দেখা গেল। এই শামুক ওরা ঝুড়ি ভরে বিক্রি করবে। বিলে এখন আমন হয়েছে। আছে পাট, ধইঞ্চা। আর শীতকালে পেঁয়াজ, রসুন, মুলা সবই হবে। সুস্বাদু, বড় বড় কচি লাউ হবে এই বিলে। বৈশাখ মাসে হবে ইরি। বড় বড় কইসহ দেশি সব মাছের আধার এই বিল। কত পাখির খাবার এই বিলে। পৌষ-মাঘে কত বিদেশি পাখি আসবে এই বিলে।
খুব সকালে এই বিলের কাছে মাছের হাট বসে। বিলের তাজা মাছ বেশ সস্তায় এখানে মেলে। তা কিনতে পেরে ধন্য হন দূরের মানুষেরাও।
বিলের কয়েকটি ছবি নিলাম। কয়েকটি ভালো হলো, কয়েকটি ভালো হলো না। অনুমতি নিয়ে বেদে কন্যাদের ছবি নিলাম। ‘একটু ভালো করে তুইলেন, আর আসেন আমাগো চা খেয়ে যান’—এ কথা বলে খলখল করে হাসতে হাসতে দুটো মেয়ে ছইয়ের মধ্যে লুকাল। এমন সময় তিনটি ছেলের দেখা মিলল। ওরা এ গ্রামেরই সন্তান। গ্রামের নাম মুন্সিনগর, ইউনিয়ন চুরাইন, উপজেলা নবাবগঞ্জ, জেলা ঢাকা। এ বিলে বিমানবন্দর না করার জন্য যে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, ওরাও সে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। কেবল ওরাই নয়, ওদের মায়েরা, ওদের বোনেরাও তাদের মতো করে অংশ নিয়েছিল সে গণপ্রতিরোধে। এ বিল তো ওদের অস্তিত্ব, ওদের জীবন, ওদের বেঁচে থাকার আরেক নাম, ওদের ভাত-কাপড়ের নিশ্চিত ঠিকানা।
ওরা ওদের কুটিরে নিয়ে গেল। টিনের ছাউনি দেওয়া চারটি ঘর, একটি ঘর পাকা। মাঝখানে উঠান। আমগাছের শাখায় ঢাকা উঠানে বসলাম মাদুর পেতে। ওই বাড়ির সবচেয়ে প্রৌঢ় নারী যিনি, তিনি খুলে দিলেন কথার ঝাঁপি। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রসঙ্গ আড়িয়ল বিল। ঢাকার দুটি উপজেলা নবাবগঞ্জ ও দোহার আর মুন্সিগঞ্জের দুটি উপজেলা শ্রীনগর ও সিরাজদিখান—এই চার উপজেলাজুড়ে আড়িয়ল বিল। বিলের মোট জমি ৬৬ হাজার একর। এর মধ্যে খাসজমি আছে, অর্পিত সম্পত্তি আছে, আছে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। মূলত এই চার উপজেলার প্রায় ১৪ লাখ লোক এই বিলের ওপর নির্ভরশীল। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের আড়াই দিনের খাবার হয় এই বিলে।
প্রবীণা বলেন, এই বিল না থাকলে এই অঞ্চলের মানুষ ‘ভাতে মরত’। ‘ভাতে মরত’ শব্দদ্বয় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। বারবার ফিরে ফিরে আসে। বিল না থাকলে কোনো উপায় থাকত না মানুষের, বলেন অন্য নারীরা। তখন গোধূলি লগ্ন। এবার ওঠার পালা। ‘আপনারা একটু মাঝেমধ্যে আইসেন। আমাগো দিকে একটু খেয়াল রাইখেন।’ পেছনে ফিরে দেখি, প্রবীণার চোখে-মুখে ঘোর আঁধার।
পথ চলতে চলতে ওই তরুণেরা জানালেন, আড়িয়লপারের গ্রামবাসীর মধ্যে উদ্বেগ এখনো কাটেনি। এখানে বিমানবন্দর হবে না—এ কথায় পুরোপুরি আস্থা তাঁরা রাখতে পারছেন না। অনেকেই সস্তায় জমি বেচে দিচ্ছে, আর এসব জমি কিনে নিচ্ছেন বড় বড় শিল্পপতিরা, যাঁরা সরকারের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আমার অটোরিকশাটি দাঁড়ানো ছিল মুন্সিনগর মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের মাঠের এক কোনায়। চেয়েছিলাম মাঠে একটু বসতে, সন্ধ্যার বাতাসে একটু জিরিয়ে নিতে, আড়িয়ল বিল নিয়ে একটু ভাবতে। মধ্যবয়সী অটোরিকশাচালক তাড়া দিলেন, ‘না না ভাই, এখানে বইসেন না। সমস্যা আছে। মানুষজন বলতাছে এরা কারা? তুমি কাগো লইয়া আইছ। আমি কইলাম, আপনারা যা ভাবতেছেন, তা না, এরা বেড়াইতে আইছে।’
অটোরিকশা চলল নবাবগঞ্জের দিকে। আমার মাথায় আড়িয়ল বিল, কলমিলতা, ঘাসফুল, বেদে নৌকা। আড়িয়ল বিলের কলমিলতা বেঁচে থাকুক। বেঁচে থাকুক বিলের ঘাসফুল।
একটি কবিতা পড়েছিলাম—তার কোনো তলোয়ার নেই/ বন্দুকও না/ চোখে বিদ্যুৎ রেখেছিল সে/ আমি জানি না আলোর সাংকেতিক ভাষা/ তবু টের পাই পৃথিবীজুড়ে ভোর হচ্ছে...
কাজী আলিম-উজ-জামান
alim_zaman@yahoo.com
No comments