বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-বইপ্রেমীর প্রাণের কোলাহল by মাসুম আলী

মেলাসংলগ্ন রাস্তায় নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র ও গাড়ির বিতিকিচ্ছিরি শব্দ, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল বইপ্রেমী মানুষের পদচারণ আর প্রাণের কোলাহল। ভিড়ভাট্টা, হট্টগোল—কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়ার আকুলতার কাছে। মেলা মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিখ্যাত গবেষক উইলিয়াম রাদিচে মন্তব্য করলেন, এমন বিশাল জ্ঞানের মেলা সারা বিশ্বেই বিরল।


যেমন হয় বরাবর, ঠিক তেমনই। গতকাল শনিবার ছুটির দিনে গ্রন্থমেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সকাল থেকে রাত অবধি অবিরাম জনস্রোত। মূল মঞ্চে শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতা পর্ব ছিল সকাল সাড়ে ১০টায়। তখনই মেলার দোর খুলে দেওয়া হয়েছিল শিশু ও নারীদের জন্য। বেলা একটা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর। তার পর থেকেই প্রবেশের জন্য আমজনতার লাইন। একটা পর্যায়ে ভেতরে অবস্থা এমন, যেন পা ফেলার জায়গা নেই। তা সত্ত্বেও মন্থর পায়ে এগিয়েছেন গ্রন্থানুরাগীরা। ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে স্টলের সামনে জায়গা করে নিয়ে পছন্দের বইটি কিনেছেন। তবে ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যাই ছিল বহুগুণ বেশি।
সকালে শিশু-কিশোরের প্রতিযোগিতা: বই বিকিকিনির পাশাপাশি সকালে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর সাধারণ জ্ঞান এবং উপস্থিত বক্তৃতার চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতা। ক শাখায় সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে ১০ জন এবং খ শাখায় উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় ১০ জন প্রতিযোগী অংশ নেয়। এর মধ্যে ক শাখায় প্রথম স্থান ইনতিসার তাহমিদ, দ্বিতীয় স্থান মো. আসিফ হায়দার এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে হাসিব রহমান। খ শাখায় প্রথম স্থান তাহামিনা তাসনীম রত্না, দ্বিতীয় মো. তন্ময় মেহেদী আসিক এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে সামিনা জাহান।
বিকেলে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: বেলা সাড়ে তিনটায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে আয়োজিত ‘ছন্দের অনুবাদ: মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের সমস্যা’ শীর্ষক একক বক্তৃতানুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন ব্রিটিশ কবি, অনুবাদক, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম রাদিচে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম।
উইলিয়াম রাদিচে বলেন, বাংলা থেকে ইংরেজি ভাষান্তরে কিছু জটিল সমস্যা রয়েছে। প্রধান সমস্যা ছন্দকেন্দ্রিক। বাংলা ছন্দের শব্দ বা ধ্বনিগত রূপ অনুবাদে ব্রিটিশ ও আমেরিকান ইংরেজির পার্থক্য আছে। তিনি বলেন, মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে যে সমস্যা পরিদৃষ্ট হয়, তা শুধু ভাষাগত নয়, ভাবগতও বটে। বাংলা একাডেমীর গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন বিশাল জ্ঞানের মেলা সারা বিশ্বেই বিরল।
পরে ‘জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিত্ ঘোষ। আলোচনায় অংশ নেন শফিউল আলম, সমাজকর্মী ও লেখক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান এবং কথাসাহিত্যিক অদিতি ফাল্গুনী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পঞ্চকবির গান পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী লুভা নাহিদ চৌধুরী, মঙ্গল চন্দ্র মণ্ডল, নার্গিস চৌধুরী, নীলোত্পল সাধ্য, প্রমীলা ভট্টাচার্য, সুমন মজুমদার, প্রিয়াংকা গোপ, নাসিমা শাহীন, মাহবুবা রহমান, মো. হারুন-অর-রশিদ এবং এ কে এম শহীদ কবির।
মেলায় আসা নতুন বই ও বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
বাংলা একাডেমীর তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শনিবার মেলার ১৮তম দিনে নতুন ১৩৬টি বই এসেছে। এর মধ্যে হাসান হাফিজের না দিলে ভেরি গুড এনেছে কাশবন প্রকাশন এবং আফ্রিকা এশিয়ার রূপকথা এনেছে কলি প্রকাশনী, যতীন্দ্রনাথ সরকারের তোমাকে যখন ভাবি এনেছে মুক্তদেশ প্রকাশন, ফজলে রাব্বির স্মৃতিতে বাংলা একাডেমী এনেছে জাগৃতি প্রকাশনী, ধ্রুব এষর পিনোকিওর বাবা এনেছে বিদ্যাপ্রকাশ, সরওয়ার মুর্শেদের রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-আদর্শ তত্ত্ব ও প্রয়োগ এনেছে ঝিনকু প্রকাশনী, নজরুল কবীরের যুদ্ধাপরাধের বিচার ও গণতন্ত্রের পেন্ডুলাম এনেছে ভাষাচিত্র, উদিসা ইসলামের ইরানী চলচ্চিত্র-১০ নারী নির্মাতা এনেছে ভাষাচিত্র। এ ছাড়া পাঠসূত্র এনেছে শিমন শারমিন অনূদিত রোয়াল্ড ডাহলের মাটিল্ডা, ঐতিহ্য এনেছে আব্দুল হাই অনূদিত দি অটোবায়োগ্রাফি অব বার্ট্রান্ড রাসেল।
এ ছাড়া অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে সজল আশফাকের প্রেসক্রিপশন প্রতিদিন। আদর্শ প্রকাশনী থেকে এসেছে আল মাহমুদের আত্মজীবনী কবির মুখ। আগামী প্রকাশনী থেকে এসেছে আয়াত আলী পাটওয়ারীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। শুদ্ধস্বর থেকে এসেছে আসাদুজ্জামান নূরের নিরালা নীলে। পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে আনিসুল হকের প্রিয় পাঠক, একটু হাসুন ও খন্দকার মাহমুদুল হাসানের প্রাচীন বাংলার প্রত্নকীর্তি।
শনিবার মেলার নজরুল মঞ্চে ১৬টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন উন্মোচন করেন সাহানারা বেগমের নীল কণ্ঠের ডানা। মূর্ধন্য থেকে রবীন্দ্রনাথবিষয়ক পাঁচটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়। বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন করেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

No comments

Powered by Blogger.