ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক-মনমোহনের সফর ও সামনে এগোনোর পথ by আশফাকুর রহমান

আগামীকাল ব্যস্ত দিন কাটাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি অভ্যর্থনা জানাবেন আমাদের এক সম্মানিত অতিথিকে। সেই অতিথি আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এ দেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফরে আসার ঘটনা আমাদের ৪০ বছরের ইতিহাসে বিরল।


অতীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা এ দেশে এসেছেন হয় সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে, নয়তো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানাতে। তবে এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসছেন আমাদের পার্শ্ববর্তী চারটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। এবার অতিথি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই আসছেন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আন্তরিক ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন, যেমন অভ্যর্থনা তিনি পেয়েছিলেন ২০১০ সালের জানুয়ারিতে নয়াদিল্লি সফরের সময়।
মনমোহনের এই সফরকে বাংলাদেশের জনগণ ঐতিহাসিক সফর বলে মনে করে। দুই দেশের মধ্যকার বিরাজমান বিভিন্ন অমীমাংসিত সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে বলে তারা আশাবাদী। বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্ম ভারতের সঙ্গে বিরোধের পরিস্থিতির মধ্যেই বসবাস করে আসছে, তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ উভয় দেশের মানুষ অভিন্ন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশীদার। এবার তারা হয়তো অভিন্ন ভবিষ্যতের অংশীদারি হওয়ার কাজটি শুরু করতে যাচ্ছে।
সাধারণভাবে আশা করা যাচ্ছে, আগামীকাল আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেসব চুক্তি হতে পারে তার মধ্যে আছে—তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনের ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি, ট্রানজিটের সম্মতিপত্র, ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার অমীমাংসিত সীমান্ত নির্ধারণ চুক্তি এবং বাগেরহাটে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি।
যেসব বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেগুলোর মধ্যে আছে বাণিজ্য উদারীকরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার। ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলি জমি হস্তান্তর, সড়ক ও রেল ট্রানজিট সুবিধা, প্রাণবৈচিত্র্য ও সুন্দরবনের বাঘ সুরক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিনিময়ের বিষয়ে কতগুলো প্রটোকল সইয়েরও সম্ভাবনা আছে।
এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের মধ্য দিয়ে কয়েকটি অমীমাংসিত বিষয়ের নিষ্পত্তির কাজও শুরু হবে। তবে কিছু পুরোনো ইস্যু ঘুরেফিরে আসবে। আন্তসংযোগের কথাই ধরা যাক। এ ক্ষেত্রে নতুন কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। আন্তসংযোগের রুট, ধরন, ফি এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর বিষয়গুলো পরে নিষ্পত্তি করতে হবে।
আগামীকাল দুই প্রধানমন্ত্রী অনেকটা অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশে বৈঠক করতে যাচ্ছেন। এটা সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে, গত বছর জানুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর শেখ হাসিনা ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ দূর করতে এরই মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে যেসব সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী অস্থিতিশীল করছিল, তাদের নেতাদের এ দেশের মাটি অভয়স্থল হিসেবে ব্যবহারের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এমন কোনো গোষ্ঠীকে ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর জন্য বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশের নীতিগত এ পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত এবং আগের অবিশ্বাসের মেঘ কেটে গেছে।
ভারতের জনগণ তাদের গণমাধ্যমের মাধ্যমে এখন স্পষ্ট করেছে যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানে তারা সন্তুষ্ট এবং একই ভাবে ভারত অমীমাংসিত সব বিষয়ের নিষ্পত্তি ঘটিয়ে প্রতিদান দিক—এমনটাই তাদের চাওয়া। অনেকেই বলেছেন, নানা বিষয়ে বাংলাদেশকে ন্যায্য হিস্যা দিতে ভারতের নিজে থেকেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
আগেই বলা হয়েছে, ভারতকে তার উত্তর-পূর্বের আটটি রাজ্যকে সংযুক্ত করতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে আগামীকাল কোনো চুক্তি হবে না, তবে সমঝোতা স্মারক সই করার মাধ্যমে আমাদের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোকে সংযুক্ত করার সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশ সন্দেহাতীতভাবে এক ধাক্কায় একটা বড় ধরনের দর-কষাকষির হাতিয়ার ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে—এই উদারতার প্রতিদান ভারত কীভাবে দেবে, সে নিশ্চয়তা ছাড়াই। প্রত্যাশিত পথে কাজ না হলে সাধারণত ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
সামনের যে দুই দিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে কাটাবেন, সে সময় বাংলাদেশের জনগণ তাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষায় থাকবে। প্রতিদান হিসেবে ভারত আমাদের কী দেয়, সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে।
বাংলাদেশের জনগণ চায়, ভারত আমাদের প্রত্যাশার তালিকার প্রতি মনোনিবেশ করুক।
প্রথমত, আমরা সন্দেহাতীতভাবে চাই, ভারত স্বাক্ষরিত সব সীমান্ত চুক্তি শুধু বাস্তবায়নই করবে না, বরং এই দীর্ঘ সীমান্তকে—যা আমাদের জনগণের এত যন্ত্রণার কারণ—বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সীমান্তে পরিণত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। সীমান্তে আর কোনো নিরীহ বাংলাদেশি হত্যা নয়। সীমান্ত বরাবর ভারতে গড়ে ওঠা অবৈধ ফেনসিডিলের কারখানাগুলো ধ্বংস করা উচিত। এগুলো আমাদের তরুণদের নেশায় আসক্ত করছে। এসব কারখানার জায়গায় বৈধ কসাইখানা স্থাপনের কথা তারা ভেবে দেখতে পারে। আর এভাবে তারা বাংলাদেশে গবাদিপশু চোরাচালান হওয়া বন্ধ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার চাইব আমরা। ভারতের কাছে এটা একেবারে অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু ভারতকে নাটকীয় উপায়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে, সে জন্য ভারতের উচিত হবে একেবারেই বাংলাদেশের ওপর থেকে সব অশুল্ক বাধা সরিয়ে নেওয়া এবং শুল্ক সম্ভবপর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে নেওয়া। এটা ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়াতে সহায়ক হবে। এতে যেমন বাণিজ্যবৈষম্য দূর হবে তেমনি এ দেশের জনগণ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে আস্থা ফিরে পাবে। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক থেকে ভারতের রাজস্ব আয় তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের কথাও তাদের বিবেচনা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে ত্রিপুরা রাজ্যেই এটা করার কথা ভাবা যেতে পারে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ভোক্তারাই হবেন এসব পণ্যের লক্ষ্য।
৫৪টি যৌথ নদীর সব কটির পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা শুরু করা উচিত। অগ্রাধিকার কাজের তালিকায় নদীগুলোর প্রবাহ বৃদ্ধির ব্যাপারে আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি দুই দেশের সম্মত হওয়া পয়েন্টগুলোতে পানিপ্রবাহ মনিটরিংয়ের কাজও যথাযথভাবে শুরু করতে হবে।
এর পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যতের ওপর দৃষ্টি দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক সমর্থন। বাংলাদেশে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত না হলে অগ্রগতি ব্যাহত হবে। কী ঘটছে, তা গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করার দায়িত্বও সরকারের। সরকার যা-ই করুক না কেন, জনগণের সামনে তা যেন স্বচ্ছ থাকে। এ জন্য রাজনৈতিক দল, সাংসদ, সুশীল সমাজ ইত্যাদির ভেতর প্রাতিষ্ঠানিকতার চর্চাকে উৎসাহিত করা উচিত।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ও পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্য, ট্রানজিট, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ ও পর্যটনের আঞ্চলিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার সম্ভাবনা আছে। দুই দেশেরই উচিত এ সম্ভাবনাকে বিকশিত করা এবং প্রয়োজনীয় নীতি-কাঠামো তৈরি করা। দুই দেশের মধ্যে উপযুক্ত জায়গাগুলোতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্রিডলাইন সংযুক্ত করা উচিত।
পরস্পরের শক্তি কাজে লাগানো যায়, এমন আন্তসীমান্ত প্রকল্পকে যথাসময়ে চিহ্নিত করা উচিত দুই দেশেরই। পরিবেশগত সমস্যা লাঘব ও অভিযোজনের জন্য সহযোগিতামূলক কর্মপ্রচেষ্টাও নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের বাস্তুচ্যুতি মোকাবিলা করতে হবে যৌথভাবেই।
বাংলাদেশ ও ভারতের, বিশেষত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উন্নতির জন্য অধিকতর অর্থনৈতিক মেলবন্ধন ঘটানোকেই দুই দেশের লক্ষ্য হিসেবে নেওয়া উচিত। দুই দেশেই যেসব জায়গা পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময়, সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত আর মিজোরামের আইজলের পাহাড়গুলোকে আরও আকর্ষণীয় করতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চট্টগ্রাম ও আইজলের মধ্যে চার্টার ফ্লাইট চালু করা উচিত।
উভয় দেশের শিক্ষাবিদদের পারস্পরিক যোগাযোগ উৎসাহিত করতে একটা পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে। এক দেশের শিক্ষাবিদের অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করাকে উৎসাহিত করা উচিত।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের প্রক্রিয়া শুরু করতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবে এ সময়ে এসে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাঠামোগত চুক্তির আনুষঙ্গিক ক্ষেত্র তৈরিতে সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে উভয় সরকারকে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে স্বচ্ছ থাকতে হবে। বাংলাদেশ সরকার বলেছে, ভারতের সঙ্গে যেসব ব্যাপারে তারা সম্মত হবে, তা অনলাইনে প্রচার করবে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়, এতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অনলাইনে প্রকাশ করাই কি উচিত ছিল না?
আমাদের সুপারিশ হলো, ভারতের সঙ্গে আলোচিত কয়েকটি ইস্যু নিয়ে আমাদের সংসদে বিতর্ক হতে পারে, ঠিক যেমন ভারতের পার্লামেন্টে হয়। বহুদলীয় এ প্রক্রিয়া থেকে যদি কেউ বাদ পড়তে না চায়, তাহলে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের কোনো উপায় থাকবে না সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়া ছাড়া।
আমাদের প্রধান বিরোধী দল ইঙ্গিত দিচ্ছে, বহু পুরোনো ও অমীমাংসিত দ্বিপক্ষীয় ইস্যু দুই প্রধানমন্ত্রী নিষ্পত্তি করবেন, এমনটা তারা দেখতে চায়। এটা আসলেই ভালো লক্ষণ। আশা করি, তাঁরা এ পথ ছেড়ে সহজে পালাবেন না।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির জন্য আমরা কয়েক দশক ধৈর্য সহকারে অপেক্ষায় আছি। আশা করি, এ সপ্তাহে আমরা হতাশ হব না।
আশফাকুর রহমান: সাবেক রাষ্ট্রদূত, সেন্টার ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান।
ashfaq303@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.