তিস্তা নিয়ে অনড় মমতা by রাহীদ এজাজ
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে অনড় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন গলাতে ব্যর্থ হয়েছেন মনমোহন সিংয়ের বিশেষ দূত রঞ্জন মাথাই। অভিন্ন নদীটি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যুক্ত করেছেন ফারাক্কা বাঁধে ফাটলের বিষয়কে। এর ফলে অনিশ্চয়তার মেঘ কাটছে না তিস্তা চুক্তি নিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে মুঠোফোনে জানিয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব রঞ্জন মাথাই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বিশেষ দূত হিসেবে বিকেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন। মহাকরণে অনুষ্ঠিত দেড় ঘণ্টার ওই বৈঠকে ভারতের শীর্ষস্থানীয় এই কূটনীতিক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মন গলাতে পারেননি বলে সূত্র দাবি করেছে।
তবে মহাকরণে ওই বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।
এদিকে ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফর পিছিয়ে গেছে। তাঁর প্রস্তাবিত সফর চলতি মাসে হওয়ার কথা থাকলেও এটি আগামী মাসের দ্বিতীয়ার্ধের আগে হচ্ছে না।
আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, মহাকরণ ছেড়ে যাওয়ার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেছেন, এটি রুটিন বৈঠক ছাড়া আর কিছুই নয়।
অন্যদিকে, রঞ্জন মাথাই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কথা হয়েছে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়েও।
এদিকে কলকাতার সূত্রগুলো জানিয়েছে, তিস্তা চুক্তি সই হওয়া কেন জরুরি, তা মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন রঞ্জন মাথাই। বিশেষ করে নিরাপত্তা, ট্রানজিটসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ যেভাবে ভারতকে সহযোগিতা করেছে, সেখানে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। খুব শিগগির চুক্তিটি সই না হলে বাংলাদেশের হতাশা দূর হবে না। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে এটা বলেও বোঝানোর চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশকে পানি দিলে বঞ্চিত হবে না রাজ্যের অধিবাসীরা।
এ সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উল্টো ফারাক্কা বাঁধের স্লুইসগেট অকেজো হওয়ার বিষয়টি তোলেন। এ ব্যাপারে রাজ্যের বিদ্যুত্মন্ত্রী মনীষ গুপ্ত ফারাক্কা বাঁধ এলাকা ঘুরে এসে প্রাথমিক একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আর ওই প্রতিবেদনের উল্লেখ করে মমতা গতকালের বৈঠকে বলেন, গত বছর দুটি স্লুইসগেট খারাপ হওয়ায় বাংলাদেশ ৮৪ হাজার কিউসেক বেশি পানি পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ৩৫ হাজার কিউসেক। এভাবে বাংলাদেশে বেশি পানি চলে যাওয়ায় পানির স্তর এতটাই কমে যাবে যে এনটিপিসির জলবিদ্যুেকন্দ্রের উত্পাদন ব্যাহত হবে। এতে রাজ্যে বিদ্যুতের সংকট দেখা দেবে।
এমন এক পরিস্থিতিতে মমতার মত হচ্ছে, ফারাক্কা নিয়ে যা ঘটেছে এতে তো বাংলাদেশ দায়ী নয়। এর সুরাহা করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কারণ, এতে বিদ্যুতের সংকট তৈরি হবে রাজ্যে। আর এ সমস্যার সুরাহা না করে কেন্দ্র কীভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সই করাটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে। তা ছাড়া তিস্তা নিয়ে নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রর প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার। আর ওই প্রতিবেদন এলেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তা কমিশনের প্রধান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্র গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ফারাক্কার স্লুইসগেটের সমস্যার সঙ্গে তিস্তাকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, গঙ্গা ও তিস্তা দুটি নদীর গতিপথ ও অববাহিকা একেবারেই আলাদা।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এমন অনড় অবস্থানের পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, খুব শিগগিরই দিল্লি থেকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল ফারাক্কায় যাবে। এরপর ওই এলাকা ঘুরে এসে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর করণীয় ঠিক করা হবে। এর পাশাপাশি তিস্তার বিষয়টি দ্রুত বিবেচনার জন্য রঞ্জন মাথাই অনুরোধ জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
‘না’ বলার প্রস্তুতি আগে থেকেই: কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘না’ বলতে আগে থেকেই তৈরি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এ প্রস্তুতি জোরদার করতে তিনি গত শুক্রবার সেচসচিব অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ও নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রর সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ঠিক হয়, কেন্দ্রকে কী বার্তা দেওয়া হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো দাবি করছে, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত প্রগতিশীল জোটের (ইউপিএ) অন্যতম শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেস তিস্তার চুক্তির বিষয়টি তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। বিশেষ করে, আগামী বাজেটে রাজ্যের জন্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দ পেতে এ বিষয়টিতে অনড় থাকছে মমতার সরকার।
আর মমতার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না নিয়ে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ কাউকে পাঠাতে চাইছেন না মনমোহন সিং। তাই প্রণব মুখার্জির প্রস্তাবিত ঢাকা সফরের আগে রঞ্জন মাথাইকে কলকাতায় পাঠানো হয়। পরিকল্পনাটা এমন—ভারতের অর্থমন্ত্রী ঢাকায় গিয়ে যেন এমন কোনো প্রতিশ্রুতি না দেন, যাতে মনমোহন সিংকে বেকায়দায় পড়তে হয়।
No comments