ব্যক্তিত্ব-ইতিহাসই তাকে মহান করেছে by বদিউর রহমান

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, জাতীয় কোনো দিবসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু যে জাতির জনক_ তার স্বীকৃতি তো দূরে থাক, তাকে নিয়ে যৎসামান্য আলোকপাতও আশা করা যায়নি।


বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু এভিনিউকে বলা হতো বিবি এভিনিউ


আগস্ট মাসের অনেক ঘটনাই আমাদের জন্য শোকাবহ। ১৫ আগস্টের কারণে অর্থাৎ জাতির পিতার নৃশংস হত্যার কারণে এ দিবসটি এখন জাতীয় শোক দিবস। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে এ দিনটির গুরুত্ব বাড়ে আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এ দিবসটি যেন একেবারে সাদামাটা, অন্যসব দিনের মতোই একটা দিন জাতীয় জীবনে। মন-মানসিকতা আর কৃতজ্ঞতা-অকৃতজ্ঞতার বাছ-বিচারে আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির এমন একটা দুর্বৃত্তায়নে পড়ে গেছি যে, জাতির পিতার মূল্যায়নও যেন একপেশে, অনেকটা একটা দলের। যে বিএনপি জাতির পিতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে কার্পণ্য করে থাকে, সে বিএনপিও যে জাতির জনক না হলে, এ দেশ না হলে বিএনপিই হতে পারত না, তা-ই ভুলে যায়। '৭২-পূর্ববর্তী মুজিবকে-বঙ্গবন্ধুকে বিবেচনায় নিলেই তো তাকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতিতে বিএনপিরও কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। বিএনপি যদি চতুর্দশ সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে আর জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা-প্রচারকারীরূপে সংবিধানে স্থান করে দিয়ে যেত, তাহলে বরং ঐতিহাসিক মূল্যায়নে বিএনপিই বেশি উপকৃত হতো। আমার এ বিশ্বাস এখনও যেমন বলবত রয়েছে, তেমনি এ ধারণাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ যে, এবারের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুজিবনগর সরকারের ইশতেহার অন্তর্ভুক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অর্থাৎ শেখ মুজিবের পক্ষে জিয়ার প্রচারিত ঘোষণাও অন্তর্ভুক্ত করলে ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠিত হতো। রাজনৈতিক উদারতার এক উজ্জ্বল নজির সৃষ্টি হতো। দুই দল এবং বিশেষত দুই নেত্রী একজনকে আরেকজন যে একটুও সহ্য করতে পারেন না এবং তাদের আক্রমণ যে ব্যক্তিগত পর্যায়েও চলে যায়; তেমন অবস্থায় আমাদের অনেক আশাই কেবল আশাই থাকতে পারে, বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনায় যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে না। তার পরও আমরা আরও আশাবাদী হতে চাই। আমরা আশা করব, রাজনৈতিক লড়াই থাকলেও তা হবে আদর্শের ভিত্তিতে এবং রাজনৈতিক উদারতায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, জাতীয় কোনো দিবসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু যে জাতির জনক_ তার স্বীকৃতি তো দূরে থাক, তাকে নিয়ে যৎসামান্য আলোকপাতও আশা করা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু এভিনিউকে বলা হতো বিবি এভিনিউ। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানত না এই বিবির পূর্ণ শব্দ কী ছিল। বিএনপি আমলে জিয়ার বন্দনা ছিল অবারিত, ভাবটা যেন_ এ জিয়া না হলে বাংলাদেশটাই রসাতলে যেত। আবার আওয়ামী লীগ আমলে অনেকটা যুক্তিনির্ভর হলেও, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি হয় যে, কোনো কোনোটা তাকে অসম্মানের পর্যায়েও ফেলে দেয়। বঙ্গবন্ধু যে শুধু আওয়ামী লীগের নন, গোটা জাতির; দল-মত নির্বিশেষে সবার_ এ সত্যটাই যেন খোদ আওয়ামী লীগও ভুলে যায়। অতিরিক্ত আবেগ এবং বাস্তবতাবিবর্জিত একপেশিতা এমন অবস্থার সৃষ্টি করে মর্মে আমার ধারণা। এ অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগের মুক্ত হওয়া কাম্য এ জন্য যে, জাতির পিতাকে নির্বাসনের প্রচেষ্টা কোনো কাজে আসেনি, ইতিহাস তাকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে যাচ্ছে, তাতে আওয়ামী লীগের বাড়াবাড়ির কোনো অবদান আছে বলে একশ' ভাগ নিশ্চিত করা যাবে না। তবে আওয়ামী লীগ আমলে তাকে যথাযথ মর্যাদায় মূল্যায়ন জাতীয় দাবিরই বাস্তবায়ন, তাকে শুধু আওয়ামী লীগের দাবি হিসেবে বড় করে দেখা হবে বোকামি।
জাতীয় শোক দিবস পালন এবং এ দিনটি সরকারি ছুটি হওয়ার পেছনে আদালতের নির্দেশও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আওয়ামী লীগ আমলে আমি জাতীয় শোক দিবসে ৩২ নম্বরে যাই না, যেতে আগ্রহও হয় না। এ সময় মুজিবকোটধারীর সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, আমি অবাক হয়ে পড়ি। এ সময় ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরে যাওয়ার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে চিত্রটি পাল্টে যায়। আওয়ামী লীগের সদস্য না হয়েও আমি প্রত্যেকবার জাতীয় শোক দিবসে সেখানে যাই। আমি জাতির জনকের কাছে যাই; যাই এ জন্য যে, জাতির পিতা হওয়ার আগেও তার দর্শন পাওয়ার জন্য, এক নজর দেখার জন্য, '৭১-এর প্রচণ্ড আন্দোলনের দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই যেতাম। বিএনপি আমলে বারবার মুজিব আর জিয়াকে একপাল্লায় আনার চেষ্টাকে আমি হাস্যস্পদ বলতাম। আমি আমার ক্ষুদ্র লেখনীতে বারবার তা প্রকাশও করেছি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর স্তুতি করার লোকের অভাব নেই। আমলাদের চরিত্রেও তা আছে। জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর পর্যায়ে নেওয়ার অপচেষ্টা কিংবা বঙ্গবন্ধুকে জিয়ার, মানে টেনেহিঁচড়ে নামানোর কুচেষ্টার বিরুদ্ধে আমি লিখেছি। মুজিব আর জিয়া কখনও এক মানের নন, এক মানের হতেও পারবেন না, যতই বিএনপি শেখ মুজিবুর রহমানকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে এনে জিয়ার সঙ্গে মেলাতে কিংবা জিয়াকে টেনেটুনে লম্বা করে শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চতায় তুলতে চেষ্টা করুক না কেন। ওই লেখায় আমার বক্তব্য ছিল, পিতাকে পিতা বলতে এত কার্পণ্য কেন? পঞ্চদশ সংশোধনীতে সে কার্পণ্য দূর করা হয়েছে। এখন বিএপি বিরোধিতা অথবা খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালনে পিতার মর্যাদার এতটুকুও ক্ষতি হয় না, হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু দেশ সৃষ্টি করেছেন, দেশের জন্ম দিয়েছেন। তখন জিয়া মাত্র একজন মেজর, তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বেতার ঘোষণা দিয়েছেন। আমিও শুনেছি, অন্যরাও শুনেছেন। দু'জনই রাষ্ট্রপতি ছিলেন বলে এক হতে পারেন না।
জাতীয় শোক দিবসে খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন নিয়ে আওয়ামী লীগ অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের ভাষায়, এ অশোভন কাজটি না করার জন্য অনুরোধও করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া এতে কর্ণপাত করেননি, জন্মদিন পালন থেকে বিরত থাকেন না। এবারও ৬৭তম জন্মদিন হিসেবে ৬৭ পাউন্ডের কেক কেটেছেন, দলীয় অন্যান্য সংগঠনের আনা কেকও গুলশান কার্যালয়ে আদৃত হয়েছে। তবে ১৫ আগস্ট উপলক্ষে মওদুদ আহমদ এবার যেন কী সুরে একটা সত্য বলে ফেললেন! তিনি বঙ্গবন্ধু যে জিয়া থেকে অনেক ওপরে তা প্রকাশ্যেই স্বীকার করলেন এবং দলীয় রোষানলেও পড়লেন। আমি জন্মদিন-উৎসব আর মওদুদের বক্তব্যকে একটু ভিন্নভাবে দেখতে চাই। খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন নিয়ে আওয়ামী এবং শেখ হাসিনার অসন্তোষের সঙ্গেও আমি ঐকমত্য পোষণ করতে চাই না। আমার দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য হচ্ছে, ১৫ আগস্ট '৭৫-এর আগেই খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেছেন। অনেকে বলে থাকেন, খালেদা জিয়ার তিন তিনটি জন্মদিন রয়েছে এবং ১৫ আগস্ট তার ভুয়া জন্মদিন। নব্বইয়ের দশক থেকে রাজনৈতিক অশিষ্টতায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে তথা জাতির জনকের মৃত্যু দিবস, মূলত হত্যা দিবসকে বিকৃতভাবে উদযাপনের জন্যই জন্মদিন পালন করে থাকেন। আমি বলি, এ জন্মদিনটি তার ভুয়াই হোক আর আসলই হোক, এটা তার ব্যাপার। অতএব তিনি তার জন্মদিন পালন করলে অসুবিধা কোথায়? সিরাজ-উদ-দৌলা থাকলে তো মীরজাফর থাকবেনই। জগৎশেঠ আর ঘষেটি বেগমরা থাকলে তো মোহনলাল আর আলেয়ার থাকতেও কোনো বাধা নেই, নাকি? আমি বুঝে উঠতে পারি না, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা জাতীয় শোক দিবসের সর্বজনীন এবং আপামর জনগণের একাত্মতার বিপরীতে এক খালেদা জিয়ার একটা নগণ্য জন্মদিন পালনকে এত 'বড়' করে দেখতে চায়/চান কেন? আমাদের মনে রাখা দরকার যে, জোর করে বঙ্গবন্ধুকে বড় করার প্রয়োজন নেই। ইতিহাসই তাকে বড় করেছে, আরও বড় করে চলেছে; যতই দিন যাবে তার বড়ত্ব ততই বাড়তে থাকবে।
মওদুদ সাহেব সব হয়েছেন, শুধু রাষ্ট্রপতি হওয়াটা বাকি আছে। তার এটা হওয়ার চেষ্টা থাকতেই পারে। অন্য কারও সত্য কথনকে সহজ-সরলভাবে বিবেচনায় নিলেও মওদুদেরটা যেন না নেওয়া হয়। বদরুদ্দোজা-অলিদের খালেদাপ্রীতি দেখে মওদুদ নতুন 'চাল' হিসেবে এমনটি বলেননি_ তা যেন উড়িয়ে দেওয়া না হয়। ভাবটা এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, বিএনপিতে তো আছিই, এরশাদেও ছিলাম। এরশাদ আবার এখন আওয়ামী-দোস্ত, ভবিষ্যতে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সুযোগ পাওয়ার জন্য এখন থেকেই একটু পথ করে রাখি না কেন? মওদুদ আর মওদুদী_ উভয় থেকেই কিন্তু সাবধান থাকতে হবে। নিশ্চয়ই সাবধান থাকবেন শেখ হাসিনাও।

বদিউর রহমান : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের
সাবেক চেয়ারম্যান
 

No comments

Powered by Blogger.