নৌকা মার্কা জীবন! by ফজলুল বারী
বাংলাদেশের রাজনীতির চলতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার! অস্ট্রেলিয়ায় কার্বন ট্যাক্স, বোট পিপল আর সমকামী বিয়ে। পরিবেশবাদী-প্রাণী অধিকার রক্ষা আন্দোলনকারীরা যথেষ্ট শক্তিশালী এদেশে। বাংলাদেশে কোরবানির সময় যেভাবে রাস্তার পাশে গরু ধরেবেঁধে জবাই দেয়া হয়, ইন্দোনেশিয়ায় তেমন একটি গরু জবাইর ছবি এদেশের মিডিয়ায় প্রচারের পর প্রাণী অধিকার রক্ষা আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের মুখে সেদেশে জীবিত পশু রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে এদেশের সরকার।
অথচ অস্ট্রলিয়ার গবাদি পশু রপ্তানির বড় বাজার ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু জনমত বলে কথা! এদেশে আবার নানা সংস্থার করা প্রফেশনাল জনমত জরিপগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। পাঁচবছরের জন্যে নির্বাচিত হয়েছি বলে যা খুশি তাই করব বা নানা বাহানায় পার্লামেন্টে যাব না-- এসব এদেশে এমনটা কেউ করেন না বা করার সুযোগও নেই। করলে পলিটিক্যালি সোজা দিগম্বর করে ছেড়ে দেবে মিডিয়া। সরকারি টাকায় এদেশে এবিসি, এসবিএস টিভি-রেডিও এসব চলে। কিন্তু এসব দেখে সরকারি বা বিটিভি ভাবার সুযোগ নেই। কারণ মিডিয়াকে এখানে সারাক্ষণ জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কালো টাকা সাদা করার উদ্দেশে মিডিয়ার মালিক বা সম্পাদক বনে যাবার সুযোগও এদেশে নেই।
পরিবেশবাদী দল অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনসের সমর্থনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের লেবার পার্টির সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অস্ট্রেলিয়া আবার বিশ্বের এক নম্বর কয়লা রপ্তানিকারক দেশ। মাইনিং ইন্ডাস্ট্রি দেশটির আয়-রোজগারের এক নম্বর সোর্স। এসব মাইনিং কোম্পানিগুলোর কার্বন নিঃসরণ নিয়ে পরিবেশবাদীরা বিশেষ সোচ্চার। এর কারণে বিরোধীদল লিবারেল কোয়ালিশনের ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার এবার সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী পাঁচশ কোম্পানির বিরুদ্ধে আরোপ করেছে বিশেষ একটি কার্বন ট্যাক্স। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে এই ট্যাক্স কার্যকর করার পর থেকে দেশটির সবকিছুর প্রোডাকশন খরচের পাশাপাশি জীবনব্যয়ও অনেক বেড়ে যাবে। এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের জনপ্রিয়তাও এখন তলানির দিকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবেশবাদীদের কাছে দেওয়া অঙ্গীকারকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো সেইমসেক্স ম্যারেজ আন্দোলনটি অস্ট্রেলিয়াতেও বিশেষ শক্তিশালী। এমনিতে অস্ট্রেলিয়া গে ফ্রেন্ডলি দেশ। গে রাইটস সংবিধান স্বীকৃত। দেশটির নারী অর্থমন্ত্রী পেনি অং, ক্ষমতার শরিক অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনসের প্রধান বব ব্রাউনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেকে এ ব্যাপারে নিজেদের আইডেনটিটি প্রকাশ্য করে রেখেছেন। কিন্তু সমাজের বেশিরভাগ লোক বিয়ের ব্যাপারে ভিতর থেকে গোঁড়া। সে কারণে দেশের প্রধান দুটি দলের নীতিটাই হচ্ছে বিয়ে হবে একজন পুরুষ আর নারীর মধ্যে। কিন্তু ভিতর থেকে মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে প্রধান রাজনৈতিক দল দুটি বিয়ের আইনটি পাল্টাতে চলেছে। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীন কুইন্সল্যান্ড রাজ্য সরকারের পার্লামেন্টে এরই মধ্যে সেইমসেক্স ম্যারেজের পক্ষে আইন পাশ হয়েছে। এর পরপর লেবার পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে বিষয়টি ভোটাভুটিতে গেলে এর বিরোধিতাকারীরা সেখানে হেরে যায়। এখন এটিকে আইনে পরিণত করতে নতুন বছরের শুরুতে পার্লামেন্টে তা বিল আকারে পাশ করাতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার চলতি বিরোধীদল লিবারেল কোয়ালিশন তুলনামূলক রক্ষনশীল হলেও এ ইস্যুটিতে শক্ত বিরোধিতায় নেই। কারণ, ২০০৭ সালের নির্বাচনে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে গে কমিউনিটি কি রকম সংঘবদ্ধ ভূমিকা পালন করেছে তা দলটি ভুলে যায়নি।
এসব ছাড়িয়ে সারা বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বোট পিপল! উন্নত জীবনের আশায় ইন্দোনেশিয়া থেকে ছোট ছোট ইঞ্জিন-নৌকায় গায়ে লাইফ জ্যাকেট বেঁধে দলে দলে রওয়ানা দেয় এদেশে আশ্রয়প্রার্থীরা। ইন্দোনেশিয়ায় আবার এ ব্যাপারে সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় আছে। এমন লোকজনকে নিয়ে প্রায় নতুন বোট পৌঁছা বা বোট ডুবিতে করুণ মৃত্যুর বিষয়টি অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার প্রায় নিয়মিত খবর। অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রসীমায় পৌঁছুলে তাদের আটক করে ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামের একটি ভূখণ্ডে নিয়ে যায় এদেশের নৌবাহিনী। সেখানকার ডিটেনশন সেন্টারে এদের রেখে তাদের আবেদন জমা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপশি তাদের থাকা-খাওয়াসহ সব ব্যবস্থা করতে হয় এদেশের সরকারকে। এজন্য শরণার্থী তথা বোটপিপলদের খাতে এ দেশের বার্ষিক খরচের অংকটিও অনুল্লেখ্য বা ফেলনা নয়। কমনওয়েলথভূক্ত এ দেশটির আইন আবার এমন যে, কেউ যদি তার কাছে পৌঁছে প্রমাণ করতে পারে তার দেশে তার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ, ফেরত গেলে মেরে ফেলতে পারে, তাহলে এ রাষ্ট্র তাকে আশ্রয় দিতে বাধ্য। এর জন্যে যখন যেদেশে যুদ্ধবিগ্রহ বা অবরুদ্ধ অবস্থা বেশি চলে তখন সে দেশ থেকে অস্ট্রলিয়ায় লোকজন বেশি আসেন।
কিন্তু বেশিরভাগ লোকজন এখানে যার যার দেশ থেকে জোগাড় করে আনা ভূয়া কাগজপত্র জমা দেয়। অস্ট্রলিয়ান সরকার আবার এসব কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দেশের নামীদামী প্রতিষ্ঠান, ল-ফার্মকে দিয়ে পরীক্ষা করায়। যেমন বাংলাদেশের এমন কারো আবেদনের সত্যতা ড কামাল, ড জহিরের ল ফার্মের মতো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তদন্ত, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায় ঢাকার অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন। এ ধরনের ভালো পেমেন্টের কাজ আরও বেশি নিয়মিত পেতে এসব প্রতিষ্ঠানও শতভাগ স্বচ্ছতা নিয়ে এসব কাজ করার চেষ্টা করে।
কিন্তু কারও আবেদন প্রত্যাখ্যান হলেও সব রকম আইনগত আনুষ্ঠানিকতা তথা সবকটি কোর্টের চৌকাঠ পেরুনোর আগে এমন কাউকে জোর করে এখান থেকে জোর করে বের করে দেবারও সুযোগ নেই। আবেদনকারীরাও সরকারি খরচে এক কোর্টে হারলে মামলা করে আরেক কোর্টে। এভাবে মামলার ধারাবাহিকতায় এসব আশ্রয়প্রার্থীর সিডনি-মেলবোর্নের মতো শহরগুলোর জেলখানা তথা ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে স্থানান্তর করা হয়। বছরের পর বছর অনেকের এমন বন্দী জীবন চলে। সাগরে বোট তথা নৌকায় ভেসে আসার কারণে এ জীবনকে উপহাস করে তাদের অনেকে বলেন নৌকা মার্কা জীবন। যে স্বপ্নের মতো গল্প শুনে জীবনঝুঁকির সাগরযাত্রায় রওয়ানা দিয়েছিলেন, সেটি স্বপ্নের মতো বাস্তব নয়। অনেক অনেক বেশি কঠিন।
এমন একজনের সঙ্গে একবার সরাসরি আলাপের সুযোগ হয়েছে। এক গভীর রাতে অনলাইন চ্যাটিংএ কমলেশ নামের একজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা যায়, তিনি সিডনির ভিলাউড ডিটেনশন সেন্টারে আছেন। জাতিতে শ্রীলংকান তামিল। তার মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিবেচনাধীন। একদিন কমলেশের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জানা হয় তার জীবন। তাদের দলটি ইন্দোনেশিয়া নয়, বোট নিয়ে সরাসরি শ্রীলংকা থেকে ভেসে এসেছেন। পথে তাদের বোটের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেলে ওভাবে সাগরে ভাসেন কয়েক দিন। দলের একজন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে অস্ট্রেলিয়ার নৌসীমার মধ্যে পৌঁছবার পর মরণাপন্ন সহযাত্রীর অবস্থার জন্য এসওএস পাঠান অস্ট্রেলিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে।
অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর টহল জাহাজ পরে তাদের উদ্ধার করে ক্রিসমাস আইল্যান্ডে নিয়ে যায়। সেখানে আটমাস থাকার পর তাকে স্থানান্তর করা হয় ভিলাউড ডিটেনশন সেন্টারে। এখানে খাওয়া-পরার পাশাপাশি সপ্তাহে হাতখরচা দেয়া হয় পঞ্চাশ ডলার। দিনে একঘণ্টা করে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়। পরিচিতির চ্যাটিংএর সময় আনলিমিটেড ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ছিল কমলেশের। সুযোগটি সম্পর্কেও মজার একটি গল্প বলেন। একবার মারামারিতে জড়ানোর কারণে তাকে স্থানান্তর করা হয় ডিটেনশন সেন্টারের বিশেষ একটি অংশে। সেখানে বন্দীর সংখ্যা কম হওয়াতে তারা সেখানে আনলিমিটেড সময় নেট ব্যবহারের সুযোগ পেতেন।
অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন ইচ্ছুক এসব অ্যাসাইলাম সিকার বন্দীদের নিয়ে ইদানিং অনেক সমস্যা হচ্ছে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এরা প্রায় এসব ডিটেনশন সেন্টারে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে পোড়া ছাদের ওপর উঠে গিয়ে ঝাপ দিয়ে আত্মহননের হুমকি দেয়। টেলিভিশনে এসব পরিস্থিতির লাইভ সম্প্রচার করা হয়। বিষয়টি উত্তাপ ছড়ায় রাজনীতি, মিডিয়া, টকশোর টেবিল পর্যন্ত।
এসব কারণে এদেরকে অফসোর প্রসেসিংএ বিদেশের কোথাও স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে এদেশের সরকার। পূর্ব তিমুর রাজি না হওয়াতে এমন বোট পিপলদের মালয়েশিয়ায় স্থানান্তরের উদ্দেশে সরকার সে দেশটির সঙ্গে একটি চুক্তিও করেছে। চুক্তি অনুসারে এমন আটশ অভিবাসন প্রার্থীকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হবে। শরণার্থী হিসাবে প্রটেকশন পাবার যোগ্য চিহ্নিত হলে শুধু তাদের না, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জেলখানায় আটক এমন পাঁচ হাজার প্রার্থীকে প্রতি বছর আশ্রয় দেবে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু গোল বেঁধেছে আরেক জায়গায়। শরণার্থীদের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি মালয়েশিয়া। সে কারণে জাতিসংঘ উদ্বাস্তু হাইকমিশন আপত্তি তুললে বিষয়টি স্থানীয় রাজনীতির ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এদের এভাবে মালয়েশিয়ার মতো দেশের হাতে তুলে দেবার বিরোধী।
এমনিতে অভিবাসীদের দেশ অস্ট্রেলিয়া। এদেশের পুরনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়া আর সব মানুষই কোনও না কোনভাবে অভিবাসন নিয়ে এদেশে এসেছেন। কিন্তু মাইগ্রেশন সাইকোলজিটা হচ্ছে কেউ কোথায় নিজে মাইগ্রেশন পেয়ে গেলে গেল গেল রব তুলে আরেকজনের মাইগ্রেশনে আপত্তি করে। এর কারণে এটি এখানে ভোটের রাজনীতিতেও বরাবর ইস্যু হয়।
বাংলাদেশের বিএনপি যেমন নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশটা ইন্ডিয়া হয়ে যাবার কথা বেশি করে বলে, তেমনি এদের লিবারেল কোয়ালিশন রব তুলে বলে, লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে ইন্দোনেশিয়া থেকে নৌকায় আসা লোকজনে ভরে যাবে দেশ।
বোট পিপলরা লিবারেলদের সময়ও এসেছে, এখনও আসছে, কিন্তু লিবারেলরা বরাবর বলছে এরা আসছে লেবার পার্টির দুর্বলতার কারণে। বাইরে এদের বিরুদ্ধে বললেও ভিতরে ভিতরে তারা এদের আশ্রয় দেবার পক্ষে। বোট পিপল ইস্যু এমন একটি অনিবার্য সমস্যা অস্ট্রেলিয়ান সমাজ আর রাজনীতিতে। বোটে মানুষ আসা, উত্তাল সাগরে বোট ডুবে করুণ মৃত্যু উভয়ই হামেশা চলছে।
পরিবেশবাদী দল অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনসের সমর্থনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের লেবার পার্টির সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অস্ট্রেলিয়া আবার বিশ্বের এক নম্বর কয়লা রপ্তানিকারক দেশ। মাইনিং ইন্ডাস্ট্রি দেশটির আয়-রোজগারের এক নম্বর সোর্স। এসব মাইনিং কোম্পানিগুলোর কার্বন নিঃসরণ নিয়ে পরিবেশবাদীরা বিশেষ সোচ্চার। এর কারণে বিরোধীদল লিবারেল কোয়ালিশনের ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার এবার সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী পাঁচশ কোম্পানির বিরুদ্ধে আরোপ করেছে বিশেষ একটি কার্বন ট্যাক্স। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে এই ট্যাক্স কার্যকর করার পর থেকে দেশটির সবকিছুর প্রোডাকশন খরচের পাশাপাশি জীবনব্যয়ও অনেক বেড়ে যাবে। এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের জনপ্রিয়তাও এখন তলানির দিকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবেশবাদীদের কাছে দেওয়া অঙ্গীকারকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো সেইমসেক্স ম্যারেজ আন্দোলনটি অস্ট্রেলিয়াতেও বিশেষ শক্তিশালী। এমনিতে অস্ট্রেলিয়া গে ফ্রেন্ডলি দেশ। গে রাইটস সংবিধান স্বীকৃত। দেশটির নারী অর্থমন্ত্রী পেনি অং, ক্ষমতার শরিক অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনসের প্রধান বব ব্রাউনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেকে এ ব্যাপারে নিজেদের আইডেনটিটি প্রকাশ্য করে রেখেছেন। কিন্তু সমাজের বেশিরভাগ লোক বিয়ের ব্যাপারে ভিতর থেকে গোঁড়া। সে কারণে দেশের প্রধান দুটি দলের নীতিটাই হচ্ছে বিয়ে হবে একজন পুরুষ আর নারীর মধ্যে। কিন্তু ভিতর থেকে মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে প্রধান রাজনৈতিক দল দুটি বিয়ের আইনটি পাল্টাতে চলেছে। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীন কুইন্সল্যান্ড রাজ্য সরকারের পার্লামেন্টে এরই মধ্যে সেইমসেক্স ম্যারেজের পক্ষে আইন পাশ হয়েছে। এর পরপর লেবার পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে বিষয়টি ভোটাভুটিতে গেলে এর বিরোধিতাকারীরা সেখানে হেরে যায়। এখন এটিকে আইনে পরিণত করতে নতুন বছরের শুরুতে পার্লামেন্টে তা বিল আকারে পাশ করাতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার চলতি বিরোধীদল লিবারেল কোয়ালিশন তুলনামূলক রক্ষনশীল হলেও এ ইস্যুটিতে শক্ত বিরোধিতায় নেই। কারণ, ২০০৭ সালের নির্বাচনে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে গে কমিউনিটি কি রকম সংঘবদ্ধ ভূমিকা পালন করেছে তা দলটি ভুলে যায়নি।
এসব ছাড়িয়ে সারা বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বোট পিপল! উন্নত জীবনের আশায় ইন্দোনেশিয়া থেকে ছোট ছোট ইঞ্জিন-নৌকায় গায়ে লাইফ জ্যাকেট বেঁধে দলে দলে রওয়ানা দেয় এদেশে আশ্রয়প্রার্থীরা। ইন্দোনেশিয়ায় আবার এ ব্যাপারে সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় আছে। এমন লোকজনকে নিয়ে প্রায় নতুন বোট পৌঁছা বা বোট ডুবিতে করুণ মৃত্যুর বিষয়টি অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার প্রায় নিয়মিত খবর। অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রসীমায় পৌঁছুলে তাদের আটক করে ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামের একটি ভূখণ্ডে নিয়ে যায় এদেশের নৌবাহিনী। সেখানকার ডিটেনশন সেন্টারে এদের রেখে তাদের আবেদন জমা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপশি তাদের থাকা-খাওয়াসহ সব ব্যবস্থা করতে হয় এদেশের সরকারকে। এজন্য শরণার্থী তথা বোটপিপলদের খাতে এ দেশের বার্ষিক খরচের অংকটিও অনুল্লেখ্য বা ফেলনা নয়। কমনওয়েলথভূক্ত এ দেশটির আইন আবার এমন যে, কেউ যদি তার কাছে পৌঁছে প্রমাণ করতে পারে তার দেশে তার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ, ফেরত গেলে মেরে ফেলতে পারে, তাহলে এ রাষ্ট্র তাকে আশ্রয় দিতে বাধ্য। এর জন্যে যখন যেদেশে যুদ্ধবিগ্রহ বা অবরুদ্ধ অবস্থা বেশি চলে তখন সে দেশ থেকে অস্ট্রলিয়ায় লোকজন বেশি আসেন।
কিন্তু বেশিরভাগ লোকজন এখানে যার যার দেশ থেকে জোগাড় করে আনা ভূয়া কাগজপত্র জমা দেয়। অস্ট্রলিয়ান সরকার আবার এসব কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দেশের নামীদামী প্রতিষ্ঠান, ল-ফার্মকে দিয়ে পরীক্ষা করায়। যেমন বাংলাদেশের এমন কারো আবেদনের সত্যতা ড কামাল, ড জহিরের ল ফার্মের মতো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তদন্ত, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায় ঢাকার অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন। এ ধরনের ভালো পেমেন্টের কাজ আরও বেশি নিয়মিত পেতে এসব প্রতিষ্ঠানও শতভাগ স্বচ্ছতা নিয়ে এসব কাজ করার চেষ্টা করে।
কিন্তু কারও আবেদন প্রত্যাখ্যান হলেও সব রকম আইনগত আনুষ্ঠানিকতা তথা সবকটি কোর্টের চৌকাঠ পেরুনোর আগে এমন কাউকে জোর করে এখান থেকে জোর করে বের করে দেবারও সুযোগ নেই। আবেদনকারীরাও সরকারি খরচে এক কোর্টে হারলে মামলা করে আরেক কোর্টে। এভাবে মামলার ধারাবাহিকতায় এসব আশ্রয়প্রার্থীর সিডনি-মেলবোর্নের মতো শহরগুলোর জেলখানা তথা ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে স্থানান্তর করা হয়। বছরের পর বছর অনেকের এমন বন্দী জীবন চলে। সাগরে বোট তথা নৌকায় ভেসে আসার কারণে এ জীবনকে উপহাস করে তাদের অনেকে বলেন নৌকা মার্কা জীবন। যে স্বপ্নের মতো গল্প শুনে জীবনঝুঁকির সাগরযাত্রায় রওয়ানা দিয়েছিলেন, সেটি স্বপ্নের মতো বাস্তব নয়। অনেক অনেক বেশি কঠিন।
এমন একজনের সঙ্গে একবার সরাসরি আলাপের সুযোগ হয়েছে। এক গভীর রাতে অনলাইন চ্যাটিংএ কমলেশ নামের একজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা যায়, তিনি সিডনির ভিলাউড ডিটেনশন সেন্টারে আছেন। জাতিতে শ্রীলংকান তামিল। তার মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিবেচনাধীন। একদিন কমলেশের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জানা হয় তার জীবন। তাদের দলটি ইন্দোনেশিয়া নয়, বোট নিয়ে সরাসরি শ্রীলংকা থেকে ভেসে এসেছেন। পথে তাদের বোটের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেলে ওভাবে সাগরে ভাসেন কয়েক দিন। দলের একজন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে অস্ট্রেলিয়ার নৌসীমার মধ্যে পৌঁছবার পর মরণাপন্ন সহযাত্রীর অবস্থার জন্য এসওএস পাঠান অস্ট্রেলিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে।
অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর টহল জাহাজ পরে তাদের উদ্ধার করে ক্রিসমাস আইল্যান্ডে নিয়ে যায়। সেখানে আটমাস থাকার পর তাকে স্থানান্তর করা হয় ভিলাউড ডিটেনশন সেন্টারে। এখানে খাওয়া-পরার পাশাপাশি সপ্তাহে হাতখরচা দেয়া হয় পঞ্চাশ ডলার। দিনে একঘণ্টা করে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়। পরিচিতির চ্যাটিংএর সময় আনলিমিটেড ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ছিল কমলেশের। সুযোগটি সম্পর্কেও মজার একটি গল্প বলেন। একবার মারামারিতে জড়ানোর কারণে তাকে স্থানান্তর করা হয় ডিটেনশন সেন্টারের বিশেষ একটি অংশে। সেখানে বন্দীর সংখ্যা কম হওয়াতে তারা সেখানে আনলিমিটেড সময় নেট ব্যবহারের সুযোগ পেতেন।
অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন ইচ্ছুক এসব অ্যাসাইলাম সিকার বন্দীদের নিয়ে ইদানিং অনেক সমস্যা হচ্ছে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এরা প্রায় এসব ডিটেনশন সেন্টারে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে পোড়া ছাদের ওপর উঠে গিয়ে ঝাপ দিয়ে আত্মহননের হুমকি দেয়। টেলিভিশনে এসব পরিস্থিতির লাইভ সম্প্রচার করা হয়। বিষয়টি উত্তাপ ছড়ায় রাজনীতি, মিডিয়া, টকশোর টেবিল পর্যন্ত।
এসব কারণে এদেরকে অফসোর প্রসেসিংএ বিদেশের কোথাও স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে এদেশের সরকার। পূর্ব তিমুর রাজি না হওয়াতে এমন বোট পিপলদের মালয়েশিয়ায় স্থানান্তরের উদ্দেশে সরকার সে দেশটির সঙ্গে একটি চুক্তিও করেছে। চুক্তি অনুসারে এমন আটশ অভিবাসন প্রার্থীকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হবে। শরণার্থী হিসাবে প্রটেকশন পাবার যোগ্য চিহ্নিত হলে শুধু তাদের না, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জেলখানায় আটক এমন পাঁচ হাজার প্রার্থীকে প্রতি বছর আশ্রয় দেবে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু গোল বেঁধেছে আরেক জায়গায়। শরণার্থীদের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি মালয়েশিয়া। সে কারণে জাতিসংঘ উদ্বাস্তু হাইকমিশন আপত্তি তুললে বিষয়টি স্থানীয় রাজনীতির ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এদের এভাবে মালয়েশিয়ার মতো দেশের হাতে তুলে দেবার বিরোধী।
এমনিতে অভিবাসীদের দেশ অস্ট্রেলিয়া। এদেশের পুরনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়া আর সব মানুষই কোনও না কোনভাবে অভিবাসন নিয়ে এদেশে এসেছেন। কিন্তু মাইগ্রেশন সাইকোলজিটা হচ্ছে কেউ কোথায় নিজে মাইগ্রেশন পেয়ে গেলে গেল গেল রব তুলে আরেকজনের মাইগ্রেশনে আপত্তি করে। এর কারণে এটি এখানে ভোটের রাজনীতিতেও বরাবর ইস্যু হয়।
বাংলাদেশের বিএনপি যেমন নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশটা ইন্ডিয়া হয়ে যাবার কথা বেশি করে বলে, তেমনি এদের লিবারেল কোয়ালিশন রব তুলে বলে, লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে ইন্দোনেশিয়া থেকে নৌকায় আসা লোকজনে ভরে যাবে দেশ।
বোট পিপলরা লিবারেলদের সময়ও এসেছে, এখনও আসছে, কিন্তু লিবারেলরা বরাবর বলছে এরা আসছে লেবার পার্টির দুর্বলতার কারণে। বাইরে এদের বিরুদ্ধে বললেও ভিতরে ভিতরে তারা এদের আশ্রয় দেবার পক্ষে। বোট পিপল ইস্যু এমন একটি অনিবার্য সমস্যা অস্ট্রেলিয়ান সমাজ আর রাজনীতিতে। বোটে মানুষ আসা, উত্তাল সাগরে বোট ডুবে করুণ মৃত্যু উভয়ই হামেশা চলছে।
No comments