জলবায়ু সম্মেলন-প্রতীকী নয়, প্রয়োজন প্রকৃত জলবায়ু-আদালত by এম এম খালেকুজ্জামান
২০১৫ সালের মধ্যে নতুন চুক্তি করার আশার ফানুস উড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে শেষ হলো জলবায়ুবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন। বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে আগামী বছর থেকে এই চুক্তির জন্য কাজ শুরু করা হবে এবং ২০২০ সালের মধ্যে তা কার্যকর করা হবে। এ ছাড়া কপ সেভেন্টিনে আর যেসব বিষয়ে মতৈক্য হয় তা হচ্ছে, কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানো হবে এবং গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড গঠনে উদ্যোগ নেওয়া হবে। যদিও দরিদ্র
দেশগুলোর সহায়তার জন্য ২০০৯ সালের কপ সিক্সটিন সম্মেলনেই এই ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবার বিশ্বজুড়ে বনভূমি রক্ষার বিষয়টিতেও জোর দেওয়া হয়েছে এবং কার্বন নিঃসরণ পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের (সবচয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ) মতো প্রভাবশালী দেশগুলোকে কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে? এ প্রশ্নের উত্তর হতে পারে একটি বৈশ্বিক জলবায়ু-আদালত।
গত বছর মেক্সিকোর কানকুনের সম্মেলনটিও বড় কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়া শেষ হয়েছিল। তবে ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অন্যতম দাবি ছিল জলবায়ু-আদালত গঠন।
স্ট্যান্ড বিসাইড বাংলাদেশ-ভিকটিম অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (Stand beside Bangladesh-Victim of climate change) অর্থাৎ জলবায়ু দুর্গত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান—এমন আর্তিমাখা আবেদন নিয়ে ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। বন্যার ঝুঁকিতে প্রথম, সুনামির ঝুঁকিতে তৃতীয় আর ঘূর্ণিঝড়ের জন্য ষষ্ঠ বাংলাদেশ-‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ডিজাস্টার রিডাকশন’-এর সরবরাহ করা এমন তথ্য তুলে ধরে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হয়েও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান যেন এক ‘ন্যাচারাল প্যারাডক্স’।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মো. নাশিদকে ওয়েবভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যম টেকপার্ট -এর সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, সাগরবুকে তলিয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে থাকা দেশটির জনগণকে তিনি অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার কথা চিন্তা করছেন কি না। প্রেসিডেন্টের দুঃখ ভারাক্রান্ত উত্তর ছিল এমন, প্রায় ১০ হাজার বছর এই দ্বীপসমূহে মানুষের বাস। আমাদের লিখিত ইতিহাসের বয়স প্রায় দুই হাজার বছর। দ্বীপের মানুষ কোথাও যেতে ইচ্ছুক নয়, এমনকি তারা মালদ্বীপেরই এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যেতে চায় না। এ ঘটনাটির মাধ্যমে বোঝা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের হাজার বছরের বসতি বিলুপ্তির আশঙ্কাকে সামনে রেখে বিশ্ববাসীর আরও সতর্ক এবং সহানুভূতিশীল হওয়ার সময় এসেছে।
ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে অন্যায়-অনাচারের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার যথার্থ উপস্থিতি। অপরাধমূলক কাজ করলে যেমন শারীরিক শাস্তি ও অধিকার ভঙ্গের দায়ে জরিমানার মাধ্যমে দেওয়ানি প্রতিকারের ব্যবস্থা, ঠিক তেমনি পরিবেশদূষণের ধারায় জলবায়ুর যে প্রায় প্রতিকারহীন ক্ষতি উন্নত রাষ্ট্রসমূহ করে চলেছে তারও ক্ষতিপূরণ বা জরিমানার ব্যবস্থা থাকা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্নভাবে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামসমূহে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির জন্য দায়ী পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর যথাযথ দায়িত্ব পালনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এ রকম বাস্তবতায় ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকায় আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামের উদ্যোগে বিশ্বে প্রথম প্রতীকী জলবায়ু আদালত গঠন করে (যদিও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ২০০৯ সালে ব্যাংককে গঠিত জলবায়ু আদালতকে প্রথম জলবায়ু আদালত বলে অভিহিত করেন)। রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, সমন্বয়ে গঠিত জুরি বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টির হাউস অব কমন্স সদস্য রুশনারা আলী, অক্সফামের কান্ট্রি ডিরেক্টর গ্যারেথ প্রাইস জোন্স, বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার চারজন ফরিয়াদি তাঁদের ক্ষতি ও বঞ্চনার বিষয়ে বিবৃতি দেন আদালতে। তাঁদের একজন বরগুনার জেলেপল্লির ৩৫ বছর বয়সী মমতাজ জানান, স্ত্রী ও চার সন্তান রেখে তাঁর স্বামী মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ হন চিরতরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের খামখেয়ালিতে মমতাজকে বরণ করতে হয় বৈধব্য আর চার সন্তান নিয়ে একজীবনের অনিশ্চয়তা। এ রকম শত শত জেলে বছর বছর হারিয়ে যান সাগরবুকে। আবার নদীভাঙনে আর মরুকরণে ঘরহীন হচ্ছে সহস্য জলবায়ু শরণার্থী। অক্সফামের মতে, বিষয়টি জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। উন্নত বিশ্বের ভোগবাদিতা ও যথেচ্ছ নগরায়ণের অভিঘাতে জলবায়ু আজ বিপর্যস্ত। প্রথম বিশ্বের নাগরিকদের লোভ ও লাভের দায় মেটাতে হয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পরিবেশ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে।
ট্রায়াল স্মেলটার আর্বিট্রেশন-১৯৩৮ (Trial Smelter Arbitration-1938) যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পরিবেশ বিরোধ নিষ্পত্তির নজিরটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ট্রায়ালে খনি খননকারী প্রতিষ্ঠানের আকরিক উত্তোলন ও গলানোর প্ল্যান্টের নির্গত সালফার ডাই-অক্সাইড যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী বিশাল অঞ্চলের চারণভূমি, চাষের জমি তথা পরিবেশের ক্ষতি করে আসছিল। ১৯২৫ সালের পর ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে ১৯০৯ সালে সম্পাদিত সীমান্ত পানি চুক্তির জন্য গঠিত কমিশনে মীমাংসার জন্য পাঠানো হয়। ১৯৩১ সালে কমিশন সিদ্ধান্ত দেয়, পরের বছর পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে সাড়ে তিন লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আমেরিকাকে। সেই সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গমন বন্ধ করতে হবে। ১৯৩৫ সালেও পুনরায় অভিযোগ তুললে দুই দেশের সম্মতিতে তিনজন সালিসকার ও দুই দেশের বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে গঠিত আর্বিট্রেশন কমিটিতে পাঠানো হয়। এর ভিত্তিতে কমিটি রায় দেয়, আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে কোনো দেশ নিজ ভূ-খণ্ড এমনভাবে ব্যবহার করবে না যাতে অন্য দেশের ভূ-খণ্ডের সম্পদ ও অধিবাসীদের কোনো ক্ষতি হয়। (সূত্র: The American Journal of International Law)
পরিবেশদূষণের কারণে রাষ্ট্রীয় দায় নির্ণয়ের চমৎকার একটি দৃষ্টান্ত এ মামলাটি। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির শিকার দেশগুলো জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে একটি সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ-আদালত বা জলবায়ু ট্রাইব্যুনালের জন্য কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন পরিবেশ সম্মেলনে দাবি তুলে আসছে। কোপেনহেগেন পরিবেশ সম্মেলনে বলিভিয়ার প্রতিনিধিরা পরিবেশ-আদালত ও পরিবেশ-পুলিশ গঠনের দাবিতে জোরালো অবস্থান নিলেও দূষণকারী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর বিরোধিতার কারণে সম্ভব হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণেই কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর করেনি যুক্তরাষ্ট্র। কানাডা স্বাক্ষর করেও কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়েছে ২৬ শতাংশ।
যথাযথ আইনি কাঠামো ও প্রতিকার বিধানের অনুপস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে ধনী দেশগুলো। এবার ডারবানেও দেখা গেল, প্রভাবশালী দেশগুলোর মতামতই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে কি ক্ষতির শিকার হয়েও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবি ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে ক্ষতিগ্রস্তরা? এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল অক্সফাম আয়োজিত প্রতীকী জলবায়ু আদালতের পর্যবেক্ষক ব্যারিস্টার রিচার্ড লর্ড কিউসিকে। তিনি বলেন, যদিও আন্তর্জাতিক জলবায়ু আইন বা আদালত বলে কিছু নেই, অ্যাটমোস্ফিরিক লিটিগেশান ট্রাস্ট আইনটিও ভ্রূণ পর্যায়ে, তার পরও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন আইন, ডিক্লারেশন, কনভেনশন ও আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তিগুলো অবলম্বন করে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যেতে পারে।
ইউএনএফসিসি (UNFCC) ও আইপিসিসির (IPCC) মতো আন্তর্জাতিক কাঠামোর সংগৃহীত পরিসংখ্যানগুলো সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির খতিয়ান ও পরিসংখ্যান আরও সুচারুরূপে সংরক্ষণ করে ক্ষতির কারণ হিসেবে এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ক্ষতিসৃষ্টিকারী পক্ষ থেকে বেশি দক্ষতা দেখাতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণ চাওয়াটা রাজনৈতিক হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় পেশাদারির দাবি করে। এডাপটেশন, মিটিগেশন খাতে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরের জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলারের যে তহবিল রয়েছে, তা থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় সহজ হতে পারে একটি উপযুক্ত জলবায়ু আদালতের উপস্থিতিতে। আইসিসি, আইসিজে, ডব্লিটিওর আদলে একটি আন্তর্জাতিক জলবায়ু-আদালত জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। khaliik@yahoo.com
গত বছর মেক্সিকোর কানকুনের সম্মেলনটিও বড় কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়া শেষ হয়েছিল। তবে ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অন্যতম দাবি ছিল জলবায়ু-আদালত গঠন।
স্ট্যান্ড বিসাইড বাংলাদেশ-ভিকটিম অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (Stand beside Bangladesh-Victim of climate change) অর্থাৎ জলবায়ু দুর্গত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান—এমন আর্তিমাখা আবেদন নিয়ে ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। বন্যার ঝুঁকিতে প্রথম, সুনামির ঝুঁকিতে তৃতীয় আর ঘূর্ণিঝড়ের জন্য ষষ্ঠ বাংলাদেশ-‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ডিজাস্টার রিডাকশন’-এর সরবরাহ করা এমন তথ্য তুলে ধরে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হয়েও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান যেন এক ‘ন্যাচারাল প্যারাডক্স’।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মো. নাশিদকে ওয়েবভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যম টেকপার্ট -এর সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, সাগরবুকে তলিয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে থাকা দেশটির জনগণকে তিনি অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার কথা চিন্তা করছেন কি না। প্রেসিডেন্টের দুঃখ ভারাক্রান্ত উত্তর ছিল এমন, প্রায় ১০ হাজার বছর এই দ্বীপসমূহে মানুষের বাস। আমাদের লিখিত ইতিহাসের বয়স প্রায় দুই হাজার বছর। দ্বীপের মানুষ কোথাও যেতে ইচ্ছুক নয়, এমনকি তারা মালদ্বীপেরই এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যেতে চায় না। এ ঘটনাটির মাধ্যমে বোঝা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের হাজার বছরের বসতি বিলুপ্তির আশঙ্কাকে সামনে রেখে বিশ্ববাসীর আরও সতর্ক এবং সহানুভূতিশীল হওয়ার সময় এসেছে।
ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে অন্যায়-অনাচারের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার যথার্থ উপস্থিতি। অপরাধমূলক কাজ করলে যেমন শারীরিক শাস্তি ও অধিকার ভঙ্গের দায়ে জরিমানার মাধ্যমে দেওয়ানি প্রতিকারের ব্যবস্থা, ঠিক তেমনি পরিবেশদূষণের ধারায় জলবায়ুর যে প্রায় প্রতিকারহীন ক্ষতি উন্নত রাষ্ট্রসমূহ করে চলেছে তারও ক্ষতিপূরণ বা জরিমানার ব্যবস্থা থাকা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্নভাবে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামসমূহে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির জন্য দায়ী পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর যথাযথ দায়িত্ব পালনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এ রকম বাস্তবতায় ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকায় আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামের উদ্যোগে বিশ্বে প্রথম প্রতীকী জলবায়ু আদালত গঠন করে (যদিও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ২০০৯ সালে ব্যাংককে গঠিত জলবায়ু আদালতকে প্রথম জলবায়ু আদালত বলে অভিহিত করেন)। রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, সমন্বয়ে গঠিত জুরি বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টির হাউস অব কমন্স সদস্য রুশনারা আলী, অক্সফামের কান্ট্রি ডিরেক্টর গ্যারেথ প্রাইস জোন্স, বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার চারজন ফরিয়াদি তাঁদের ক্ষতি ও বঞ্চনার বিষয়ে বিবৃতি দেন আদালতে। তাঁদের একজন বরগুনার জেলেপল্লির ৩৫ বছর বয়সী মমতাজ জানান, স্ত্রী ও চার সন্তান রেখে তাঁর স্বামী মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ হন চিরতরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের খামখেয়ালিতে মমতাজকে বরণ করতে হয় বৈধব্য আর চার সন্তান নিয়ে একজীবনের অনিশ্চয়তা। এ রকম শত শত জেলে বছর বছর হারিয়ে যান সাগরবুকে। আবার নদীভাঙনে আর মরুকরণে ঘরহীন হচ্ছে সহস্য জলবায়ু শরণার্থী। অক্সফামের মতে, বিষয়টি জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। উন্নত বিশ্বের ভোগবাদিতা ও যথেচ্ছ নগরায়ণের অভিঘাতে জলবায়ু আজ বিপর্যস্ত। প্রথম বিশ্বের নাগরিকদের লোভ ও লাভের দায় মেটাতে হয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পরিবেশ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে।
ট্রায়াল স্মেলটার আর্বিট্রেশন-১৯৩৮ (Trial Smelter Arbitration-1938) যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পরিবেশ বিরোধ নিষ্পত্তির নজিরটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ট্রায়ালে খনি খননকারী প্রতিষ্ঠানের আকরিক উত্তোলন ও গলানোর প্ল্যান্টের নির্গত সালফার ডাই-অক্সাইড যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী বিশাল অঞ্চলের চারণভূমি, চাষের জমি তথা পরিবেশের ক্ষতি করে আসছিল। ১৯২৫ সালের পর ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে ১৯০৯ সালে সম্পাদিত সীমান্ত পানি চুক্তির জন্য গঠিত কমিশনে মীমাংসার জন্য পাঠানো হয়। ১৯৩১ সালে কমিশন সিদ্ধান্ত দেয়, পরের বছর পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে সাড়ে তিন লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আমেরিকাকে। সেই সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গমন বন্ধ করতে হবে। ১৯৩৫ সালেও পুনরায় অভিযোগ তুললে দুই দেশের সম্মতিতে তিনজন সালিসকার ও দুই দেশের বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে গঠিত আর্বিট্রেশন কমিটিতে পাঠানো হয়। এর ভিত্তিতে কমিটি রায় দেয়, আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে কোনো দেশ নিজ ভূ-খণ্ড এমনভাবে ব্যবহার করবে না যাতে অন্য দেশের ভূ-খণ্ডের সম্পদ ও অধিবাসীদের কোনো ক্ষতি হয়। (সূত্র: The American Journal of International Law)
পরিবেশদূষণের কারণে রাষ্ট্রীয় দায় নির্ণয়ের চমৎকার একটি দৃষ্টান্ত এ মামলাটি। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির শিকার দেশগুলো জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে একটি সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ-আদালত বা জলবায়ু ট্রাইব্যুনালের জন্য কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন পরিবেশ সম্মেলনে দাবি তুলে আসছে। কোপেনহেগেন পরিবেশ সম্মেলনে বলিভিয়ার প্রতিনিধিরা পরিবেশ-আদালত ও পরিবেশ-পুলিশ গঠনের দাবিতে জোরালো অবস্থান নিলেও দূষণকারী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর বিরোধিতার কারণে সম্ভব হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণেই কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর করেনি যুক্তরাষ্ট্র। কানাডা স্বাক্ষর করেও কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়েছে ২৬ শতাংশ।
যথাযথ আইনি কাঠামো ও প্রতিকার বিধানের অনুপস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে ধনী দেশগুলো। এবার ডারবানেও দেখা গেল, প্রভাবশালী দেশগুলোর মতামতই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে কি ক্ষতির শিকার হয়েও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবি ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে ক্ষতিগ্রস্তরা? এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল অক্সফাম আয়োজিত প্রতীকী জলবায়ু আদালতের পর্যবেক্ষক ব্যারিস্টার রিচার্ড লর্ড কিউসিকে। তিনি বলেন, যদিও আন্তর্জাতিক জলবায়ু আইন বা আদালত বলে কিছু নেই, অ্যাটমোস্ফিরিক লিটিগেশান ট্রাস্ট আইনটিও ভ্রূণ পর্যায়ে, তার পরও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন আইন, ডিক্লারেশন, কনভেনশন ও আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তিগুলো অবলম্বন করে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যেতে পারে।
ইউএনএফসিসি (UNFCC) ও আইপিসিসির (IPCC) মতো আন্তর্জাতিক কাঠামোর সংগৃহীত পরিসংখ্যানগুলো সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির খতিয়ান ও পরিসংখ্যান আরও সুচারুরূপে সংরক্ষণ করে ক্ষতির কারণ হিসেবে এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ক্ষতিসৃষ্টিকারী পক্ষ থেকে বেশি দক্ষতা দেখাতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণ চাওয়াটা রাজনৈতিক হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় পেশাদারির দাবি করে। এডাপটেশন, মিটিগেশন খাতে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরের জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলারের যে তহবিল রয়েছে, তা থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় সহজ হতে পারে একটি উপযুক্ত জলবায়ু আদালতের উপস্থিতিতে। আইসিসি, আইসিজে, ডব্লিটিওর আদলে একটি আন্তর্জাতিক জলবায়ু-আদালত জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। khaliik@yahoo.com
No comments