ফিরে দেখা '৭১-যুদ্ধাপরাধ থেকে স্বাধীনতা by মালিক রশীদ

কাত্তরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের নৃশংসতা সম্পর্কে এ দুটি লেখা থেকে ধারণা মিলবে। দু'জনই পাকিস্তানি_ একজন সে সময়ে সরাসরি গণহত্যায় লিপ্ত ছিলেন, আরেকজন তরুণ প্রজন্মের
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যা, অগি্নসংযোগ, লুটপাট ও ধর্ষণ তথা দীর্ঘ নয় মাসের নৈরাজ্যজনক অবস্থার অবসান হলো। অনেক পাকিস্তানির কাছে এ দিনটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা


হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কারণ ঢাকায় এ দিনে পাকিস্তানি ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করার কয়েক ঘণ্টা আগেও তাদের প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধান অনির্দিষ্টকাল এ যুদ্ধ চলবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠকের কথা উল্লেখ করে রবাট পেইনি তার পুস্তক 'ম্যাসাকার'-এ লেখেন, ওই বৈঠকে ইয়াহিয়া খান সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন যে, 'তাদের ৩০ লাখকে হত্যা কর এবং তখন বাকিরা আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।'
রবার্ট পেইনি লেখেন, তখন মাসের পর মাস ধরে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চলেছিল। এসব হত্যাকাণ্ড কোনো আপতিক ঘটনা নয় বা তরুণ কর্মকর্তাদের নিতান্ত সাহসিকতা প্রদর্শনের উপলক্ষ নয়। বলা যায়, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে তখন দক্ষ অফিসাররা এসব নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছিল। মুসলিম ধর্মাবলম্বী সেনাদের তখন মুসলিম কৃষকদের হত্যার জন্য লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে হত্যাকাণ্ড তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ডাল-ভাত হয়ে গিয়েছিল... হিটলার রাশিয়া আক্রমণের সময় যে ধরনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল নাৎসি বাহিনী, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতা তাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকার সস্পর্কে মূল্যায়নে পেইনি লেখেন, সামরিক একনায়কত্ব প্রকৃতই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের ধরন।
আর. জে. রুমেল তার 'ডেথ বাই গভর্নমেন্ট' পুস্তকে বর্ণনা করেন, এসব স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ঘাতক স্থায়ী বাঙালিবিরোধী, বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে জাতিবৈষম্যতাড়িত। পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি বলেছেন, 'বাঙালিদের হরহামেশাই বানর ও মুরগির বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করা হতো।' নিয়াজির কাছে এই নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারীরা নিচু জাতের লোক। পাকিস্তানিদের কাছে বাঙালিদের মধ্যে হিন্দুদের অবস্থানটা ছিল নাজিদের কাছে ইহুদিদের অবস্থানের মতো। তাদের সমাজের জঞ্জাল ও ক্ষতিকারক মনে করা হতো এবং তাই তাদের বিনাশই ছিল পাকিস্তানিদের কাম্য। তাদের জীবন সৈন্যদের মর্জির ওপর নির্ভর করত। তাদের প্রতি কোনো সন্দেহ দেখা দিলে, কোনো শর্ত লঙ্ঘিত হলে, প্রত্যাঘাত হানার দরকার পড়লে তাদের শিয়রে মৃত্যুদূত এসে উপস্থিত হতো। সৈন্যরা তাদের খেয়ালখুশিমতো হত্যা করতে পারত। একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিক ড্যান কাগিন উল্লেখ করেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন তুচ্ছ কারণেও যে কোনো মানুষকে হত্যা করতে পারত। ওই ক্যাপ্টেন বলেন, 'আমাদের কারোর কাছেই এ জন্য জবাবদিহি করতে হতো না। আর এটাই হলো ক্ষমতার বলদর্পী প্রকাশ।'
সুশান ব্রাউনমিলার তার 'এগেইনস্ট আওয়ার উইল : মেন, উইমেন ও রেপ' নামক পুস্তকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষিত নারীদের সংখ্যা দুই লাখ থেকে চার লাখ বলে উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত সংখ্যালঘুরা যেমন ধর্ষিতা হয়েছেন তার চেয়েও বেশি সংখ্যায় তথা ৮০ শতাংশ ধর্ষিতা হয়েছেন মুসলিম মহিলারা। সেনাবাহিনীর জন্য অন্যান্য সরবরাহের মতোই বাঙালি মেয়েরা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ভোগের বস্তু। সৈন্যরা হামলা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে নারী ধর্ষণেও বেপরোয়া ছিল। তারা বাঙালি মহিলাদের ওপর পৈশাচিক বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ত। সদ্য বিবাহিত এক নারীর ধর্ষিত হওয়ার করুণ কাহিনী ব্রাউনমিলারের লেখায় উঠে এসেছে। প্রথমে দু'জন পাকিস্তানি সৈন্য একটি বাড়ির যে ঘরে নবপরিণীতা ছিলেন সেখানে গিয়ে ঢোকে। আর এক ঘরে অন্যদের আটকে রেখে পাহারা দেয় আর এক সৈন্য। সৈন্যরা মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে রক্ষার; কিন্তু সবই বৃথা। এক সময় গোঙানি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। এভাবে একের পর এক ছয় পাকিস্তানি সেনা ওই নবপরিণীতাকে ধর্ষণ শেষে চলে যায়। মেয়ের পিতা রুমে ঢুকে দেখেন তার মেয়ে রক্তাক্ত-বিবস্ত্র অবস্থায় নিস্তেজ পড়ে আছে। জামাতা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে নিজের বমির মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর হওয়ার অব্যবহিত পরেই তাদের ভারতের বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে চিরশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের সংকীর্ণ আত্মতৃপ্তির কারণে ভারত পাকিস্তানিদের মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের মতো জঘন্য অপরাধের কথা বিস্মৃত হয়। তারা এক চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়ে যায়। এসব সেনা পাকিস্তানে গিয়ে পেনশন সুবিধা এমনকি, জমিও পায় পুরস্কার হিসেবে। যুদ্ধের ব্যাপারে পাকিস্তানে একটি কমিশন গঠিত হলেও এর রিপোর্ট জনসমক্ষে পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ১৯৭৭ সালে আবার ক্ষমতা দখল করে এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয় আর বিশ্ব এভাবে ততদিনে তাদের '৭১ সালের যাবতীয় কুকর্ম বিস্মৃত হয়। বেলুচিস্তানেও সামরিক অভিযান চলেছে। জিয়াউল হকের জমানায় সিন্ধিদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়। পাকিস্তান তিন দশকের এক যুদ্ধে নিমজ্জিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার চিরাচরিত জিঘাংসার পথ ধরেই চলে এবং তাদের প্রচেষ্টার জন্য পিঠ চাপড়ানো ও সাহায্য দুই-ই জোটে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার যখন হচ্ছে তখন মনেই হয় না যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ ধরনের কোনো অপরাধ আদৌ করেছে বা যারা তাদের শিকার ছিল তারা আদৌ মানুষ নয়।
স ব্লগ থেকে ভাষান্তর

No comments

Powered by Blogger.