ভেঙে পড়েছে নগর সেবা by সজল জাহিদ ও সোহেল মামুন
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলশান অফিসে একটি অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। সাত দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো অভিযোগ আসেনি। এ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, অভিযোগ না আসায় আনন্দের কোনো কারণ নেই। উত্তর সিটি করপোরেশনের এ অফিস সম্পর্কেই তো মানুষ জানে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন দেওয়ার আগে সেবার গুণগত মানের ক্ষেত্রে এভাবেই পরিবর্তন আনতে চাইছে সরকার।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ_ দুই ভাগে ভাগ করায় সমস্যা কমার চেয়ে বরং বেড়েছে। উন্নয়ন কাজও থেমে গেছে। নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে ভয়াবহ বিভ্রান্তির অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। আগে যেসব সেবা কাউন্সিল অফিস থেকে দেওয়া হতো তা পেতে কোথায় যেতে হবে তা নিয়ে নাগরিকদের নাজেহাল দশা। খোদ নগর ভবনের কর্মকর্তারাও বলছেন, কোথায় কীভাবে কাজ হচ্ছে তার কিছুই জানেন না তারা। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চলছে সবকিছু। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এখন একটি নির্দেশনা আসছে তো পরক্ষণে আরেকটা। কোনো বিষয়েই স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না তারা। সে কারণে নাগরিক সেবার মধ্যেও এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, যা সামাল দিতে পারছে না ভিন্ন দুটি সিটি করপোরেশন। সমন্বয়হীনতার কারণে নাগরিকদের ভোগান্তিও বাড়ছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চেয়ে উত্তরেই সমস্যার ব্যাপকতা নজরে পড়ছে সবার।
অন্যদিকে সরকার দাবি করছে, মশক নিধন, লাইটিং এবং ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার_ এ তিনটি
বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এ কাজে সিটি করপোরেশনের উত্তর-দক্ষিণ দুই অংশকেই দেওয়া হচ্ছে সমান গুরুত্ব। কিন্তু গত কয়েক দিনে অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরেও সরকারের ঘোষণার সঙ্গে কাজের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মোঃ শহীদ খান অবশ্য বলেন, যেটুকু প্রতিবন্ধতা আছে ক'দিনের মধ্যেই তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি স্বীকার করেন, এখনও ঢাকার অনেক নাগরিকই জানেন না যে তিনি উত্তর সিটি করপোরেশন, নাকি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যমে ম্যাপসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার চালানো হবে বলেও জানান তিনি। তা ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান কাউন্সিল অফিসে না পাওয়া গেলে আঞ্চলিক কার্যালয়ে গেলেই সেবা মিলবে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক কার্যালয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাদের অবস্থানের ঠিকানা ও ফোন নম্বরসহ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।
জানা গেছে, এরই মধ্যে অধুনালুপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরের বরাদ্দ করা বাজেটও উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জন্য ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পেয়েছে ৫৯৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা আর দক্ষিণ অংশ পেয়েছে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তবে এর মধ্যে অভিন্ন যেসব প্রকল্প আছে তার বাজেটও সব দক্ষিণ অংশে ধরা হয়েছে। অভিন্ন প্রকল্পের বাজেট ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতা সংস্থার সাহায্যের প্রকল্পও রয়েছে। তবে এ বিভাজনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি অনেক ঠিকাদারের কাছে। সে কারণে উন্নয়ন কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছেন তারা। এ বিষয়ে এক ঠিকাদার বলেন, শেষ পর্যন্ত বিলটা কে দেবে_ কাজ শুরুর আগে সেটিও তো নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
স্কুলে ভর্তির মৌসুম হওয়ায় জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে ভিড় বাড়ছে কাউন্সিলরদের কার্যালয়ে। তা ছাড়া নাগরিক সনদপত্র বা চারিত্রিক সনদপত্র নেওয়ার তাগাদাও আছে; কিন্তু সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার পর কাউন্সিলররা আর এমন সনদ দিতে পারছেন না। ফলে তৈরি হয়েছে জটিলতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের কাউন্সিলরদের স্বাক্ষরেই পেছনের তারিখে দেওয়া হচ্ছে সনদ। সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিসের সন্ধান না পেয়ে এমন কৌশল নিয়েছেন নাগরিকরা। প্রথম ক'দিন এ নিয়ে সমস্যা ছিল চরমে। পরে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে দেওয়া যাবে এমন সনদ। পূর্বের ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের পাঁচটি পেয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আর পাঁচটি গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এ অফিসগুলোকেই এখন দেওয়া হয়েছে কাউন্সিল অফিসের ক্ষমতা।
সেবা পেতে ভোগান্তি : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশনের সব কাউন্সিলর কার্যালয়ে টানানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নাগরিক সনদপত্র, ওয়ারিশ সনদপত্র ও পাসপোর্ট প্রত্যয়নপত্র ওয়ার্ড সচিবের মাধ্যমে আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাওয়া যাবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৫ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে (মগবাজার) গিয়ে জানা যায়, সনদের জন্য আবেদনপত্রে ওয়ার্ড সচিব কেবল সুপারিশ করবেন। আর আবেদনপত্রটি নিয়ে যেতে হবে আবেদনকারীকেই। দুটি করপোরেশন গঠনের পর মগবাজার এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অঞ্চল-৩-এর আঞ্চলিক কার্যালয় গুলশান ২ নম্বরে। নাগরিকদের অনেকে ওই কার্যালয় চেনেন না।
বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় বাসিন্দা শরিফা আসেন ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে। এ সময় অফিস কক্ষটি খোলা থাকলেও সচিবসহ কোনো কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন না। অফিসের পাশে সিটি করপোরেশন লাইব্রেরির এক কর্মচারী তাকে জানান, সচিবের সুপারিশ নিয়ে তাকে আঞ্চলিক অফিস থেকে সনদ সংগ্রহ করতে হবে। সমকালকে শরিফা জানান, তিনি গার্মেন্ট কর্মী। জানুয়ারিতে নতুন গার্মেন্টে কাজ নেবেন। তাই নাগরিক সনদপত্র দরকার। গুলশানে গিয়ে সনদ আনার কথা শুনে হতাশ হয়ে ফিরে যান। পরে টেলিফোনে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সচিব সোলায়মান বলেন, শুধু গার্মেন্ট কর্মী নন, সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে গুলশানে গিয়ে সনদ নেওয়া কঠিন। তিনি জানান, এ বিষয়টি আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেছেন। তবে এখনও দিকনির্দেশনা পাননি।
অন্যদিকে গুলশানের আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে জানা গেছে, কিছু ওয়ার্ডের সচিবরাই নাগরিকদের সনদের আবেদন নিয়ে এসেছেন। সেগুলো নির্বাহী কর্মকর্তা দ্বারা স্বাক্ষর হয়ে আছে। তবে সনদ সংগ্রহ করতে যাননি অনেকে। তা ছাড়া দুই সিটি করপোরেশন গঠনের ১৫ দিনেও নতুন সিল বানানো হয়নি। সে জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন কৌশলে কাজ করছেন। বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, পুরনো সিল দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন তিনি। তবে নিচে 'ঢাকা সিটি করপোরেশন' লেখাটি মুছে ফেলেছেন। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কাজের সুবিধায় 'ঢাকা সিটি করপোরেশন' লেখাটিতে ঢাকার পর এরো চিহ্ন দিয়ে 'উত্তর' লিখেছেন।
৫০ কাউন্সিলরের ড্রইংরুমে অফিস : সদ্য বিলুপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের অন্তত ৫০ জন কাউন্সিলর যারা তাদের নিজেদের বাসার ড্রইংরুমকে কাউন্সিল অফিস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এর জন্য আবার তারা অফিস ভাড়াও নিয়েছেন সিটি করপোরেশন থেকে। এখন পদ হারানোয় এসব অফিসে সাইনবোর্ড ছাড়া আর কিছুই নেই। স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মোঃ শহীদ খান অভিযোগ করেন, জনগণকে যে ওইসব কাউন্সিল অফিস থেকে সেবা দেওয়া হবে তার কোনো ব্যবস্থাই সেখানে রাখা হয়নি। ফলে তাদের জন্য কাজ চালিয়ে নেওয়া কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। নির্বাচনের সময়ও ড্রইংরুমের এসব অফিসে কাজ করার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে বলে মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে অধুনালুপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫১ ওয়ার্ড কাউন্সিলের সচিব মোঃ বজলুর রহমান জানান, আগের কাউন্সিলের কারণে অনেক বড় একটি অফিস ব্যবহার করতেন মাত্র ৮ হাজার টাকায়। এখন কাউন্সিলর চলে যাওয়ায় বাড়িওয়ালা সেটির ভাড়া দাবি করছেন ২০ হাজার টাকা। ফলে এটি ছেড়ে অন্য কোনো ছোট অফিস নিতে হচ্ছে তাদের।
সম্পদের হিসাবে পিছিয়ে দক্ষিণ : বিলুপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিস্তারিত তালিকা তৈরি হয়েছে। হিসাবে ৩৪ একর জায়গা বেশি পেয়েছে ডিসিসি উত্তর। দক্ষিণের চেয়ে এসব জমির দামও ঢের বেশি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পেয়েছে মোট ৪২৯ একর সম্পত্তি আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি ৪৬৩ একর। ডিসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা গোলাম রহমান মিঞা জানান, অঞ্চল বিভাজনের পর যে স্থাপনাটি যে অঞ্চলে পড়েছে সেটি সে অঞ্চলের সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, সম্পত্তিতে পিছিয়ে পড়ায় রাজস্ব আদায়েও পিছিয়ে থাকবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কারণ উত্তরে হোল্ডিংয়ের সংখ্যা বেশি। আর নতুন বহুতল ভবন বেশি নির্মিত হচ্ছে উত্তরেই। এসব হোল্ডিংয়ের বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের হারও বেশি। ডিসিসি সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণে হোল্ডিং সংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজার ৭৯৮টি। এখান থেকে গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৬১ কোটি টাকা আর ডিসিসি উত্তরের ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৭৮টি হোল্ডিং থেকে গত অর্থবছরে রাজস্ব এসেছে ৪৯৬ কোটি টাকা। দক্ষিণ অংশের রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সেখানকার নাগরিক কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতেও বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়তে পারে।
উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা : সিটি করপোরেশন বিভাজনের পর রাস্তা মেরামত ও সংস্কার কাজ থেমে আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। যদিও শুষ্ক মৌসুমে নগরের বিভিন্ন এলাকায় বর্ষায় ভেঙে যাওয়া রাস্তাগুলো সংস্কারের কথা ছিল। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আরবান প্রকল্পের আওতায় পুরো শহরে সংস্কার কাজ পরিচালিত হওয়ার কথা। বাসাবো, আহমদবাগ নিয়ে গঠিত পুরনো ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন সমকালকে বলেন, বাসাবোতে আরবান প্রকল্পের আওতায় ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও গত মাসে কাজের টেন্ডার হয়। এখন নতুন করপোরেশনের পুরোদমে কাজ শুরুর জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
পরিচয় নির্ধারণে সমস্যা : আরামবাগের এক বাসিন্দা জানান, পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করেছে সিটি করপোরেশনের এ বিভাজন। সমগ্র দক্ষিণ ঢাকাই এখন পুরান ঢাকা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ফলে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও বৈষম্য হতে পারে। জামিল মাহমুদ নামে একজন আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বছর কয়েকের মধ্যেই হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। মতিঝিল আর মিরপুরের ট্যাক্স একই রকম হবে না_ সে যুক্তিও আসতে পারে তখন।
.
অন্যদিকে সরকার দাবি করছে, মশক নিধন, লাইটিং এবং ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার_ এ তিনটি
বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এ কাজে সিটি করপোরেশনের উত্তর-দক্ষিণ দুই অংশকেই দেওয়া হচ্ছে সমান গুরুত্ব। কিন্তু গত কয়েক দিনে অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরেও সরকারের ঘোষণার সঙ্গে কাজের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মোঃ শহীদ খান অবশ্য বলেন, যেটুকু প্রতিবন্ধতা আছে ক'দিনের মধ্যেই তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি স্বীকার করেন, এখনও ঢাকার অনেক নাগরিকই জানেন না যে তিনি উত্তর সিটি করপোরেশন, নাকি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যমে ম্যাপসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার চালানো হবে বলেও জানান তিনি। তা ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান কাউন্সিল অফিসে না পাওয়া গেলে আঞ্চলিক কার্যালয়ে গেলেই সেবা মিলবে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক কার্যালয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাদের অবস্থানের ঠিকানা ও ফোন নম্বরসহ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।
জানা গেছে, এরই মধ্যে অধুনালুপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরের বরাদ্দ করা বাজেটও উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জন্য ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পেয়েছে ৫৯৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা আর দক্ষিণ অংশ পেয়েছে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তবে এর মধ্যে অভিন্ন যেসব প্রকল্প আছে তার বাজেটও সব দক্ষিণ অংশে ধরা হয়েছে। অভিন্ন প্রকল্পের বাজেট ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতা সংস্থার সাহায্যের প্রকল্পও রয়েছে। তবে এ বিভাজনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি অনেক ঠিকাদারের কাছে। সে কারণে উন্নয়ন কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছেন তারা। এ বিষয়ে এক ঠিকাদার বলেন, শেষ পর্যন্ত বিলটা কে দেবে_ কাজ শুরুর আগে সেটিও তো নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
স্কুলে ভর্তির মৌসুম হওয়ায় জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে ভিড় বাড়ছে কাউন্সিলরদের কার্যালয়ে। তা ছাড়া নাগরিক সনদপত্র বা চারিত্রিক সনদপত্র নেওয়ার তাগাদাও আছে; কিন্তু সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার পর কাউন্সিলররা আর এমন সনদ দিতে পারছেন না। ফলে তৈরি হয়েছে জটিলতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের কাউন্সিলরদের স্বাক্ষরেই পেছনের তারিখে দেওয়া হচ্ছে সনদ। সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিসের সন্ধান না পেয়ে এমন কৌশল নিয়েছেন নাগরিকরা। প্রথম ক'দিন এ নিয়ে সমস্যা ছিল চরমে। পরে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে দেওয়া যাবে এমন সনদ। পূর্বের ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের পাঁচটি পেয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আর পাঁচটি গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এ অফিসগুলোকেই এখন দেওয়া হয়েছে কাউন্সিল অফিসের ক্ষমতা।
সেবা পেতে ভোগান্তি : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশনের সব কাউন্সিলর কার্যালয়ে টানানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নাগরিক সনদপত্র, ওয়ারিশ সনদপত্র ও পাসপোর্ট প্রত্যয়নপত্র ওয়ার্ড সচিবের মাধ্যমে আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাওয়া যাবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৫ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে (মগবাজার) গিয়ে জানা যায়, সনদের জন্য আবেদনপত্রে ওয়ার্ড সচিব কেবল সুপারিশ করবেন। আর আবেদনপত্রটি নিয়ে যেতে হবে আবেদনকারীকেই। দুটি করপোরেশন গঠনের পর মগবাজার এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অঞ্চল-৩-এর আঞ্চলিক কার্যালয় গুলশান ২ নম্বরে। নাগরিকদের অনেকে ওই কার্যালয় চেনেন না।
বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় বাসিন্দা শরিফা আসেন ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে। এ সময় অফিস কক্ষটি খোলা থাকলেও সচিবসহ কোনো কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন না। অফিসের পাশে সিটি করপোরেশন লাইব্রেরির এক কর্মচারী তাকে জানান, সচিবের সুপারিশ নিয়ে তাকে আঞ্চলিক অফিস থেকে সনদ সংগ্রহ করতে হবে। সমকালকে শরিফা জানান, তিনি গার্মেন্ট কর্মী। জানুয়ারিতে নতুন গার্মেন্টে কাজ নেবেন। তাই নাগরিক সনদপত্র দরকার। গুলশানে গিয়ে সনদ আনার কথা শুনে হতাশ হয়ে ফিরে যান। পরে টেলিফোনে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সচিব সোলায়মান বলেন, শুধু গার্মেন্ট কর্মী নন, সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে গুলশানে গিয়ে সনদ নেওয়া কঠিন। তিনি জানান, এ বিষয়টি আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেছেন। তবে এখনও দিকনির্দেশনা পাননি।
অন্যদিকে গুলশানের আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে জানা গেছে, কিছু ওয়ার্ডের সচিবরাই নাগরিকদের সনদের আবেদন নিয়ে এসেছেন। সেগুলো নির্বাহী কর্মকর্তা দ্বারা স্বাক্ষর হয়ে আছে। তবে সনদ সংগ্রহ করতে যাননি অনেকে। তা ছাড়া দুই সিটি করপোরেশন গঠনের ১৫ দিনেও নতুন সিল বানানো হয়নি। সে জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন কৌশলে কাজ করছেন। বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, পুরনো সিল দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন তিনি। তবে নিচে 'ঢাকা সিটি করপোরেশন' লেখাটি মুছে ফেলেছেন। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কাজের সুবিধায় 'ঢাকা সিটি করপোরেশন' লেখাটিতে ঢাকার পর এরো চিহ্ন দিয়ে 'উত্তর' লিখেছেন।
৫০ কাউন্সিলরের ড্রইংরুমে অফিস : সদ্য বিলুপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের অন্তত ৫০ জন কাউন্সিলর যারা তাদের নিজেদের বাসার ড্রইংরুমকে কাউন্সিল অফিস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এর জন্য আবার তারা অফিস ভাড়াও নিয়েছেন সিটি করপোরেশন থেকে। এখন পদ হারানোয় এসব অফিসে সাইনবোর্ড ছাড়া আর কিছুই নেই। স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মোঃ শহীদ খান অভিযোগ করেন, জনগণকে যে ওইসব কাউন্সিল অফিস থেকে সেবা দেওয়া হবে তার কোনো ব্যবস্থাই সেখানে রাখা হয়নি। ফলে তাদের জন্য কাজ চালিয়ে নেওয়া কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। নির্বাচনের সময়ও ড্রইংরুমের এসব অফিসে কাজ করার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে বলে মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে অধুনালুপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫১ ওয়ার্ড কাউন্সিলের সচিব মোঃ বজলুর রহমান জানান, আগের কাউন্সিলের কারণে অনেক বড় একটি অফিস ব্যবহার করতেন মাত্র ৮ হাজার টাকায়। এখন কাউন্সিলর চলে যাওয়ায় বাড়িওয়ালা সেটির ভাড়া দাবি করছেন ২০ হাজার টাকা। ফলে এটি ছেড়ে অন্য কোনো ছোট অফিস নিতে হচ্ছে তাদের।
সম্পদের হিসাবে পিছিয়ে দক্ষিণ : বিলুপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিস্তারিত তালিকা তৈরি হয়েছে। হিসাবে ৩৪ একর জায়গা বেশি পেয়েছে ডিসিসি উত্তর। দক্ষিণের চেয়ে এসব জমির দামও ঢের বেশি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পেয়েছে মোট ৪২৯ একর সম্পত্তি আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি ৪৬৩ একর। ডিসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা গোলাম রহমান মিঞা জানান, অঞ্চল বিভাজনের পর যে স্থাপনাটি যে অঞ্চলে পড়েছে সেটি সে অঞ্চলের সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, সম্পত্তিতে পিছিয়ে পড়ায় রাজস্ব আদায়েও পিছিয়ে থাকবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কারণ উত্তরে হোল্ডিংয়ের সংখ্যা বেশি। আর নতুন বহুতল ভবন বেশি নির্মিত হচ্ছে উত্তরেই। এসব হোল্ডিংয়ের বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের হারও বেশি। ডিসিসি সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণে হোল্ডিং সংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজার ৭৯৮টি। এখান থেকে গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৬১ কোটি টাকা আর ডিসিসি উত্তরের ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৭৮টি হোল্ডিং থেকে গত অর্থবছরে রাজস্ব এসেছে ৪৯৬ কোটি টাকা। দক্ষিণ অংশের রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সেখানকার নাগরিক কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতেও বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়তে পারে।
উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা : সিটি করপোরেশন বিভাজনের পর রাস্তা মেরামত ও সংস্কার কাজ থেমে আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। যদিও শুষ্ক মৌসুমে নগরের বিভিন্ন এলাকায় বর্ষায় ভেঙে যাওয়া রাস্তাগুলো সংস্কারের কথা ছিল। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আরবান প্রকল্পের আওতায় পুরো শহরে সংস্কার কাজ পরিচালিত হওয়ার কথা। বাসাবো, আহমদবাগ নিয়ে গঠিত পুরনো ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন সমকালকে বলেন, বাসাবোতে আরবান প্রকল্পের আওতায় ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও গত মাসে কাজের টেন্ডার হয়। এখন নতুন করপোরেশনের পুরোদমে কাজ শুরুর জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
পরিচয় নির্ধারণে সমস্যা : আরামবাগের এক বাসিন্দা জানান, পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করেছে সিটি করপোরেশনের এ বিভাজন। সমগ্র দক্ষিণ ঢাকাই এখন পুরান ঢাকা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ফলে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও বৈষম্য হতে পারে। জামিল মাহমুদ নামে একজন আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বছর কয়েকের মধ্যেই হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। মতিঝিল আর মিরপুরের ট্যাক্স একই রকম হবে না_ সে যুক্তিও আসতে পারে তখন।
.
No comments