জলবায়ুর পরিবর্তন : প্রশ্নের মুখে বাংলাদেশের প্রস্তুতি by জিসান হাসান
জেমস হানসেনের বই 'স্ট্রমস অব মাই গ্র্যান্ডচিলড্রেন : দি ট্রুথ অ্যাবাউট দ্য কামিং ক্লাইমেট ক্যাটাস্ট্রোফি অ্যান্ড আওয়ার লাস্ট চান্স টু সেভ হিউম্যানিটি' (ব্লুমসব্যারি কর্তৃক প্রকাশিত, ২০০৯) পড়ার অভিজ্ঞতাটা নিদারুণ। নাসার গডরাড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজের সাবেক পরিচালাক ড. হানসেন কোনো ভয় দেখানো হাতুড়ে বিশেষজ্ঞ নন, বরং দুনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত জলবায়ু-বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি একজন। বইটিতে তিনি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে
জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবে এক শতকের মধ্যে বাংলাদেশের বিলুপ্তির আমূল সম্ভাবনা দেখেছেন। স্বল্প শিক্ষিত মানুষরা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে গৌণ সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করলে তা উপেক্ষা করা চলে; প্রচারমাধ্যম আর সরকারগুলো এটা যেভাবে উপেক্ষা করছে, তাতে একজন সাধারণ নাগরিক কিভাবেই বা বিষয়টার গুরুত্ব উপলব্ধি করবে? ড. হানসেন দেখিয়েছেন, গণতান্ত্রিক বলে কথিত পদ্ধতির ফলাফল হলো_এমন কতগুলো সরকার ক্ষমতায় আসে, যেগুলো আসলে টাকার গোলাম। এর ফল হলো তেল, গ্যাস এবং কয়লা শিল্পমালিকদের যথেষ্টই ক্ষমতা আছে সস্তা জ্বালানি, প্রচুর কর্মসংস্থান আর প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেকোনো সরকারকে ইচ্ছামতো পরিচালনা করার। এটা মার্কিন সরকারের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সত্য। কয়েক বছর আগে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যে প্রণীত কিয়োটো প্রটোকল দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডাবি্লউ বুশ অনুমোদন দিতে অস্বীকার করলে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনাই ভেস্তে যায়, এটা আমাদের সবার ভবিষ্যৎকেই বিপন্ন করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো অব্যাহত রাখার ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আসছে শতকে সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র এক বা দুই মিটার উচ্চতা বৃদ্ধির পূর্বাভাস করেছে জলবায়ুগত পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেল (আইপিসিসি_ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ)। অনেকেই হয়তো ভেবেছেন, এ আর এমন কী! কিন্তু ড. হানসেন দেখিয়েছেন যে আইপিসিসির হিসাব খুব সম্ভবত বিশাল আকারে অবমূল্যায়িত। কেননা ভূতাত্তি্বক নজিরগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। তাঁর মতে, 'দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি উষ্ণতা বৃদ্ধি বিশ্বকে প্লাইয়োসিন যুগের সমান উষ্ণতর করবে, যেমনটা ছিল তিন মিলিয়ন বছর আগে। প্লাইয়োসিন উষ্ণায়ন সমুদ্রপৃষ্ঠকে বর্তমানের চেয়ে প্রায় ২৫ মিটার (আশি ফুট) উঁচু করেছিল।' এমনকি ২০ মিটার উষ্ণায়নও বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা জলমগ্ন করার জন্য যথেষ্ট। উত্তরবঙ্গ আর পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা বাদে বাকি সব ভূখণ্ডই সমুদ্রের নীল জলরাশির নিচে তলিয়ে যাবে। খেয়াল করা দরকার যে সব আন্তর্জাতিক জলবায়ুগত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে দুই ডিগ্রির নিচে সীমিত করা। কেননা দুই ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ধরা হচ্ছে সেই সংকটবিন্দু, যেটা শুধু বাংলাদেশের মতো নিচু অঞ্চল নয়,। পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকার জন্যই বিপজ্জনক পরিণাম বয়ে আনবে; কার্যক্ষেত্রে এটা দুই ডিগ্রি উষ্ণায়নকে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে পরিণত করেছে। অধিকাংশ দেশই কিন্তু কার্বন নিঃসরণ দুই ডিগ্রির নিচে সীমিত রাখার এই ব্যয়বহুল কার্যক্রমে নিজেদের লাভ দেখছে না। এ কারণে এটা নিশ্চিত যে বাস্তব উষ্ণায়ন অন্তত দুই ডিগ্রি হবেই, কেননা অধিকাংশ দেশ এটাকেই লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে বিবেচনা করছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাকি অধিকাংশ দেশের বিকারহীনতার ফলে বিপন্ন হবে।
তাহলে বাংলাদেশের ১৫০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কী হবে? শিক্ষিত আর ধনী অংশের জন্য দেশান্তর খুব বিরাট সমস্যা হবে না। দরিদ্রতর ৯৫ ভাগ জনগণ খুব সম্ভবত অনাহারের শিকার হবে, যদি না তাদের ভাগ্যের দ্রুত কোনো উন্নতি ঘটে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলাফল চরম পর্যায়ে যেতে হয়তো এক শতাব্দী লেগে যাবে। তার মানে হলো, একদম এখন থেকেই বাংলাদেশকে তার যা কিছু আছে সবই নিয়োজিত করতে হবে সমস্যাটার সমাধানে। এর জন্য দরকার সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সব নীতিমালার আমূল পরিবর্তন। সব প্রকল্পই তো অর্থহীন, যদি তা পানির নিচে চলে যায়। এর জন্য যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন তা ব্যয়বহুল হলেও অসম্ভব নয়। এর জন্য দরকার গোটা জনগোষ্ঠীর জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, কৃষি, শিল্পায়ন_সব কিছুরই একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এটা বিস্ময়ের যে হানসেনের মতো বিজ্ঞানী ওপরোলি্লখিত গ্রন্থে ভীতিকর চিত্রটা তুলে ধরতে পারেন, আর আমাদের নীতিনির্ধারকরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত সামান্য ভাবেন। তাঁদের একমাত্র ধান্ধা_নানা জাতীয় দাতা সংস্থা যে জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলের ডালা সাজিয়ে বসেছে, সেখানকার ভাগবাটোয়ারা। সরকারের আসলে প্রয়োজন জনগোষ্ঠীকে সক্ষম, যোগ্যতর ও শিক্ষিত করে গড়ে তোলা, যাতে তারা বদলে যাওয়া ভূগোলের সঙ্গে অভিযোজিত হতে পারে। হানসেনের গ্রন্থটা দারুণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞাত, সেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে তাঁর পিতামহ হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা তাঁকে বাধ্য করল বৈশ্বিক উষ্ণায়নবিরোধী কর্মীতে পরিণত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণে। বাংলাদেশের মানুষেরও একইভাবে তাদের উত্তর-প্রজন্মগুলো যে দুনিয়ায় জন্ম নেবে, তার সুরক্ষা নিয়ে আরো বেশি বেশি করে ভাবার সময় চলে এসেছে।
লেখক : গবেষক। সাবেক শিক্ষার্থী, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
আসছে শতকে সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র এক বা দুই মিটার উচ্চতা বৃদ্ধির পূর্বাভাস করেছে জলবায়ুগত পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেল (আইপিসিসি_ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ)। অনেকেই হয়তো ভেবেছেন, এ আর এমন কী! কিন্তু ড. হানসেন দেখিয়েছেন যে আইপিসিসির হিসাব খুব সম্ভবত বিশাল আকারে অবমূল্যায়িত। কেননা ভূতাত্তি্বক নজিরগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। তাঁর মতে, 'দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি উষ্ণতা বৃদ্ধি বিশ্বকে প্লাইয়োসিন যুগের সমান উষ্ণতর করবে, যেমনটা ছিল তিন মিলিয়ন বছর আগে। প্লাইয়োসিন উষ্ণায়ন সমুদ্রপৃষ্ঠকে বর্তমানের চেয়ে প্রায় ২৫ মিটার (আশি ফুট) উঁচু করেছিল।' এমনকি ২০ মিটার উষ্ণায়নও বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা জলমগ্ন করার জন্য যথেষ্ট। উত্তরবঙ্গ আর পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা বাদে বাকি সব ভূখণ্ডই সমুদ্রের নীল জলরাশির নিচে তলিয়ে যাবে। খেয়াল করা দরকার যে সব আন্তর্জাতিক জলবায়ুগত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে দুই ডিগ্রির নিচে সীমিত করা। কেননা দুই ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ধরা হচ্ছে সেই সংকটবিন্দু, যেটা শুধু বাংলাদেশের মতো নিচু অঞ্চল নয়,। পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকার জন্যই বিপজ্জনক পরিণাম বয়ে আনবে; কার্যক্ষেত্রে এটা দুই ডিগ্রি উষ্ণায়নকে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে পরিণত করেছে। অধিকাংশ দেশই কিন্তু কার্বন নিঃসরণ দুই ডিগ্রির নিচে সীমিত রাখার এই ব্যয়বহুল কার্যক্রমে নিজেদের লাভ দেখছে না। এ কারণে এটা নিশ্চিত যে বাস্তব উষ্ণায়ন অন্তত দুই ডিগ্রি হবেই, কেননা অধিকাংশ দেশ এটাকেই লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে বিবেচনা করছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাকি অধিকাংশ দেশের বিকারহীনতার ফলে বিপন্ন হবে।
তাহলে বাংলাদেশের ১৫০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কী হবে? শিক্ষিত আর ধনী অংশের জন্য দেশান্তর খুব বিরাট সমস্যা হবে না। দরিদ্রতর ৯৫ ভাগ জনগণ খুব সম্ভবত অনাহারের শিকার হবে, যদি না তাদের ভাগ্যের দ্রুত কোনো উন্নতি ঘটে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলাফল চরম পর্যায়ে যেতে হয়তো এক শতাব্দী লেগে যাবে। তার মানে হলো, একদম এখন থেকেই বাংলাদেশকে তার যা কিছু আছে সবই নিয়োজিত করতে হবে সমস্যাটার সমাধানে। এর জন্য দরকার সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সব নীতিমালার আমূল পরিবর্তন। সব প্রকল্পই তো অর্থহীন, যদি তা পানির নিচে চলে যায়। এর জন্য যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন তা ব্যয়বহুল হলেও অসম্ভব নয়। এর জন্য দরকার গোটা জনগোষ্ঠীর জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, কৃষি, শিল্পায়ন_সব কিছুরই একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এটা বিস্ময়ের যে হানসেনের মতো বিজ্ঞানী ওপরোলি্লখিত গ্রন্থে ভীতিকর চিত্রটা তুলে ধরতে পারেন, আর আমাদের নীতিনির্ধারকরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত সামান্য ভাবেন। তাঁদের একমাত্র ধান্ধা_নানা জাতীয় দাতা সংস্থা যে জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলের ডালা সাজিয়ে বসেছে, সেখানকার ভাগবাটোয়ারা। সরকারের আসলে প্রয়োজন জনগোষ্ঠীকে সক্ষম, যোগ্যতর ও শিক্ষিত করে গড়ে তোলা, যাতে তারা বদলে যাওয়া ভূগোলের সঙ্গে অভিযোজিত হতে পারে। হানসেনের গ্রন্থটা দারুণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞাত, সেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে তাঁর পিতামহ হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা তাঁকে বাধ্য করল বৈশ্বিক উষ্ণায়নবিরোধী কর্মীতে পরিণত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণে। বাংলাদেশের মানুষেরও একইভাবে তাদের উত্তর-প্রজন্মগুলো যে দুনিয়ায় জন্ম নেবে, তার সুরক্ষা নিয়ে আরো বেশি বেশি করে ভাবার সময় চলে এসেছে।
লেখক : গবেষক। সাবেক শিক্ষার্থী, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
No comments