ভিমরুলের চাকে ঢিল
নিজেদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু ১০ বছরের আফগান যুদ্ধে ‘রক্ত’ ছাড়া আর কিছুই পায়নি পাকিস্তান। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইসলামাবাদ। তবে বিশ্লেষকদের মতে, সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনের প্রতি ইসলামাবাদের এই চোখ রাঙানি পাকিস্তানকে আরও সংকটেই ফেলবে।
গত মাসে ন্যাটোর বিমান হামলায় ২৪ পাকিস্তানি সেনা নিহত হন। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তানে ন্যাটোর রশদ সরবরাহের সব পথ বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান। একই সঙ্গে জার্মানির বনে আফগানিস্তানের ভবিষ্যত্ নিয়ে অনুষ্ঠিত ৯০টি দেশের সম্মেলন বর্জন করে পাকিস্তান। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের শামসি বিমান ঘাঁটি ত্যাগ করতে বাধ্য করে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তান নানা পন্থায় বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য ইসলামাবাদের গুরুত্ব কতটা তাত্পর্যপূর্ণ।
ন্যাটোর বিমান হামলার পর পাকিস্তানজুড়ে পাল্টা প্রতিশোধের দাবি ওঠে। এর কয়েক দিন পর পবিত্র আশুরার দিন আফগানিস্তানের তিনটি শহরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ৬০ জন নিহত হয়। পাকিস্তানভিত্তিক একটি জঙ্গি সংগঠন এ হামলার দায় স্বীকার করেছে।
ন্যাটোর হামলায় পাকিস্তানের ২৪ সেনা নিহত ও আফগানিস্তানে আশুরার দিন হামলার ঘটনাকে অনেকে বিশ্লেষক একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, এটা ছিল পাকিস্তানের প্রতিশোধ।
আফগানিস্তানে জঙ্গি তত্পরতায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নতুন নয়। মার্কিন সামরিক বাহিনীর সাবেক চিফ অব স্টাফ অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন অভিযোগ করে বলেছিলেন, আফগানিস্তানে জঙ্গি তত্পরতায় পাকিস্তানভিত্তিক হাক্কানি নেটওয়ার্ক জড়িত। আর এই হাক্কানি নেটওয়ার্ক হলো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রকৃত অস্ত্র।
মাইক মুলেনের মতো আরও অনেক মার্কিন কর্মকর্তা আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে ইসলামাবাদের নিন্দা করেছেন।
সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানে ভাবমূর্তি যেমন প্রতিকূল, অনুরূপভাবে পাকিস্তানেও যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তিক্ততাপূর্ণ। সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হয়ে পাকিস্তানকে চড়া মূল্যই দিতে হচ্ছে। পাকিস্তানে অনেক প্রাণ ঝরে গেছে। এমনকি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করতেও দ্বিধা করছে না যুক্তরাষ্ট্র। ২০১১-এর জানুয়ারিতে এক সিআইএয়ের চর লাহোরে দুই পাকিস্তানিকে হত্যা করে। এরপর গত মার্চে মার্কিন বিশেষ বাহিনী পাকিস্তানে প্রবেশ করে আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে।
ইসলামাবাদের কথিত বন্ধুরাষ্ট্র খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ এখন ক্ষুব্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে সবার কণ্ঠেই এখন একই সুর, ‘যথেষ্ট হয়েছে।’
এত দিন পাকিস্তানে মার্কিন হামলার বিষয়ে ইসলামাবাদ বিভিন্ন সময়ে বারবার তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করলেও ওয়াশিংটনের কাছে তা গুরুত্ব পায়নি। এমনকি পাকিস্তানের ২৪ সেনা হত্যার ঘটনায় প্রেসিডেন্ট জারদারির কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে ওবামার এক সপ্তাহ লেগেছে। তার ওপর আবার চলতি সপ্তাহেই রিপাবলিকান দলের দুই সিনেটর পাকিস্তানে মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছেন।
এত কিছুর পরেও যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান নিজেদের স্বার্থেই একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তান চায়। অপরদিকে পাকিস্তানেরও দরকার মার্কিন সহায়তা।
কিন্তু পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই এখন নির্বাচনী হাওয়া বইছে। তাই অপ্রিয় অংশীদারদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার বিষয়টি উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক নিয়ে পাকিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার আছে সেনা অভ্যুত্থানের হুমকির মধ্যে।
এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের কৌশলগত চাহিদাগুলো পূরণ না করে, তবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন কঠিন হয়ে পড়বে।
এই কৌশলগত চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—আফগানিস্তানে ইসলামাবাদের অনুকূল একটি সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে ভারতের প্রভাব সীমিত করা।
এখন পাকিস্তান যদি আফগানিস্তানে ন্যাটোর রশদ সরবরাহের পথ ও ড্রোন ঘাঁটি ব্যবহার সুবিধা বন্ধ রাখে এবং গোয়েন্দা সহায়তা প্রদান না করে, তাহলে ইসলামাবাদের এ চাওয়া অপূর্ণই থেকে যাবে। আর তখন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানে পাকিস্তানে ভূমিকা হয়ে পড়বে অকেজো। বিশ্লেষকদের মতে, ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরে পাকিস্তান এখন মহা সংকটে। ইকনমিস্ট অবলম্বনে।
No comments